ছায়াছবি-কথা – ১১
আগের পর্বে
শাই মিং লিয়াং। তাইওয়ানের এই চলচ্চিত্র পরিচালকের দশম ছবি ‘স্ট্রে ডগজ’। গৃহহীন এক পরিবারের দৈনন্দিনের আখ্যান সেখানে রচনা করেন লিয়াং। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত নাটকীয়তাহীন শট দিয়েই নির্মিত এই চলচ্চিত্র। ক্যামেরাও স্থির কোনো এক জায়গায়। তার ফ্রেমে ধরা পড়ে তাৎক্ষণিকতা। পরিত্যক্ত যে বাড়ির মধ্যে এই গৃহহীন পরিবারের বাস, তার চাতালেই থাকে একদল রাস্তার কুকুর। তাদের খাওয়ান গৃহহীনদের মা। এই সহানুভূতিশীল আঙ্গিকের মধ্যে দিয়েই লিয়াং ধরতে চান তাইওয়ানের সমাজ-রাজনীতি-বর্তমান অবস্থার ছবি। গড়ে তুলতে চান এক বাস্তব উপাখ্যান।
দু’দিন বাদেই সংসদীয় নির্বাচন। কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি, স্থানীয় রাজনৈতিক দলসহ সমস্ত রাজনৈতিক দলের শেষ বেলার প্রচার চলছে। মিছিলে, স্লোগানে, পতাকায়, হোর্ডিঙে একেবারে সরগরম রাস্তাঘাট। এমন সময়ে রাস্তার পাশের ঝোপে চটজলদি মদ খেতে খেতে ঠিক হয়ে যায় ভোটের ছুটির দিনে নিরিবিলিতে সারাদিন মদ-চড়ুইভাতির জায়গা।
সানাল কুমার শশিধরণ পরিচালিত অ্যান অফ-ডে গেম (২০১৫) তাঁর দ্বিতীয় পূর্ণ দৈর্ঘের কাহিনিচিত্র। তাঁর প্রথম ছবির বিমূর্ত দার্শনিকতা এ ছবিতে অনুপস্থিত। তবে সম্ভাবনা ও কাকতালীয়তার জটিলতা এ ছবিতেও আছে পর্যাপ্ত পরিমাণেই।
পাঁচ বন্ধু গাড়ি নিয়ে জল-গাছপালায় ঘেরা নির্জন অতিথিশালায় চলে আসে, ড্রোন শটে। সঙ্গে প্রয়োজনমতো মদ এবং মাংস। রাঁধার দায়িত্ব স্থানীয় এক মহিলার। ও! আমরা তো ধরেই নিয়েছি যে, নির্জনে মদ-ফুর্তি করতে আসা বন্ধুরা অবশ্যই পুরুষ! হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছি, প্রত্যেকেই মধ্যবয়স্ক পুরুষ। হ্যাঁ এটাও ঠিক যে, এই পুরুষদের বেশীরভাগই ঐ মহিলার পেছনে ছোঁকছোঁক করে। এছাড়া মদ খায়, সাঁতার কাটে; এমনকি নির্বাচনী গণতন্ত্র কি ইন্দিরার জরুরি অবস্থা অথবা পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা করে। আবার ঝগড়াও করে। কিন্তু সবই ‘নিজেদের মধ্যে’। তেমন তেমন দরকারে গাছে উঠতে বা মুরগি কাটতে হলে, ছবির এক চরিত্র-- দাসা। দাসার চামড়ার রঙ গাঢ়(তর)।
উন্নি আর (পি জয়চন্দ্রন)-এর লেখা ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি এই ছবি মোটের ওপর বাস্তববাদী আঙ্গিকেই নির্মিত। রাজনৈতিক স্যাটায়ার না বলে এ ছবিকে বলা যাক সামাজিক/সমাজ-রাজনৈতিক শ্লেষাত্মক চলচ্চিত্র। এ ছবি নিজেদের দিকে তাকানোর আহ্বান জানায়। মোট ৭০-টা শট দিয়ে বানানো এই ছবিটা তোলার সময়ে হাতে লেখা তেমন