ছায়াছবি-কথা - ১৯
আগের পর্বে
রাষ্ট্রের গুপ্তচর পরিত্রাতার ভূমিকায় কীভাবে ঢুকে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে? কীভাবে বিষিয়ে দিয়ে চলে যায় মানুষের মন? হাঙ্গেরিয়ান ছবি 'সেটানট্যাঙ্গো'-তে সেই প্রেক্ষাপটই ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক বেলা টার। প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা দীর্ঘ এই ছবির কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে। মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। যদিও ১৯৮৫ সাল থেকেই শুরু হওয়ার কথা ছিল এই ছবির। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল হাঙ্গেরির কম্যুনিস্ট সরকারের বিভিন্ন নীতি। বি-নাটকীকরণ বা ডি-ড্রামাটাইজেশন এই ছবির অন্যতম মূলমন্ত্র। 'সেটানট্যাঙ্গো'-র পর্যালোচনার পর আজ হচ্ছে নতুন পর্ব...
১৯৮২ নাগাদ ল্যারি ডসি নামের এক আমেরিকান ডাক্তার ‘টাইম সিকনেস’ নামক একটা শব্দ বাজারজাত করেন। রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরে অমলকে প্রহরী সেই যে বলেছিল— “সময় কেবলই চ’লে যাচ্ছে", তেমনই আর কী। টাইম সিকনেস-এর বাংলা ধরি ‘কালাসুখ’। এক ব্রিটিশ মনস্তাত্ত্বিক বলেছিলেন-- আমরা নাকি আমাদের মধ্যে ‘ইনার সাইকোলজি অব স্পিড’ তৈরি করেছি সময় বাঁচিয়ে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টায় এবং তা নাকি দিনদিন বেড়েই চলেছে। কর্মদক্ষতা বাড়ানোর সঙ্গে পুঁজি-সংস্কৃতির সম্পর্কটা তো সকলেরই জানা। ‘মানি রিচ-টাইম পুওর’ —শব্দবন্ধটাও আজকাল প্রায়শই শোনা যায়। অর্থাৎ কিছু মানুষের দারিদ্র—সময়ের প্রেক্ষিতে। কাল-দরিদ্রের কালাসুখ। আর আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রে স্পেসটাইম-এর ধারণায় স্থানের ওপর সময়ের প্রভাব সম্পর্কেও জেনেছি আমরা।
১৯৮৫/৮৬ নাগাদ রোম শহরের স্প্যানিশ স্টেপস অঞ্চলে ম্যাকডোনাল্ড-এর একটা রেস্তোঁরা খোলার বিরুদ্ধে অনেক মানুষ আন্দোলনে নেমেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন-- ফাস্ট ফুডের এই সংস্কৃতি পৃথিবীর জল-জঙ্গল-জমিকে ধ্বংস করছে এবং অপ্রয়োজনে কাঁড়ি কাঁড়ি খাবার তৈরি হচ্ছে আর নষ্ট হচ্ছে। অথচ আজও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। এই ভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা একটা প্রচার শুরু করেন পৃথিবীজুড়ে। তাঁরা তাঁদের প্রতীক হিসেবে বেছে নেন শামুককে। হ্যাঁ, ‘শম্বুক গতি'র শামুক, যে ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে লক্ষ্যে পৌঁছেছিল। ফাস্ট ফুড-বিরোধী এই আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়— ‘স্লো ফুড’। দ্রুতির সংস্কৃতি নয়, ধীরতার (খাদ্য)সংস্কৃতি। ‘২-মিনিটে-ম্যাগি’ সংস্কৃতির ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে কথা বলেন তাঁরা, স্থানীয় বীজ সংরক্ষণ বা সঙ্কটাপন্ন ফসল বাঁচানো থেকে শুরু করে নৈতিক-ক্রয় (ethical-buying) ইত্যাদি নিয়েও কাজ করেন।
