ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ৩
আগের পর্বে
সারা কলকাতায় যাঁর রাজত্ব, খোদ সেই মিতে জ্যেঠুর (ওরফে বব) পকেট মারতে গিয়েই ধরা পরেছিল এক বছর সতেরোর ছোকরা। বাবাকে অবাক করে দিয়েই মিতে জ্যেঠু দেখিয়েছিলেন দামি জিনিস লুকিয়ে রাখার জন্য মুখের ভেতরে এরা তৈরি করে রাখে চামড়ার পকেট। আলো আঁধারির সেই পাকা খিলাড়ি মিতে জ্যেঠুই একবার বেকায়দায় পড়েছিলেন গ্রামে। চাল কিনে ফেরার পথে ডাকাত ভেবে গ্রামবাসীরা ধেয়ে এসেছিলেন তাঁর দিকে। একটি গুলি চালিয়েও লাভ হয়নি। তারপর গণপ্রহার। পরে পুলিশ তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও বেঁচে যান তিনি। কারণ ওই রিভালভার পাওয়া গিয়েছিল অন্তত তাঁর থেকে ১০০ মিটার দূরে। কোনো শটপুট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হলেও যা অসম্ভব।
(প্রথম পর্ব)
পারিবারিক বন্দুক দুটো ছিল, একটা শটগান(অবশ্যই সিঙ্গল ব্যারেল) আরেকটি ডবল ব্যারেল টুয়েলভ বোর, বেলজিয়ান। ঠাকুরদা বিস্তর, বাবাও কিছু ব্যবহার করেছেন। সব সময়েই বিগ গেম হান্টিং নয়, কখনো কখনো বন-বরা তাড়াতেও।
সহজলভ্য না হলেও ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল বলেই বোধহয় বন্দুকে বেশি টান ছিল না আমাদের। অন্তত সেই বয়সে। অমোঘ আকর্ষণ ছিল ‘কাঁড়-বাঁশ’এ।
‘আইজ্ঞাঁ কাঁড়-বাঁশ বুঝলেন নাই? আপনারা যাকে তীর-ধনুক বলেন, উয়াকেই হামরা কাঁড়-বাঁশ বলি। পুরুল্যার বঠি ন!’
বোধহয় বছর ৭-৮ বয়েসেই নিজস্ব কাঁড়-বাঁশ পেয়ে যাই আমরা দু’ভাই। ভাই তখন আরো কিছুটা ছোটো। তেল মাখিয়ে রান্নাঘরে উনুনের পাশে রেখে সিজনিং করা। ছোটোদের জন্য একটু ছোট মাপেই বানানো। তবে একশো শতাংশ তীর-ধনুক। সেখানে ফাঁকি নেই। বাঁশের ধনুক, বাঁশেরই ছিলা। সঙ্গে দু’রকম তীর ‘পাটন’ ও ‘ঠুঁটি’। প্রথমে আমাদের পাটন দেওয়া হয়নি, কারণ সেগুলোর সামনে সূচালো লোহার ডগা। শুরু করতে হয়েছিল ভোঁতা মাথা ‘ঠুঁটি’ দিয়েই। পরে হাত পাকলে ‘পাটন’ পাই।
এখানে মনে রাখা যাক - সালটা ১৯৭৬। আর চার বছর পর ১৯৮০-র মস্কো অলিম্পিকে ভারত বহুবছর পর আবার সোনা জিতবে - হকিতে। সাত বছর পর ক্রিকেটে বিশ্বজয়ী হবে প্রুডেনশিয়াল কাপ জিতে। শচিনের বয়স মাত্র ৩। কলকাতায় নিক্কোপার্ক, ইকোপার্ক, মেট্রোরেল, নন্দন, বাংলা আকাদেমি কিচ্ছু তৈরি হয়নি তখনও। মহানগরীতে নেই একটাও ফ্লাইওভার। দ্বিতীয় হুগলি সেতুর হাওড়া প্রান্তে কাজীপাড়ায় শিবপুর দীনবন্ধু কলেজের মাঠটি দখল নিয়ে এইচ. আর. বি. সি তখনও পাইলিং শুরু করেনি। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসেনি। আর কলকাতা বইমেলা সেবছরই শুরু হচ্ছে। না! ময়দানে নয়, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পুবদিকের পাঁচিলের বাইরে, রাস্তা পর্যন্ত একফালি জমিতে - যেখানে এখন মোহরকুঞ্জ। বাঙালির মনে ও মননে তখনও দগদগ করছে বরানগর গণহত্যার ঘা। শেষ করে দেওয়া হয়েছে বাঙালির একটা প্রজন্ম।