বেলা টারের সেটানট্যাঙ্গো

ছায়াছবি-কথা ১৮
আগের পর্ব

চেয়েছিলেন পদার্থবিদ হতে। অথচ, ফ্রান্সের  আতেলিয়ার্স ভারাঁ পরিচালিত, কাবুলে আয়োজিত তথ্যচিত্র কর্মশালায় গিয়েই ছবি বানানোর জগতে পা দেন ইরানের পরিচালক শাহরবানু সাদাত। আনোয়ার হাশিমির অপ্রকাশিত পঞ্চধ্যায়ী ডাইরির প্রথম দুটি অধ্যায় নিয়ে দুটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেন শাহরবানু। উলফ অ্যান্ড শিপ এবং দ্য অরফ্যানেজ। আফগান বাসিন্দাদের জীবন, লোকশ্রুতি, জনপদ, পাহাড়ি উপত্যকা, তার চরিত্র বার বার ফিরে ফিরে এসেছে দুটি সিনেমাতেই। সেই চলচ্চিত্র দুটির আলোচনার পর আজ আসছে নতুন পর্ব...

যৌথ খামার ভেঙে পড়ার গল্প বলে এই ছবি। যৌথ স্বপ্ন, যৌথ শ্রম, যৌথ যাপন পেছনপানে চলে যায় ধীর লয়ে। যৌথতার মানুষেরা যদিও বিশ্বাস করতে চেয়েছিল, রাখতে চেয়েছিল আস্থা একে অপরের প্রতি, নাচে-গানে কাটিয়ে দেবে ভেবেছিল; কিন্তু পরিত্রাতা নির্মাণের এক অভ্যেসই হয়ত তাদের ঠেলে দিল ভাঙা স্বপ্নের দুয়ারে। বেরঙিন ধূসর মরচে আর জং ধরা ফুটোফাটা দেওয়ালে চটা ওঠা জলে ভিজে ফুলে ওঠা শ্যাওলা গজানো এঁদো ঘরদোর দোকানপাট রাস্তা হৃদয় ছেড়ে নতুনভাবে ভালো থাকার দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে একে একে খসে পড়া রাততারাদের মতো তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আকাশ-মাটির গা থেকে। এক বৃদ্ধ ডাক্তার, যিনি তার জানলা দিয়ে লক্ষ্য রাখতেন এই যৌথ সমাজটার দিকে আর সর্বদ্রষ্টার আঙ্গিকে হস্তাক্ষরে লিখে রাখতেন সেসবের তাৎক্ষণিক টুকরো বর্ণনা; সেই সমাজটার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে একাকী রয়ে গিয়ে শেষ দৃশ্যে একের পর এক কাঠের পাটা জুড়ে জুড়ে বন্ধ করে নিলেন বাহিরকে অন্তর্গত করা সেই মায়া-বাতায়ন। পড়ে রইল নিঃসীম অন্ধকার।

রাষ্ট্রের গুপ্তচর পরিত্রাতার ভূমিকায় ঢুকে পড়েছিল বিশ্বাসী মানুষগুলোর জীবনে। নিঃশব্দে বিগড়ে যাচ্ছিল মানুষগুলোর মন। যেভাবে তার থেকে সামান্য বড়ো দাদারও হাত কাঁপেনি ছোট্ট বোনটাকে লোভ দেখিয়ে তার জমানো টাকা আত্মসাৎ করতে; ঠিক সেভাবেই প্রিয় মার্জারের হন্তারকের ভূমিকায় যেতে দ্বিধান্বিত হয়নি আর কিশোরী মন। তার সঙ্গেই সে মৃত্যুকে জড়িয়ে মৃত্যুর কোলে সমর্পণ করতেও দু’বার ভাবেনি সদ্য উদ্ভিন্ন আপন জীবনটা। এখানে বৃষ্টি পড়ে বারোমাস, ঠান্ডা হাওয়া এখানে অবিশ্রান্ত। জল-কাদাই যেন সব মানুষগুলোকে থমকে রেখেছে এখানে। এখানে ধূসর আকাশ। ন্যাড়া গাছপালা। মানুষগুলো আছে, অথচ নেই যেন। প্রাণের উচ্ছ্বলতা শুষে নিয়েছে যেন কোন কাল-রাক্ষসে! এখানে বেশ্যার গলাতে বাজে বিষাদের সুর। নিজেদের কর্মদোষেই যেন বা ট্র্যাজেডির অভিনেতৃত্ব হয়ে দাঁড়ায় তারা।

