দরজার কোণে লুকিয়ে থাকা ক্যাকটাসেই ঘায়েল ডাকাত, শখ বাঁচিয়েছিল গোটা পরিবারকে

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে - ৬

আগের পর্বে

বাসন্তী রায় অর্থাৎ বাসুপিসি। নিমডিতে লোকসেবায়তন আশ্রম তৈরি তাঁর হাতেই। পাকা ছাদ নেই, খড়ের ছাউনির ছোট্ট আশ্রম। সেই আশ্রমে কোনো পাঁচিল নেই। নেই কোনো বেড়া। দু’দিকে রেললাইন, একদিকে নদী আর একদিকে টাটা-পুরুলিয়া ষ্টেশন, হাইরোড ঘিরে রেখেছে সেই আশ্রমের প্রাঙ্গণকে। সেই বাসুপিসি গান্ধীজির সংস্পর্শ পেয়েছিলেন। তাঁর ছিলেন গান্ধীজির প্রিয়পাত্র। নিমডির আশ্রমেও তিনি প্রচলন করেছিলেন কাপড় বোনা, সুতো কাটার চল। একসময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন আন্দোলনে। স্বাধীনতার পরও ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের সময় বাংলাভাষার জন্য নেমেছিলেন ময়দানে। ইতিহাসেও অনুল্লিখিত রয়ে গেছে সেই অধ্যায়।

দেবীজ্যেঠুর কথা উঠলে প্রথমেই যা মনে পড়ে তা হল মার্টিন রেল। হাওড়া থেকে ছেড়ে (যদিও স্টেশানটির নাম ছিল হাওড়া ময়দান) সেই ছোট্ট রেলগাড়ি ঝুকঝুক করে দাশনগর, বালটিকুরি, বাঁকড়া, শলপ, কাঁটালিয়া, মাকড়দা, ডোমজুড়, দক্ষিণবাড়ি, বড়গাছিয়া হয়ে আমতা যেত। বড়গাছিয়া থেকে ভাগ হয়ে আরেকটি লাইন যেত হুগলির চাঁপাডাঙ্গায়। জগৎ বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ও বাঙালি শিল্পপতি স্যার রাজেন মুখার্জী ছিলেন সেই মার্টিন রেল-এর মালিক। বন্ধ হয়ে উঠে যাবার এত বছর পরও অনেক জায়গাতেই স্টেশানের নাম লেখা সেই কংক্রিটের বোর্ডগুলি আজও রয়ে গেছে। সম্ভবত লাইনটি মিটার নয়, ন্যারো গেজই ছিল। ঐ ট্রেনেই আমার প্রথমবার মাকড়দহ বা মাকড়দায় যাওয়া, দেবীজ্যেঠুদের বাড়িতে - বাবা ও শচীনকাকুর সঙ্গে।

যদিও স্থানীয় লোকেরা অপয়া ধারণায় ঐ নাম মুখে আনতেন না। টিকিট কাউন্টারে বলতেন ‘একটা লণ্ডনের টিকিট দিন।’ পেয়েও যেতেন। মাকড়দা স্টেশন থেকে দেবীজ্যেঠুদের বাড়ি আধ কিলোমিটারেরও কিছু বেশি রাস্তা।
দেবীজ্যেঠুর পুরো নাম দেবীদাস চৌধুরী। বাড়ির লাগোয়া দুর্গাদালানে পৌনে চারশো বছরের পুজো। এখন যদিও বারোয়ারি, কিন্তু সংকল্প আজও হয় চৌধুরীদের নামে। রাস্তা থেকে বেশ উঁচুতে সামনের বাগান। সেখান থেকেও গোটা ছয়েক সিঁড়ি ভেঙে বাড়িতে ঢুকতে হয়। প্রথমেই একচালা টালিতে ঢাকা এক বড় বারান্দা। এরপর বড় বসার ঘর পার করলে বাড়ির অন্দরমহল— সবই পাকা বাড়ি। তিরিশ ইঞ্চির দেওয়াল আর শাজাহানী ইটে গাঁথা, কড়ি বরগা দেওয়া পাকা ছাদ। ভিতরে উঠোন, ছাদে যাবার সিঁড়ি, পিছনে বাগান, বিরাট খিড়কি পুকুর, তার শানবাঁধানো ঘাট। পুকুরের পাড় বরাবর অনেক নারকেল গাছ। বাগানে আম, কাঠাঁল গাছও বহু। তবে বাড়ির সামনের বাগানটিতে শুধুই কণ্টকপর্ণী। যে সময়ের কথা বলছি তখন ঐটিই ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ক্যাকটাস ও সাকুলেন্ট সংগ্রহ। 

