ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ৪
আগের পর্বে
যাকে আমরা তীর-ধনুক বলি, পুরুলিয়ার ভাষায় তা কাঁড়-বাঁশ। ছোট থেকে দুই ভাইয়ের হাতেই জুটেছিল কাঁড়বাঁশ। একবার পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়ি থেকে ফিরে এসে চোখে পড়ল খবরের কাগজে ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন। অর্জুন আর্চারি ক্লাব। যজ্ঞেশ্বর ঘোষ নামে এক ভদ্রলোক সেখানে তীরন্দাজি শেখাচ্ছেন। মাধ্যমিক মিটতেই সেখানে শিখতে যাওয়া। তখনও অবধি জাতীয় চার চ্যাম্পিয়নই তাঁর শিষ্য। সম্পর্ক গভীর হতে বোঝা গেল যজ্ঞেশ্বর জেঠু দিলখোলা একটা মানুষ। তবে সবথেকে আশ্চর্যের ছিল তাঁর আর্মারি। কী নেই সেখানে! সেই আর্মারি নিয়েই জেঠুর সঙ্গে সমস্যা বেঁধেছিল হুগলির ডিএমের। শেষ পর্যন্ত কোর্টে জিতেছিলেন জেঠুই।
দ্বিতীয় পর্ব
বলতে ভুল না হয়ে যায়, সে সময় ক্লাবে আমাদের সঙ্গে আরো দুজন বয়স্ক মানুষ প্র্যাকটিস করতেন। রোজ না হলেও সপ্তাহে একদিন করে তো নিশ্চয়ই। তাঁরা হলেন শিশির বিশ্বাস ও ধরবাবু। শিশিরদা চন্দননগরেরই বাসিন্দা, ছিলেন খুব নামী জিমন্যাস্ট। শখে আর্চারিতে। আর ধরবাবু ‘তাঁর পুরো নামটা কোনোদিনই জানা হলো না।’ আসতেন উত্তর কলকাতা থেকে। ছিলেন বেশ সুদর্শন, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা এবং সব সময়ই ধুতি পরতেন। ওঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল সোনার গয়নার ছাঁচ তৈরি করা।
ধনপতিদা- জেঠুর মেজছেলে, আমাদের গুরুভাই চাকরি করতেন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতেই। ইনফরমেশন অ্যান্ড অ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যুরো নামক দপ্তরে। সেন্টিনারি বিল্ডিংয়ের সপ্তম তলে অবস্থিত সে দপ্তরকে ডাকা হত মিসইনফরমেশন অ্যান্ড ডিসাপয়েন্টমেন্ট ব্যুরো নামে। সবার সম্মতিতেই। খুব ন্যায্য কারণেই পরে উঠে গেছে সে-দপ্তর।
পূর্ণিমাদি একটি হাইস্কুলে তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছেন। ভারতীদি এবং জয়ন্তীদি সম্ভবত কলেজে। ভারতীদির বাবা শ্রী বিরেশ্বর চক্রবর্তী ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী। নাড়ুয়ার বাড়িতে তাঁর তক্তপোশের নিচে ৪-৬টি ট্রাঙ্ক ভর্তি সশস্ত্র বিপ্লবীদের বাঁধানো ছবি। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুরও সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতার তিন দশক পর এঁদের নিয়েই তাঁর নিজস্ব পরিমণ্ডলটি গড়ে নিয়েছিলেন তিনি৷
আরও পড়ুন
বাঁশের তীর-ধনুক নিয়েই নামলেন প্রতিযোগিতায়, হারিয়ে দিলেন ‘আধুনিক’ শিষ্যকে
আর আমাদের শুভেন্দুদা( চক্রবর্তী) ছিলেন ফিজিক্সে ডক্টরেট এবং খন্যানের ইটাচুনা কলেজের প্রফেসর। তবে আমাদের সঙ্গে তাঁর হাসিখুশি মেলামেশায় বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকে কখনো ঐদিকটি বেরিয়ে আসত না। আমি তখন একাদশে (বিজ্ঞান শাখা)। একদিন একটি ছেলেমানুষি প্রশ্ন করে ফেলেছিলাম শুভেন্দুদাকে।
‘আপনারা চন্দননগরে জায়গাগুলোর নাম এমন বাগবাজার, পোস্তা, বড়বাজার, স্ট্র্যান্ড দিয়েছেন কেন? শুনলেই মনে হয় কলকাতাকে নকল করে।’
আরও পড়ুন
ভারতের তীরন্দাজিকে বদলে দিয়েছিলেন চন্দননগরের যজ্ঞেশ্বর ঘোষ