কোনো স্ক্রিপ্ট ছিল না। ১০৬ মিনিট লম্বা এই ছবির ঠিক মাঝখান অর্থাৎ ৫৩ মিনিট পর্যন্ত ৬৯-টা শট। বাকি ৫৩ মিনিট একটাই মাত্র হাতে-নেওয়া শটে। বোঝাই যাচ্ছে যে, ইন্দ্রজিত এস-এর ক্যামেরা গোটা ছবিটায় দু’রকম ছন্দে/শৈলীতে কাজ করে। এখানে প্রকৃতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য তেমন অর্থপূর্ণভাবে আসে না। বরং জলের, গাছপালার ঈষৎ দীর্ঘ শট ছবির দৈর্ঘের অঙ্ক মেলানোর জন্য রাখা বলে মনে হয়।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দাসা-- ‘কালো’। অথচ যারা “জন্মের সময়ে গোলাপি, বড় হওয়ার সময়ে সাদা, শরীর খারাপে নীল, মৃত্যুর সময়ে বাদামী”-- তারাই দাসাদের কালর্ড/পিপল অফ কালর বলে। এবং সেই দাবিতেই নেহাত খেলতে খেলতে সন্ধ্যের মুখে জাস্ট মেরে ফেলা যায় দাসাকে, ঠিক যেভাবে কাটতে অস্বস্তি পেয়ে মুরগিটাকে গাছের ডালে সকালবেলা লটকে দিয়েছিল দাসা স্বয়ং।
আরও পড়ুন
নেড়ি কুত্তা
উৎসব। (হিন্দু) ধর্মীয় উৎসব। অনেকটা বাংলার গাজনের মতো। চেন্দা (দক্ষিণ ভারতীয় ঢোল) ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র তারস্বরে বাজছে। প্রচুর মানুষের ঢল রাস্তায়, প্যান্ডেলে, মন্দিরের উঠোনে। বাণ-ফোঁড়া চলছে। পুরুষদের কপালে, গালে, পিঠে, পায়ে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে লোহার শিক। বস্তুগত ভয় পরিণত হচ্ছে ‘ঐশ্বরিক’ ভরে। বিগ্রহের লরির সামনে ক্রেনে করে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দুটো মানব শরীর। তাদের পিঠ, কোমর, পা শিকে গাঁথা। জনতা আনন্দে মাতোয়ারা। মোবাইলে ছবি তুলছে সবাই।
আগের ছবির মতো এ ছবিও এক্কেবারে তথ্যচিত্রের ঢঙে শুরু হয়। হয়ে, উৎসবের আবহে দুপুর গড়িয়ে রাত হয়। বেশি রাতের দিকে কেরালার কোনো এক শুনশান রাস্তায় একজন মহিলা আর তার পুরুষ-বন্ধু প্রচণ্ড তাড়াহুড়োয় রেলস্টেশন যেতে চাইছেন। একটা মারুতি ভ্যান থামে। তারা ওঠেন। এরপর যে ভয়টা ‘স্বাভাবিকভাবেই’ আমরা পাই সেদিকেই এগোতে থাকে ঘটনা। প্রতাপ জোসেফের ক্যামেরা সাধারণ লভ্য আলোয় গাড়ির ভেতর দেখে। শুনশান রাস্তাঘাট দেখে। ‘টিজিং’ দেখে। উত্যক্ত হওয়ার ভয় দেখে। গাড়ি, গাড়ির আলো, গাড়ির গতি, গতিময়তার শব্দ ভয়ের আবহ তৈরী করে রাখে।
আরও পড়ুন
নয়নসুখ
সানাল কুমার শশিধরণ পরিচালিত তৃতীয় পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি এটি। মালায়লী এই ছবির নামকরণ করা হয়েছিল সেক্সি দুর্গা। কিন্তু ভারতে সেন্সর পেতে ছেঁটেকেটে ছবির নাম হয়েছিল-- এস দুর্গা (২০১৭)। যে ভয়গুলো পেতে পেতে, যে ভয়-পাওয়াগুলো আমাদের যে মনের কাছে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, সেই মনগুলোর জন্য এই ছবি। আমাদের সেই ভয়-পাওয়া-মনগুলোই ছবিটার চালিকা শক্তি।