বনেদি বাড়িতে জন্ম ও পরিশীলন। তারপর সেই সময়ের আগুনে ট্রেড ইউনিয়নের আঁচে পোড় খাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর পেশাদার হিসাবে ক্যাকটাস চর্চায় নেমে পড়া দেবীদাস চৌধুরী ছিলেন এবং এখনও আছেন, ভীষণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। অন্যথায় সাধারণ দর্শন এই বাঙালির চোখ দুটি অসম্ভব উজ্জ্বল ও কৌতূকপূর্ণ।
সত্যিই অদ্ভুত ‘সেন্স অফ হিউমার’ মানুষটার। মাকড়দা স্টেশানের একটু আগে মাকড়দা বাজার থেকে যে বড় রাস্তাটি অঙ্কুরহাটি মোড়ে বোম্বে রোডে গিয়ে উঠছে, সেই রাস্তায় প্রথমেই পড়ে মা মাকড়চণ্ডীর মন্দির, তারপর মাকড়দহ হাইস্কুল, তারপর সিনেমা হল ‘চণ্ডীরূপা’ এবং তারও পর মাকড়দহ শ্মশান। দেবীজ্যেঠু বলতেন, “আমাদের জীবন একেবারে ধাপে ধাপে সাজানো আছে— প্রথমে দেবালয়, তারপর বিদ্যালয়, তারপর রঙ্গালয় এবং সবশেষে যমালয়।”

প্রধানত রোববার সকালগুলো বাঁধা ছিল ওঁর বাগানে যাওয়ার। ন’টা-শোয়া ন’টায় পৌঁছোতাম। পৌঁছনো মাত্র জ্যেঠিমা একটা কাঁসার বড় জামবাটিতে এক বাটি মুড়ি দিয়ে যেতেন নারকোল কোরা আর চিনি দিয়ে। সঙ্গে এক গ্লাস জল। সে মুড়ির প্রধান আকর্ষণ ছিল তার নারকোল, মুড়ি ও চিনির অনুপাত— যা হত একদম সমান। একটু পরেই এক বড় পেয়ালা দুধ চা। কতই বা বয়স হবে? বছর ষোল। বড়দের সঙ্গে বসে চা খেতে বেশ সম্মানিত বোধ করতাম।
বাড়ি ফেরার সময় জ্যেঠু প্রত্যেকদিন একটি নতুন প্রজাতির ক্যাকটাস অথবা সাকুলেন্টের চারা অবশ্যই আমাকে দিতেন। অনেক সময় জোর করেই। আমার জন্য এটি তাঁর নিয়ম ছিল। 

আরও পড়ুন
ভাষা বাঁচাতে সুদূর মানভূম থেকে হেঁটে কলকাতায় এলেন বাঙালিরা, নেতৃত্বে বাসন্তী রায়ও