২০১৩ সালে প্রকাশিত হ’ল এক কিতাব, যেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণের (শুটিং ও অন্যান্য) নীতি-নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হল। কিন্তু চলচ্চিত্রে নৈতিকতার প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। বইটা আসলে নিসর্গনৈতিকতার প্রেক্ষিত থেকে তর্কটা তুলল। বলল— বিপুল অর্থব্যয়ে যে কোটি কোটি সাধারণ চলচ্চিত্র-পণ্য সারাক্ষণ তৈরি হয়ে চলেছে তা অন্যান্য অনেক কলকারখানার মতোই প্রকৃতি-পরিবেশের ভয়ানক ক্ষতি তো করছেই (সাংস্কৃতিক ক্ষতির কথা ছেড়েই দিলাম); এমনকি যে ছবিগুলো জলবায়ু পরিবর্তন কি পৃথিবীর ধ্বংস কি জীবজন্তু-জল-জঙ্গল বিষয়ে তৈরি, সেগুলো তৈরি করতে গিয়েও নিজেরাই প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে বেশ খানিক প্রকৃতির ক্ষতি করে বসছে। অর্থাৎ অন্যকে শেখাতে গিয়ে/শেখানোর ভান করে নিজেই ভুলে বসছে কর্তব্য। অথবা পুঁজিশাসিত পৃথিবীতে কোনো-না-কোনো অর্থে পুঁজির শাসন মেনে চলা সব চলচ্চিত্রই এক একটি পণ্য।
আরও পড়ুন
বেলা টারের সেটানট্যাঙ্গো
২০১৩-র সেই বইটার নাম-- ইকোসিনেমা: থিওরি অ্যান্ড প্র্যাক্টিস। এর অনেক বছর আগেই অবশ্য গুঢ় নিসর্গনীতিক প্রফেসর আর্ন নয়েস তাঁর তত্ত্বে নিসর্গনৈতিক দার্শনিকতার কথা বলেছিলেন। এবং তার কিছুকাল পরে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ফেলিক্স গুয়াতরি ইকোসোফি(নিসর্গদর্শন)-র গুরুত্বের কথা বলেন পারিবেশিক, সামাজিক ও মানসিক নিসর্গের মধ্যে সমন্বয়সাধন করার কথা ভাবতে গিয়ে।
আরও পড়ুন
আফঘান মেয়ের সিনেমা
২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল একটা বই— মোশন(লেস) পিকচারস: দ্য সিনেমা অফ স্ট্যাসিস। গতিহীন সে বই-এর প্রচ্ছদে ছিল ১৯৬৪ সালে নির্মিত এম্পায়র নামক এক ছবির একটি শটের স্থিরচিত্র। বস্তুত ছবিটিতে মোট দৃশ্যসংখ্যা ছিল— এক। দিন পেরিয়ে রাত হয়, সাদা থেকে কালো হয়ে ওঠে আকাশ, স্টেট এম্পায়র অট্টালিকায় আলো জ্বলে ওঠে— দেখা যায় ছবিতে। ছবিটির দৈর্ঘ ছিল আট ঘণ্টা। ঠিক তার আগের বছর এই ছবিরই পরিচালক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর অ্যান্ডি ওয়ারহল বানিয়েছিলেন প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা দৈর্ঘের একটি ছবি— স্লিপ। ছবিতে আমরা এক নগ্ন পুরুষকে (কবি ও অঙ্গশিল্পী জন জোরনো) শুধু ঘুমোতে দেখি, নানা দিক থেকে। তার শরীরের নানা অঙ্গ দেখি। ঘুমের মধ্যেকার নড়াচড়া দেখি। তিনি ঘুমিয়েই চলেন। এমন স্থিরতার সঙ্গে এর আগে কারোর ঘুম প্রত্যক্ষ করেনি আধুনিক শিল্পের সভ্যতা এত সময় ধরে। ওয়ারহল বলেন— ‘সময়ের বয়ে যাওয়াকে দেখা’ই এসব ছবির মূল উদ্দেশ্য। এসব ছবিকে অনেকে অ্যান্টি ফিল্ম-ও বলেছেন। সময়কে ব্যবহারের প্রেক্ষিতে চলচ্চিত্র মাধ্যমটির প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে পড়ার বিরোধিতায় এসব বলা (সুবিমল মিশ্র-র অ্যান্টি-গল্প অ্যান্টি-উপন্যাস-এর কথা স্মরণ করুন)। এমন নিরীক্ষামূলক ছবিও আছে যার দৈর্ঘ ৩৫ দিন ১৭ ঘণ্টা (এরিকা মাগুঁসঁ ও ড্যানিয়ল অ্যান্ডারসন পরিচালিত লজিস্টিকস বালজিস্টিকস আর্ট প্রজেক্ট, ২০১২)। মজার বিষয় হল ফাস্ট ফুড-খাওয়া ডিজিটাল সভ্যতাই কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন লম্বা লম্বা শট নিয়ে ধীর লয়ের লম্বা লম্বা ছবি বানাবার পথকে বেশি সহজ করে তুলেছে।
২০১৯ সালে বাংলাদেশের পরিচালক আশরাফ শিশির-এর নির্দেশনায় মুক্তি পেল ‘আমরা একটা সিনেমা বানাবো’। ২১ ঘণ্টা লম্বা সেই চলচ্চিত্র। সেটা কিন্তু নিরীক্ষামূলক ছবি নয়। দিব্য ঘটনা-দুর্ঘটনা নানাকিছু আছে তাতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে নিয়ে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে এই তো ২০১৬-য় ফিলিপাইন্সের চিত্রপরিচালক লাভ ডিয়াজ তৈরি করলেন ৮ ঘণ্টার চেয়েও বেশি লম্বা সাদা-কালো ছবি আ লালাবায় টু দ্য সরোফুল মিস্ট্রি। এ ছবিতে চরিত্র, তাদের নড়াচড়া, তাদের বিকাশ, ঘটনা এবং তার অগ্রগতি সবই কিন্তু উপস্থিত। এমনকি নাচ-গানও তাঁর ছবিতে ব্রাত্য নয়। কেউ কেউ তাঁর ছবিকে ‘লং সিনেমা’ তকমাভুক্ত করতে চাইলে তিনি বললেন— ‘চিত্রকলা দেখতে গিয়ে ক্যানভাসের মাপ দেখে কী বলেন, যে এটা ছোটো চিত্রকলা, ওটা বড়ো চিত্রকলা! চলচ্চিত্রের আবার লম্বা-বেঁটে কী!’
আরও পড়ুন
হত্যাযজ্ঞের অভিনয়ে হত্যার বাস্তবতা
২০১৬ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হল একটা বই, নাম— স্লো সিনেমা। যে চিন্তাসূত্রের কথা এখানে বলা দরকার তা হল বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত জিল দ্যলুজ-এর দুটো বই বেরিয়েছিল যথাক্রমে ১৯৮৩ আর ১৯৮৫ সালে। প্রথমটা— সিনেমা ১: দ্য মুভমেন্ট ইমেজ। দ্বিতীয়টার নাম— সিনেমা ২: দ্য টাইম ইমেজ। সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের চলচ্চিত্রমানস আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চলচ্চিত্রমানস-- এমন রীতিতে তিনি চলচ্চিত্রকে (চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে নয় কিন্তু) দুটো ভাগে ভাগ করলেন। মোদ্দায় বলতে চাইলেন— শুরুর দিকের চলচ্চিত্র বেশিবেশি করে গতিশীলতার কাছে আশ্রয় পেতে চাইত। পরে ক্রমশ তা গতিহীনতার দিকে সরে আসতে থাকে। অর্থাৎ ‘ধ্রুপদী’ চলচ্চিত্রের ঘটনাবাহুল্য-কেন্দ্রিকতা থেকে সময়ের-বয়ে-চলা-কেন্দ্রিকতায় আকৃষ্ট হয়ে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে ‘আধুনিক’। তাঁর তর্ক সাজাতে তিনি মূলত সাহায্য নিলেন আরেক ফরাসী দার্শনিক অঁরি বার্গসঁ-র সময়-কালিকতা-ক্ষণদৈর্ঘ বিষয়ক সন্দর্ভের। কিন্তু এখানে একটা মজার কথা আনি। ইয়েভগেনি বাওয়ার ছিলেন রাশিয়ার এক চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯১৭-য় নভেম্বর বিপ্লবের আগেই মারা যান। তাঁর ছবির ভাষা দেখলে ‘ধ্রুপদী’ ও ‘আধুনিক’ দ্বৈতকেন্দ্রিক ভাবনা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ১৯১৫-য় তাঁর আফটার ডেথ ছবিতে একটা তিন মিনিট লম্বা ট্র্যাকিং শট বর্তমান আলোচনা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে। ‘ধ্রুপদী-আধুনিকতা’ নামক এক ধারণার পাশে এসে দাঁড়াতে হয়। অবশ্য শিল্প-ছবি (আর্ট সিনেমা) বিষয়ক তত্ত্বায়নক্ষণে চলচ্চিত্রবিদ্যার বিশেষ পণ্ডিত ডেভিড বর্ডওয়েল ‘প্যারামেট্রিক ন্যারেশন’ নামক এক ধারনার অবতারণা করেন যে শব্দবন্ধ আর এক বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত নোয়েল বার্চের তত্ত্বায়নের ওপর আধারিত।
১৯১৯ সালে পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র শেখানোর বিদ্যায়তন বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ায় তৈরি হয়। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রথম প্রধান ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক লেভ কুলেশভ। তিনি তাঁর একটি প্রবন্ধের নাম দেন ‘আমেরিকানিটিস’— যার অর্থ ন্যুরাস্থেনিয়া নামক এক মানসিক জটিলতা যা আমেরিকানদের মধ্যেই নাকি সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছিল, যাতে উচ্চ রক্তচাপ-ক্লান্তি-মাথাধরা-বুক ধড়ফড়-অবসাদ ইত্যাদি হত। সদাব্যস্ত জীবনপ্রণালিই নাকি ছিল এর মূল কারণ। অথচ এই কুলেশভই অন্য এক প্রবন্ধে লিখছেন— আমেরিকার ছবি সবাই উৎফুল্ল হয়ে দেখে অথচ রাশিয়ার ‘দুর্বল’ ছবি দেখে না, তার কারণ রাশিয়ানরা আমেরিকানদের মতো ছোটো ছোটো শটের সমন্বয়ে দ্রুত শটের পর শট বদলে সম্পাদনা করেন না বা সেভাবে ছবি তোলেন না। (কুলেশভের পরের দিকের লেখায় অন্য সুরও কিছু শোনা যায়।) তাই রাশিয়ানদের উচিত অবিলম্বে এই ধরনের দ্রুতিসম্পন্ন সম্পাদনারীতি (মন্তাজ)-র আশ্রয় নেওয়া। এটা সেই ধরনের ছবিরই ধারণা যাকে দ্যলুজ মুভমেন্ট-ইমেজ হিসেবে পড়বেন।