হয়তো অসন্তুষ্টই হয়েছিলেন। কিন্তু খুব সংযত উত্তরে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা গৈরিক, আগে কে এসেছিল ক্লাইভ না দুপ্লে?’ আমার পক্ষে এটুকুই যথেষ্ট ছিল।
সব মানুষেরই নিজের শহরের প্রতি ভালবাসা একটু থাকেই। তবে চন্দননগরবাসীর এটা একটু বেশিই ছিল এবং আছেও৷ আর থাকবে নাই বা কেন! ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে রয়েছে স্ট্র্যান্ড, আঁলিয়াস ফ্রঁস, চন্দননগর গভঃ কলেজ, পাতালবাড়ি, বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর বাড়ি, ফরাসডাঙ্গার শাড়ি, সূর্য মোদকের জলভরা সন্দেশ, চ্যাটার্জি আম। আরো দুটি জিনিসে অদ্ভুতভাবে আলাদা ছিল তারা। প্রথমত কলকাতা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে চন্দননগরই একমাত্র কর্পোরেশান ছিল, মিউনিসিপ্যালিটি নয়। আর তার জগদ্ধাত্রী পুজো। তাও ওই উচ্চতার৷ সারা রাজ্যে যখন কেবলই দুর্গাপুজো, এ শহরে তখনও জগদ্ধাত্রী পুজোই প্রধান উৎসব।একদিন দুদিনের নয়, পুরো সাতদিনের অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন
গালের ভিতর চামড়ার পকেট, চড় মারতেই বেরিয়ে এল সোনার চেন
ফ্রেঞ্চ লিগ্যাসি এ শহরকে আরো একটা জিনিস দিয়েছিল। আজ থেকে ৫০ বছর আগে যখন আমাদের শহরে ছেলেরাও সবাই সাইকেল চালাত না অথবা চালাতে জানত না - চন্দননগরের রাস্তাঘাট জুড়ে দাপিয়ে সাইকেল চালাত মেয়েরা। এমনকি অনেক সময়েই সামনের রডে বা পিছনের ক্যারিয়ারে দাদা অথবা ভাইকে চাপিয়ে৷
যাইহোক, ততদিনে জেঠুর কাছে শিখে অনেকেই নিজের শহরে নতুন ক্লাব তৈরি করেছেন আর্চারি বা তিরন্দাজি শেখানোর। তার মধ্যে শ্রী অসিত বিশ্বাস(আমাদের অতি প্রিয় অম্বুদা) ও শ্রী পরেশ মুখার্জি(পরেশদা) বরানগরে গোপেশ্বর দত্ত স্কুলমাঠে খুলেছেন ‘ক্যালকাটা আর্চারি ক্লাব’। দাশনগরে ‘দাশনগর আর্চারি ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছেন আমাদের চাঁদুদা (শ্রী চন্দ্রকান্ত দাস) কর্মবীর আলামোহন দাস তাঁর পিতা। এভাবেই মডার্ন আর্চারি তখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশে।
আরও পড়ুন
কলকাতা তাঁকে ডাকে বব্, নিগ্রো ইত্যাদি নামে; ভয়ে, ভক্তিতে, কখনও ভালোবাসায়
১৯৭৬-এর শেষ দিকে আমাদের ক্লাবে তিনটি ল্যামিনেটেড ফাইবারগ্লাসের ধনুক এল - যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ‘ব্ল্যাক উইডো’ কোম্পানির। আমাদের ক্লাবে সেই প্রথম বিদেশি ধনুক। ধনপতিদা, পূর্ণিমাদি ও শুভেন্দুদার। সে কী উদ্দীপনা আমাদের। ‘থ্রি পিস টেকডাউন’ ধনুক। খুলে ফেললে তিন টুকরো। কিন্তু জুড়ে ছিলা পরিয়ে হাতে তুলে দেখা গেল সে ধনুক অসম্ভব ভারী। জেঠু অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে বললেন, ‘আমাদের তো আর কিছু করার নেই, এত কাণ্ড করে বিদেশ থেকে আনানো ধনুক বদলানোও সম্ভব নয়। এখন একটাই রাস্তা, এই ভারী ধনুকের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তোমরা ব্যায়াম ও খাওয়াদাওয়া বাড়িয়ে শরীর তৈরি করো৷’ ব্যস সেদিন থেকেই দাদা দিদিরা লেগে পড়লেন পরবর্তী প্রকল্পে।
১৯৭৭ সালে এল আমাদের ধনুক, ‘বিয়ার সেভেন্টি সিক্সার’ - এ দুটিও ফাইবারগ্লাসের এবং টেকডাউন। তবে ল্যামিনেটেড নয়। আমরা রাজ্য পেরিয়ে সর্বভারতীয় স্তরেও খেলছি তখন। রাজ্য প্রতিযোগিতা তো ছিলই। আসলে আমাদের অজান্তেই তখন জমি তৈরি হয়ে যাচ্ছে লিম্বারাম, দোলা ব্যানার্জি, দিপীকা কুমারীদের আসার।