এসবের বছর ছয়েক পরের কথা। ১৯৮২ সাল। বড়গাছিয়া ব্রডগেজ রেললাইন পাতার জন্য মাটি পড়েছে ঝালোয়ার বেড় থেকে ডোমজুড় পর্যন্ত, মাকড়দা চৌধুরিপাড়ার মধ্যে দিয়ে। মাটির সে পথ আড়াআড়ি পার করলেই চৌধুরিদের দুর্গামণ্ডপ এবং তাদের বাড়ি। সে বাড়ির সামনের বাগানে তখন দেশের সেরা ক্যাকটাস ও সাকুলেন্ট সংগ্রহ। মাটি লেভেল করা হয়ে গেছে। দুটো বর্ষায় আরেকটু বসে গেলেই পাথর ফেলা হবে। তারপর রেলপথ। পাড়ার ছোটরা সেখানে তখন পিট্টু আর ডাংগুলি খেলে।
সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি, জামশেদপুরে। ‘ক্যালডাইন প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে এক ছোট্ট অ্যালয় স্টিল ফাউন্ড্রিতে। পদ, ফাউন্ড্রি সুপারভাইজার। সারা সপ্তাহ মর্নিং এবং ইভনিং দুই শিফ্‌টে কাজ করি। শনিবার মর্নিং করে কোনো সপ্তাহে লোকাল ডি.এম.ইউ. ট্রেন ধরে দেশের বাড়ি বরাভূমে যাই। আবার কোনো সপ্তাহে উত্তরপাড়া ফিরি। যেখানেই যাই সোমবার ২টোর মধ্যে ফিরে ইভনিং শিফ্‌ট ধরতে হয়।
মাকড়দহে দেবীজ্যেঠু তখন বীজ থেকে চারা করা ছাড়াও গ্রাফ্ট করে খুব দ্রুত বাড়াবার চেষ্টা করছেন তাঁর ইতিমধ্যেই লোভনীয় সংগ্রহ। 

আরও পড়ুন
বাঁশের তীর-ধনুক নিয়েই নামলেন প্রতিযোগিতায়, হারিয়ে দিলেন ‘আধুনিক’ শিষ্যকে

দাবি করেছিলেন ‘আলো, গ্রাফ্টিং করার জন্য সিরাস নোবিলিস খুব ভালো স্টক। তুমি তো জামশেদপুর, বলরামপুর, কলকাতা করছো, আমাকে কিছু এনে দাও না!’ কথাটা মাথাতে ছিলই তাই দেশের বাড়ির বাগান থেকে বেশ মোটাসোটা দেখে কয়েকটা সিরাস নোবিলিস তুলে নিয়ে এক সপ্তাহান্তে হাজির হই মাকড়দহে - দেবীজ্যেঠুর বাড়ি। চটের মোটা থলিতে ভরে সে কাঁটাগাছ বহু কষ্টে, অনেক ভালোবাসায় নিয়ে আসা অতদূর থেকে। নামিয়ে রাখি কোথায়? ছ’টি সিঁড়ি ভেঙে বৈঠকখানা।
ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে জ্যেঠুকে হেঁকে জিজ্ঞেস করি, থলিটা রাখব কোথায়। অ্যাস্ট্রোফাইটাম অ্যাস্টারিস-এর চারাগাছে রিভার্স ওয়াটারিঙে ব্যস্ত জ্যেঠু উঠে আসতে পারেন না। চেঁচিয়ে বলেন ‘দরজার বাইরে বাঁদিক করে রেখে দে বাবা, আমি আসছি।’ তাঁর কথা মতো সেখানেই রেখে দি। বাকি সকলের সঙ্গে দেখা করে, গল্পগুজব করে বিকেলে ফিরেও আসি বাড়ি। 

আরও পড়ুন
ভারতের তীরন্দাজিকে বদলে দিয়েছিলেন চন্দননগরের যজ্ঞেশ্বর ঘোষ

 পরের দিন একদম সকালবেলায় আমাদের বাড়িতে জ্যেঠুর চিঠি নিয়ে লোক হাজির। সাল ১৯৮২। মোবাইল তো দূরস্থান ল্যান্ডলাইনও নেই সব বাড়িতে। কাজেই জরুরি দরকারে লোকের হাতে চিঠি পাঠানোই দ্রুততম ‘সন্দেশ’।
সুদীর্ঘ সেই চিঠি পড়ে যা জানা গেল তা অনেকটা এই রকম : গতকাল বিকেলে আমি ফিরে আসার পর সন্ধে এবং রাতের কাজকম্ম মিটিয়ে খাওয়াদাওয়া করে ওঁরা শুয়েও পড়েছিলেন সময় মতো।
মাকড়দায় তখন পঞ্চমদোলের মেলা চলছে। চলছে যাত্রাও সে রাত্রে। রাত শোয়া এগারোটায় হঠাৎ লোডশেডিং হয় এবং সাড়ে এগারোটা নাগাদ খিড়কি দরজা দিয়ে ঢোকে তারা। বলে ‘দরজা খোলো! আমরা থানা থেকে আসছি।’