আরও পড়ুন
বিষাদময় রহস্যের এক ঘুমপাড়ানি গান
[খেয়াল করুন, পূর্ববর্তী সমস্ত অনুচ্ছেদ শুরু হয়েছে কোনো-না-কোনো সাল অর্থাৎ সময়ের উল্লেখ করে।]
থাইল্যান্ডের বিশ্ববিখ্যাত চিত্রপরিচালক আপিচ্যাটপং এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তিনি যখন ফিল্ম স্কুলে পড়তে যান তখন বেশিরভাগ এমন ছবি দেখানো হত যা দেখতে গিয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন; আর এখন তিনি জানেন তাঁর নিজের ছবি দেখতে গিয়ে দর্শকেরা ঘুমিয়ে পড়েন। এতে তিনি যারপরনাই আহ্লাদিত। জাপানের ওজু, ইতালির আন্তোনিওনি, রাশিয়ার তারকোভস্কি, ফ্রান্সের ব্রেসঁ, ভারতের মণি কওল, ইরানের কিয়রোস্তামি, চিনের জিয়া ঝাঙ্কে, স্যুইডেনের রয় অ্যান্ডার্সন এবং আরও সামান্য কিছুজন চিত্রপরিচালকের নাম তো করাই যায় যাঁরা ছবিকে মূলত সময়ের বহমানতা দিয়ে দেখেছেন। সময়ের নিরবচ্ছিন্নতা দিয়ে এঁকেছেন তাঁদের চলচ্চিত্রীয় অভিব্যক্তি। অথচ নিজেদের চলচ্চিত্রীয় বিশ্বাসে এঁরা কিন্তু আবার একে অপরের চেয়ে ভিন্ন, বাস্তববাদ ইত্যাদি বিষয়ক তর্কে।
চলচ্চিত্রের জন্মের যুগে দর্শকেরা নড়াচড়া করা ছায়া-ছবি দেখতেই আসতেন। নড়াচড়া যত বেশি চড়া এবং স্পেক্ট্যাকুলর, ততই বেশি অ্যাট্রকশন। তারপর, অল্প সময়ে বহু শটের সমন্বয়ে ঘটনার বাহুল্যপ্রদর্শনে গপ্পো বলাতে ওস্তাদ হয় এক জাতের ডিজায়ার ফুলফিলিং আখ্যানযুক্ত বাণিজ্য-ছবি। অর্থাৎ পর্দায় ‘কী (গল্প) দেখা যাচ্ছে’— এই প্রশ্নই সেখানে মূল থাকে। প্রশ্নটা তারপর সরে আসে ‘কীভাবে’র পরিসরে। তারওপর, ‘কী’, ‘কীভাবে’-ও বহু দেখেছে সভ্যতা। ছবি উপভোগের (এনজয়মেন্ট/এন্টারটেইনমেন্ট) বস্তু হওয়ার বদলে, যদি হয় অভিজ্ঞতার (এক্সপিরিয়েন্স); ঘোড়দৌড়ের এই জীবনে শিল্পের থেকেও তাড়াহুড়োর অভিজ্ঞতাই চাইব! আর না পেলেই বলব— বোরিং! তার জন্য প্রত্যেকটা ছবিকে, ছবির শটকে হতেই হবে ভীষণ লম্বা, ভীষণ ধীরগতিসম্পন্ন—এমন কিন্তু চাওয়া হচ্ছে না। শুধুই তাকানোর বদলে হয়ত চাওয়া হচ্ছে অবলোকন।
হাঙ্গেরির বিশ্বখ্যাত পরিচালক বেলা টার। তাঁর (ও অ্যাগনেস রানিৎজস্কি-র) দ্য ট্যুরিন হর্স (২০১১) ছবিতে আমরা দেখি এক জনপ্রাণীহীন স্থানের এক বাড়িতে এক বাবা আর মেয়ের দৈনন্দিনতা। তাদের নিজেদের মধ্যে প্রায় কোনো কথোপকথনই হয় না। পুনরাবৃত্ত হতে থাকে দৈনন্দিনতা। এমন তন্নিষ্ঠ শৈল্পিক পুনরাবৃত্তি কাব্যছন্দের অনুভূতি জাগায়। এ-ধরনের ছবির