লাজলো ক্রাসনাওরকাই-এর ১৯৮৫ সালের উপন্যাস অবলম্বনে, হাঙ্গেরির অন্যতম প্রধান চিত্রপরিচালক বেলা টার-এর সাদা-কালো ছবি সেটানট্যাঙ্গো বা আক্ষরিক তরজমায় শয়তানের নৃত্য (ট্যাঙ্গো— লাতিন আমেরিকায় উদ্ভূত এক ধরণের যুগল নৃত্য)। ছবির দৈর্ঘ ৪৩৯ মিনিট বা প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা। এটি তাঁর তৈরি মোট ন’টি পূর্ণদৈর্ঘের কাহিনীচিত্রের ছ’ নম্বর ছবি এবং অন্যান্য ছবিগুলির মধ্যে দীর্ঘতম। মোট শটের সংখ্যা— ১৫৬টি। ছবিটি বানাতে সময় লেগেছিল মোট চার বছর। ছবি তোলা হয়েছিল ১২০ দিন ধরে। ছবিটা যদিও করার কথা হয়েছিল ’৮৫ সালেই, কিন্তু হাঙ্গেরির কম্যুনিস্ট সরকারের বিভিন্ন নিয়মনীতির কারণে বানানোর কাজে হাত দিতে সাহস পাননি টার। অতঃপর তাঁর বার্লিনবাস থেকে ’৯০ সালে ফিরে এই ছবির কাজ শুরু করেন টার। অবশেষে ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় সেটানট্যাঙ্গো।

আরও পড়ুন
আফঘান মেয়ের সিনেমা

ক্ষয়ে যাওয়া এক সময়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছবিটা। চরিত্রদের মধ্যেকার কথাবার্তা অনেক সময়েই ঠিক বাস্তবানুগ ঠেকে না। মূল চরিত্র ইরিমিয়াসের কথার ধরণ বহু সময়েই দার্শনিক ভঙ্গিমা নেয়। প্রসঙ্গত, এই ইরিমিয়াসই গ্রামের মানুষদের প্রলোভন দেখিয়ে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয় এবং সে প্রশাসনের এক গুপ্তচর। তার দার্শনিক ভঙ্গিমাই অবশ্য তার সম্পর্কে গ্রামের মানুষদের নিঃসন্দিহান করে বা বিশ্বস্ত করে তোলে প্রায় এক অতিমানবের অবয়বে। ছবিটা জুড়ে এক জাতীয় অস্তিত্ববাদিতার গন্ধ লেগে থাকে যেন। এখানকার ধূধূ কাদামাখা ল্যান্ডস্কেপ, একনাগাড়ে হয়ে চলা বৃষ্টি যেন চরিত্রগুলোকে গিলতে আসে। চরিত্রদের একা করে দেয়। ফিরে ফিরে আসে একটা চাপা নিঃসঙ্গতার আর্তস্বর।  

আরও পড়ুন
হত্যাযজ্ঞের অভিনয়ে হত্যার বাস্তবতা

এ ছবিতে এমন অনেক দৃশ্য আছে যা আমরা দু’বার করে দেখি। ভিন্ন কোণ থেকে। একই ঘটনা হলেও তারা হুবহু এক হওয়ার বদলে কিছু সময়ে তো যথেষ্ট আলাদা হয়ে ধরা দেয়। পুনরাবৃত্তি এখানে আসে পরিপ্রেক্ষিত বা দৃষ্টিকোণনির্ভর হয়ে। বারোটা ভাগে বিভক্ত বা, বলা ভালো, সংযুক্ত এই ছবি। তাই ভিন্ন ভাগের পুনরাবৃত্তি ভিন্নতার ভিন্নতর অবয়বে হাজির হয়।  