আরও পড়ুন
কলকাতা তাঁকে ডাকে বব্‌, নিগ্রো ইত্যাদি নামে; ভয়ে, ভক্তিতে, কখনও ভালোবাসায়

জ্যেঠু ততক্ষণে বুঝেই গেছেন যে এরা ডাকাত এবং খুলে না দিলে দরজা ভেঙে ঢুকবে। উনি দরজা খোলার আগে কেবল বলেন ‘দ্যাখো বাবা দরজা খুলে দিচ্ছি, ঘরের যাবতীয় জিনিস নিয়ে যাও শুধু বাড়ির লোকদের মারধর করো না।’
ঘরে ঢুকেই তারা বাড়ির সকলকে একটা ঘরে নিয়ে আটকে দেয় এবং দুজন পাহারায় থাকে সেখানে। আর দুজন পাহারায় দাঁড়ায় সদর দরজার বাইরে। বাকিরা যথেচ্ছ লুট চালায় সারা বাড়ি জুড়ে। মেয়েদের গায়ের গয়নাও বাদ যায় না। বোনের বিয়ে এগিয়ে এসেছিল তাই তার বিয়ের গয়নাও রাখা ছিল বাড়িতেই। কিন্তু সেসব একটি পোঁটলা করা অবস্থায় দেয়াল আলমারির নিচের তাকে এক কোণে পড়েছিল বলে কারুর চোখে পড়েনি। 

একই সময়ে লুঠ চলছিল চৌধুরীপাড়ার আরো আট-দশটি বাড়িতে। আশিজনের দল হেঁটে ডাকাতি করতে এসেছে। যাদের একটা বড় অংশ ঘিরে রেখেছিল অনেকটা অঞ্চল। পরে জানা যায় তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল চৌধুরীপাড়াকে শিক্ষা দেওয়া। কারণ এর আগে চৌধুরীপাড়ার ডিফেন্স পার্টি পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল তাদের সর্দার, সে সময়ে হাওড়ার ত্রাস নিমাই মোসেলকে।
এইসব যখন চলছে তখন হঠাৎ করেই আবার কারেন্ট চলে আসে এবং সদর দরজায় পাহারায় থাকা দুজনের একজন কোনো কারণে সরতে গিয়ে অজান্তেই পা দিয়ে ফেলে কাঁটাভর্তি ক্যাকটাসের থলিতে। ব্যস! পায়ের তলায় তৎক্ষণাৎ নোবিলিস-এর শরশয্যা। ফলে চমকে গিয়ে হাত ফস্‌কে বোমা ভর্তি থলি সজোরে মাটিতে ঠুকে যায় এবং পরপর হতে থাকে বিস্ফোরণ। দরজায় দাঁড়ানো দু’জনই মারাত্মক জখম হয়। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হাত-পা।
ততক্ষণে যাত্রাস্থলেও ডাকাতির খবর পৌঁছে গিয়েছে এবং সেখানেও উদ্যোক্তারা ঘোষণা করছেন ‘চৌধুরীপাড়ায় ডাকাতি হচ্ছে, আপনারা তাড়াতাড়ি সেখানে যান।’

পালানো ছাড়া গতি নেই। তারা তাই করে। সঙ্গে করে নিয়ে যায় আহত সঙ্গীদেরও। পরে যাদের মধ্যে কয়েকজন মারাও যায়। ধরা পড়ে যায় অনেকেই।
এই হল সংবাদ। চিঠির শেষে জ্যেঠু জানিয়েছেন বাংলা খবরের কাগজগুলি বড় করে খবর করতে চায় এমন নাটকীয় ঘটনার। আমি উপলক্ষ হওয়ায় ওনারা আমার নাম দিতে চান - মত আছে কিনা?
বিনয়ের সঙ্গে না বলে দিই। ভাবি কৃতিত্ব যেটুকু সে তো সিরাস নোবিলিস-এর প্রাপ্য, আমার নয়। ঝড়ে কাক মরে আর…

Powered by Froala Editor