এবারে একটি ঘটনার কথায় আসবো যেটি বিবৃত করতে একটি ছদ্মনামের প্রয়োজন হবে। কারণ এ লেখায় ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ নয়।
ধরা যাক সে চরিত্রটির নাম তরুণকান্তি দত্ত। বড় এবং নামী তিরন্দাজ। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। অনেকদিন যাবত বিদেশি সেরা কোম্পানির ধনুক ও তীর ব্যবহার করেন। জাতীয় প্রতিযোগিতা জিতেছেন। জেঠুরও অন্যতম প্রিয় ছাত্র। জেঠু আদর করে তরুণকান্তিকে ডাকতেন টি.কে. বলে। সমস্যা কেবল একটিই - একটু হামবড়াই ভাব। ‘আমিই সব করেছি, বাকিরা কেউ কিছুই নয়’ এইরকম আর কি।
এমনই কোনো একটি কথা জেঠুর খারাপ লেগে যাওয়ায় তিনি বলেছিলেন ‘টি. কে., জিতেছ তুমি ঠিকই কিন্তু ভাল তীরধনুকের সুবিধেটাও পেয়েছ তুমি।’ অর্থাৎ তাঁর অন্যান্য ছাত্ররা সে সুবিধাটি পায়নি, যদিও যোগ্যতা তাদেরও কম ছিল না।
উত্তরে তরুণদা বলেন, ‘ওসব কথা ছাড়ুন যজ্ঞেশ্বরদা, ভালো বুট থাকলেই ভালো ফুটবলার হওয়া যায় না।’ জেঠু সে কথায় খুব আহত হয়েছিলেন। আসলে বিনয় বর্জিত হলে আত্মবিশ্বাসও ঔদ্ধত্যের মতোই শোনায়।
Between confidence and arrogance, there is a thin red line called humility.
পরের দিন থেকেই জেঠু নিজের বাঁশের ধনুক ও তীর নিয়ে আবার প্র্যাকটিসে আসতে শুরু করলেন এবং ক্লাবে সবার সামনেই ঘোষণা করে দিলেন ‘সামনের স্টেট মিটেই টি.কে. কে আমি হাইরে দোবো।’
পরবর্তী সাক্ষাতে টি. কে. কে বলেও দিলেন সে-কথা। মধ্যবর্তী প্রত্যেকটি সাক্ষাতে, হোক সেটি ক্লাব মিট অথবা ইনভিটেশনাল ম্যাচ - বলতেই থাকলেন একই কথা।
এরপর এসে পড়ল সেই বহু প্রতীক্ষিত রাজ্য প্রতিযোগিতা। কল্যাণীতে – সেবার। আমরা সময়ের আগেই পৌঁছে গিয়ে মাঠের একপাশে ওয়ার্ম আপ করছি। দেখি জেঠু হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছেন। এসেই আমাদের বললেন, ‘দাঁড়াও একটু টি.কে.-র সঙ্গে দেখা করে আসি।’ তারপর যথারীতি তরুণদাকে গিয়ে বলে এলেন ‘কী টি.কে.? ভালো করে প্র্যাকটিস করে এসেছ তো? আজ আমি এই বাঁশের ধনুক নিয়েই তোমাকে হাইরে দোবো।’
রাজ্য প্রতিযোগিতায় একান্ত ব্যক্তিগত টেনশন তো প্রত্যেকেরই থাকে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে গুরু-শিষ্যের দ্বৈরথ! আমাদের সবার মনেই তখন কী হয়? কী হয়?
তবে বাঁশের ধনুক ও কাঠের তীর নিয়ে প্রৌঢ় গুরু বিশ্বের সেরা ইকুইপমেন্ট নিয়ে লড়াইয়ে নামা তাঁরই শিষ্য ও আগের বছরের জাতীয় চ্যাম্পিয়ানের সঙ্গে কী ফল করবেন তাই নিয়ে প্রায় সবাই চিন্তায় ছিলাম(সন্দিহান বলব না)।
খেলা শেষ হয়ে স্কোর ডিক্লেয়ার হতেই সবাই অবাক!
রাঙ্কিংয়ে থাকা তো দূরস্থান – টি.কে. তালিকার একেবারে শেষ দিকে। কম্পিটিশান চলাকালীন টার্গেট প্যানিকে অধিকাংশ তীর বাইরে মেরেছেন। আর শুধু যজ্ঞেশ্বর ঘোষ নন, অনেক জুনিয়রও রাঙ্কিংয়ে ওঁর অনেক আগে।
এরপর প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশান। তারই গোছগাছ করছেন উদ্যোক্তারা। মাঠের একপাশে ক্লাবগুলি আলাদা আলাদা দাঁড়িয়ে নিজেদের ইকুইপমেন্ট গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় জেঠু আবার চললেন তরুণদার সঙ্গে দেখা করতে। এবার আমরাও যাই চুপিচুপি পিছনে।
শিষ্যকে ডেকে গুরু বলেন ‘বুঝলে টি.কে. তুমি ঠিকই বলেছিলে, ভালো বুট থাকলেই ভালো ফুটবলার হওয়া যায় না!’
Powered by Froala Editor