আরও পড়ুন
বিষাদময় রহস্যের এক ঘুমপাড়ানি গান

এই ছবির প্রায় সব শটের দৈর্ঘই সাধারণ মূলধারার ছবির থেকে কয়েকগুণ বেশি। প্রথম শটটি প্রায় আট মিনিট দৈর্ঘের। শট-কাউন্টার শটের পরিবর্তে এখানে চরিত্র এবং ক্যামেরা যুগল ছন্দে এক কোরিওগ্র্যাফিতে অংশগ্রহণ করে। একই শট শুরুতে হয়ত ক্লোজ আপ, সেই শটই খানিক বাদে গিয়ে এক্সট্রিম লং শটে রূপান্তরিত হয়। আর আছে এক অভূতপূর্ব ঘূর্ণন। হাল্কা চালে ভাসতে থাকা মেঘের মতো ক্যামেরা ঘুমন্ত মানুষদের পর্যায়ক্রমে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে মদ ভাগ করে খাবার দৃশ্যে আবার সেই ঘুর্ণন। শট কাউন্টার শটে একটাই দৃশ্য দেখানো হয় হয় যে দৃশ্যে কর্তৃপক্ষীয় আদেশের কথা শোনা যায় ক্যাপ্টেনের সঙ্গে চক্রান্তের দৃশ্যে। মদের দোকানে অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে প্রায় দশ মিনিট লম্বা নাচের একটি দৃশ্য দেখা যায়। বিশেষত এই দৃশ্যটি মনে পড়ায় ডাচ চিত্রশিল্পী পিটার ব্রুগল-এর চিত্রপটের কথা। যদিও ব্রুগলের চিত্রপটসম বহুবর্ণবিচিত্রতার ছটার এক ছটাকও উপস্থিত নেই এখানে; কিন্তু কম্পোজিশনগত ছান্দিক আবহ এই প্রতিতুলনার দিকে আকর্ষণ করে। জানলা, দরজা, দেওয়াল—এই ছবিতে মোটিফের মতো ফিরে ফিরে আসে। প্রচলিত অর্থে, ধীর চলচ্চিত্র (স্লো সিনেমা) আঙ্গিকের এই ছবিতে এমন কালখণ্ড আসে যাকে ডেড টাইম বা নিষ্ক্রিয় কাল হিসেবে পড়া যায়, অথচ তার দু’পাশে এমন কালখণ্ডও জুড়ে থাকে না যার অবর্তমানে মূল আখ্যানের ভয়ানক কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে। ধরণ বিষয়ক তর্কের দিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যায়, ক্যামেরা এই ছবিতে যে পরিমাণ সচল থাকে তা ধৈর্যশীল নিষ্পলক অবলোকনের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে পারে কিন্তু যা মোটেই মূলগত স্থিতিশীলতার প্রেক্ষিতে অচঞ্চল বা ট্যাবলোপন্থী নয়। 

আরও পড়ুন
বুঁমিকাকার জন্মগুলো

মিহলি ভিগ-এর করা সঙ্গীত এ ছবির মূল চরিত্র। অ্যাকর্ডিয়নের বিভিন্ন চাবিতে একইসঙ্গে চাপ দেওয়ায় একইসঙ্গে অনেকগুলো স্বর শ্রুত হয় যা সাঙ্গীতিক ক্যাকোফনি তৈরি করে একঘেয়েমির বাস্তুতন্ত্রে একঘেয়ে যাপনের বহুঘেয়ে স্বরের মূর্তরূপ হয়ে বিচ্ছুরিত হয় ক্রমক্ষয়িষ্ণু এক সমাজের বিষাদগাথায়। এটাই এই ছবির মূল রাজনৈতিক প্রস্তাবনা। ভিগ এ-ছবির সঙ্গীত নির্দেশকও বটে। টারের অ্যালম্যানক অফ ফল (১৯৮৪) থেকে শুরু করে ট্যুরিন হর্স (২০১১) পর্যন্ত ছবির সঙ্গীত পরিচালকও তিনিই। প্রসঙ্গত টারের ঠিক এর পরের ছবির নামের মধ্যেই আছে সুরছন্দের তাত্ত্বিক মূর্ছনা। ওয়েকমেস্টার হারমোনিজ (২০০০)-এ সমাজ আর ক্ষমতাধরদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সাঙ্গীতিক আটোনালিটির যুক্তিতে বহমান থাকে। সেটানট্যাঙ্গো-য় পেশাদার অভিনেতাদের পাশাপাশি শখের অভিনেতারাও অভিনয় করেছেন। আবহকণ্ঠে যে কথকের কথন আমরা শুনি, এমনকি তিনিও পেশাদার অভিনেতা নন। সে কারণেই এক জাতীয় বাস্তববাদকে মনে পড়ায় এ ছবি। কিন্তু আধিবিদ্যক পন্থাও অনুসৃত হয় এখানে। বি-নাটকীকরণ বা ডি-ড্রামাটাইজেশন এই ছবির অন্যতম শর্ত হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

এক সাক্ষাৎকারে বেলা টার বলেছিলেন— “আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা নই। আমি চলচ্চিত্র শিল্পের (ইন্ডাস্ট্রি) অংশ নই। আমি শুধুই একজন মানুষ। আমি নিজে কীভাবে পৃথিবীটাকে দেখি সেটা দেখানোর একটা যন্ত্র, আমার কাছে, ক্যামেরা।”

Powered by Froala Editor