নানা ধরণের ‘ইন্টারোগেশনের’ মধ্যে দিয়ে আমরা জানতে পারি-- স্বামীর নাম কবীর, স্ত্রীর-- দুর্গা। অর্থাৎ, ‘অসবর্ণ’ সম্পর্ক শুধু নয়; অর্থাৎ, লাভ জিহাদ! দুর্গাকে কি তবে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! রাত-রাস্তার চরিত্রদের মধ্যে এরা ভয়ানক একা। যাদেরকে কেন্দ্রে রেখে ছবি এগোয় তাদের মুখে সংলাপ প্রায় নেই বললেই চলে। অন্য চরিত্রদের সংলাপ এদের অসহায় অবস্থাকে বাঙ্ময় করে তোলে। আলেয়ার মতো, নিয়তির হাতছানির মতো তারা হাত ছাড়িয়ে পালালেও আবার সেই গাড়িতেই চ’ড়ে বসতে বাধ্য হয়। একবার নয়। একাধিকবার। অনিবার্য সমাপতনের মতো। অন্য যে কোনো গাড়িতেই তারা চড়ত, সেখানেই তাদের জন্য অপেক্ষা করত একই ভয়াবহতা-- এমন দ্যোতনাই ভেসে আসে যেনবা। গাড়ির স্টিয়ারিং-এর পাশে দুর্গার মূর্তি। দুর্গা আবার উত্তর ভারতীয়। ‘উপরন্তু’ মালায়লম ভাষা জানেনা দুর্গা। ভাষা-ধর্ম-লিঙ্গভিত্তিক অপরায়ণের বাস্তব, তারমানে, শুধু গোবলয়েরই একচেটিয়া নয়! দক্ষিণ যেন উত্তরের ভাষায় কথা বলতে থাকে, আমাদের গতানুগতিক প্রগতিশীল চোখে। এই অপরায়ণকে আমরা প্রাথমিক পাঠে ভূমিকা বদল (রোল রিভার্সাল) হিসেবে পড়ি।
এক অর্থে রোড ফিল্ম বলা যায় একে। গতানুগতিক থ্রিলার-ধরণের ঘটনা না ঘটলেও আবহাওয়ায় থাকে সাসপেন্স থ্রিলারের গন্ধ। ‘টানটান উত্তেজনা’। আমরা শারীর-মানসিক যৌন-নিগ্রহ প্রত্যক্ষ করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। শুধু সমাজ না, ভয় দেখানোর চোখ নিয়ে রাষ্ট্রও আসে পুলিশের বেশে। ওদিকে উৎসবের রাতে আগুন-খেলা শুরু হয়। জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে দৌড়ে চলে ধর্মভীরু পুরুষ-পায়েরা। অগ্নীপরীক্ষারত সীতার ভূমিকা বদল! ভূমিকা বদলের খেলায় মেতে দুর্গা আর কবীরকে রক্তখেকো রাক্ষসের মুখোশ পরান পরিচালক। পিশাচায়ন ঘটান তাদের! আজ যারা ভীতের চরিত্রে তাদের মুখেও ভীতিপ্রদর্শনকারীর রক্ত লেগে আছে! অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে এগুলোর কোনোটাই ভূমিকা বদল নয়! একটা অনিরাপদ সমাজ-পরিসরের একটা গভীর রাত মূল চরিত্রে অভিনয় ক’রে চলে। নাহ, ধর্ষণ হয় না। সমাজ-রাষ্ট্রিক মান্য অর্থে শ্লীলতাহানিও হয় না। শুধু ধর্ষণের, ধর্ষিত হওয়ার বোধ তাড়া করে। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানিতেই একমাত্র হিংস্রতা থাকে না। অনেক বেশি হিংস্র, নৃশংস হতে পারে এই ‘ভয় দেখানোর খেলা’; এই কুঁকড়ে রাখার খেলা। সে খেলা নির্মিত হয় ক্ষমতা প্রয়োগে প্রান্তিকায়িত করার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দিয়ে। ক্ষমতাখেলার চরিত্রদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে তাঁকে আশ্রয় নিতে হয় না ক্লোজ শটের। তাঁর ক্যামেরা দেখে এক সহজ দূরত্ব থেকে। এই অবস্থানটুকুই বলিষ্ঠ সাবলীলতায় আখ্যায়িত করে সমকালের বাস্তবতাকে।
আরও পড়ুন
সায়াৎ নোভা অথবা রক্তবীজের রং
এই দুটো ছবিতেই বাস্তব আর কল্পকাহিনীকে অবলীলায় মিলিয়েমিশিয়ে দেন শশিধরণ। ধর্মীয় আচার, (পার্টি)-রাজনৈতিক আচারের ভেতর যে হিংস্রতা থাকে, তাই চাড়িয়ে যায় সমাজের মূলে। এই হিংস্রতাকে কোনো একটা বা দু’টো বা তিনটে স্থান-কাল-পাত্রীর নির্দিষ্ট, বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে পড়ে লাভ নেই আর। রাঁধুনি সেই মহিলাও কি আসলে ধর্ষিত হলেন না, হন না! দাসা ‘কালো’ না হয়ে ‘প্রতিবন্ধী’ বা ‘সমকামী’ হলেও কি অন্য কোনোভাবে ‘মরতে’ হতো না তাকে! এ এক স্থায়ী হিংস্রতা (পার্পেচুয়াল ভায়োলেন্স), যা অনেক ক্ষেত্রেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে প্রকট হয় না। তবে দাসার হত্যা অবশ্য এ ভাবনাতলে, কিছুটা হলেও, ব্যতিক্রম। হত আর হন্তারকের সমীকরণে জাতপাতগত নির্দেশ্যবাদীতা চৈতন্যের উৎক্রমণের সূক্ষ্ম প্রশ্নে বাধাই হয়তো বা।
এত সহজতায় ক্ষমতার জটিল আখ্যান নির্মাণ করতে পারেন শশিধরণ, সম্ভবত তার ইম্প্রোভাইজেশনের স্বকীয়তার জন্যই। আখ্যানের মধ্যে (হঠাৎ) একটা লম্বা ইম্প্রোভাইজড শট মূলত অ-পেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে এমনভাবে করিয়ে নেন তিনি যাতে বাস্তবের ছোঁয়া, বাস্তবতার আভাস জীবন-অভিজ্ঞতার সমানুপাতিক হয়ে পড়ে। এই চলচ্চিত্রীয় অভিজ্ঞতা দিতে আঁকাড়া নান্দনিকতায় একটা মাত্র দুপুরের গল্প কী একটা মাত্র রাতের গল্প যেভাবে বেছে নেন তিনি, বোঝা যায় যে তিনি অসম্ভবের সাধনায় আছেন। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যেখানে চলচ্চিত্র উৎসব সমিতিও তাঁকে সেন্সরের শংসাপত্র দাখিল করতে বলেন।
আরও পড়ুন
গমক ঘর
ব্রাহ্মণ্যবাদ, পিতৃতন্ত্র থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের বর্তমান অনুশীলনকে এই তীক্ষ্ণ সাবলীলতায় শৈল্পিক-সমালোচনা করা সানাল কুমার শশিধরণ কলেজ জীবনে আইন পড়তে গিয়ে যুক্ত ছিলেন চূড়ান্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী, পিতৃতান্ত্রিক এবিভিপি-র রাজনীতির সঙ্গে।
Powered by Froala Editor