রং ছায়া দেয়। এ-ধরনের ছবির ছন্দ হাত বুলিয়ে দেয় পিঠে-মাথায়। এ-ধরনের ছবি আশ্রয় নেয় বোধের কুলুঙ্গিতে। তাইওয়ানের বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সাই মিং-লিয়াং-এর ওয়াকার সিরিজের ছবিগুলো ফিরিয়ে দেয় প্রাণ। ধীর এবং দৃঢ় চরণে। অজন্তার দেওয়াল থেকে যেন নেমে এসেছেন এক বৌদ্ধ পরিব্রাজক। নগর-বন্দর-সাগর-বনানী বেয়ে একজন মানুষ শুধু হেঁটে চলেন এমন লয়ে, যা স্পর্শযোগ্য ক’রে তোলে পদসঞ্চারের গুঢ়ার্থ। সে নিঃশব্দ চরণ কখনও প্রত্যক্ষ করেনি উত্তরসত্য কাল। এ মন্দ লয়, গতিজনিত কালাসুখ থেকে সারিয়ে তোলে আমাদের। আয়নার মতো সটান, স্বপ্নসম দাঁড়ায় আমাদের মনের সামনে।
এই প্রহরের দেওয়ালেই নানা দেশের, নানা ভাষার ছবি নিয়ে নয় নয় করে খান কুড়ি প্রবন্ধ লিখেছি। কিন্তু বাংলা ছবি নিয়ে লেখা হয়নি। এই শারদোৎসবকালে একটা বাংলা ছবি নিয়ে এক ছত্র লিখে ইতি টানা যাক।
চারপাশটা আছে। কিন্তু যেন নেই। রাস্তাঘাট-গাড়িঘোড়া-মানুষজন অনুনাদে-বিপদে-প্রতিবাদে আছে সবই, পাশেই আছে সেসব, কিন্তু যেন নেই। সেসবের ছোঁয়া যেন লাগে না প্রাণে। বিশাল মহাকাশ আর ছোট্ট পৃথিবীর একভাগ মাটিতে পাতা ছোট্ট মানসবাসায় গুমরে আছে প্রাণপাখি। একলাটে। একলামি তার স্ব-ভাব নয়, অর্জন। ভবিষ্যদ্রষ্টা যেন বিচ্ছিন্নতার মহামারীর ঘোষণা করে যায়। অস্তিত্ব যে আছে, অনস্তিত্বই তার নাছোড় প্রমাণ দিয়ে চলে। অস্তিত্বহীনতা মূর্ত হয়ে হয়ে থাকে তারায় তারায়। ‘আমাদের যখন মন খারাপ করে, একা লাগে তখন তারারা জন্মায়’। আমাদের সবার মনখারাপের তারা আছে আকাশে। দাদরার বোলে যে জ্যামিতিক সমকোণী ত্রিভুজ ফিরে ফিরে আসে, এখানেও ঠিক তেমনটা। তবে অধিকাংশ সময়ে তৃতীয় শীর্ষবিন্দুটা থাকে অদৃশ্য। অস্তিত্বহীন নয় তবু। বিলম্বিত। পর্দায় যখন দেখা যায় দুটি চরিত্র, তখন কোনো এক তৃতীয়ের অপ্রত্যক্ষ উপস্থিতিই দুই-এর সংলাপহেতু হয়। আর এই সবকিছুই হয় ‘কিছু-না-ঘটার’ অবলোকন-ছন্দে।
অমিতাভ চ্যাটার্জী নির্মিত ছবি আমি ও মনোহর (২০১৮)। অত্যল্প কলাকুশলীসম্বলিত স্বল্প মূলধনের ছবি। ছবির বেশিরভাগ অংশ আইফোনের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা। মধুরা পালিতের ক্যামেরায় জানা অথচ খুব অচেনা এক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায় এই সাদাকালো ছবি। ন্যূনলয়ের এমন ছবি যে আমাদের চারপাশে উদ্ভিন্ন হচ্ছে, এই লেখার মূল আখ্যানের প্রেক্ষিত থেকে মিলিয়ে পড়লে, তা অত্যন্ত আশার কথা বৈকি!
[এই প্রবন্ধের মূল কাঠামো ‘পালাপাব্বন’ পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত।]
Powered by Froala Editor