ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে - ২৫
আগের পর্বে
বাবা বলতেন ডাক্তারদের মধ্যে সবথেকে চ্যালেঞ্জিং কাজ শিশু এবং পশুচিকিৎসকদের। তার মধ্যে কঠিনতর দ্বিতীয়টি। সুবিতদা, ডঃ সুবিত বসু এমনই একজন। নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে অফিস ছিল সুবিতদার। পশুচিকিৎসক হিসাবে চেম্বার করতেন নিজের বাড়িতেই। সুবিতদা আমাদের বিশালায়তন অ্যালসেশিয়ান জুনোর হেমাটোমা অপারেশন করেছিলেন মুখ না বেঁধেই। মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়েছিলেন আরেক পোষ্য নেকীকেও। অবলা প্রাণীরাও ওর হাত চেটে খবর নিত, জানাত নিজেদের কথা। তাঁদের পরম আত্মীয় ছিলেন তিনি। সেই স্মৃতিচারণার পর আজ নতুন পর্ব...
এক একজন মানুষ থাকেন যাঁরা নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা, নিষ্ঠা, উদ্যম, কঠোর পরিশ্রম ও মনোসংযোগ দিয়ে সব প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে যান। সেসব দিকে নজর না দিয়ে অথবা দিয়েও আমরা কৃতিত্ব দিই তাঁদের ভাগ্যকে অথবা তাঁদের জিনকে। এমনই একজন মানুষ তিনি।
ভারতবর্ষের প্রথম পাঁচজন ধাতুবিদ (Metallurgist)-এর একজন হিসাবে ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। কলকাতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইউনিভার্সিটি-ব্লু’ ছিলেন হকি এবং অ্যাথলেটিক্সে।
এরোপ্লেন চালানো শেখেন উইং কমান্ডার শান্তনু সেনের কাছে। কমার্শিয়াল পাইলটের লাইসেন্স ছিল তাঁর।
বাবার বন্ধু গোবরঘুষির রাজা গোবিন্দ সিং-এর সঙ্গী হয়ে দলমার জঙ্গলে প্রথম টাইগ্রেসটি মারেন রাতের অন্ধকারে— মাত্র ১৩ বছর বয়সে। সেটিই তাঁর শেষ শিকারও হয়ে দাঁড়ায় যখন জানতে পারেন বাঘিনীটি তিনটি শাবক বড়ো করছিল এবং সেই কারণেই গেরস্থের গরু, ছাগল তুলে নিয়ে যাচ্ছিল।
দেশের বাড়ি বরাভূমের ফুলচাঁদ বিদ্যাপীঠ থেকে M.E.(Middle English) পাশ করে কলকাতায় আসেন পরবর্তী পড়াশুনার জন্য। ভর্তি হন মিত্র ইনস্টিটিউশান মেইন-এ। পৈতৃকবাড়ি ৩৩, লোয়ার সার্কুলার রোড থেকে পায়ে হাঁটা পথ। সেখানে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন কবিশেখর কালিদাস রায়কে।
এরপর বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে আই.এস.সি এবং তারপর প্রেসিডেন্সি থেকে বি.এস.সি- সবটাই মামাবাড়ি বালি থেকে যাতায়াত করে। ঐসময়েই কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত হন এবং বন্ধু নন্দদুলাল ব্যানার্জী ও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে একত্রে বালিতে গঠন করেন ‘কিশোরবাহিনী’র শাখা। কলকাতার বাইরে সেটিই প্রথম।
আরও পড়ুন
ক্যারিঙ দ্যা ব্লু ক্রশ
ফার্স্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান এন.সি.সি.-র প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৫০ সালে দিল্লিতে প্রথম রিপাবলিক ডে প্যারেডে চোখে পড়ে যান স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম ‘কমাণ্ডার-ইন-চিফ’ জেনারেল কারিয়াপ্পার। তখনও তিনি ফিল্ড মার্শাল হননি।
এই স্মার্ট, ইনটালিজেন্ট, উইটি ছেলেটি কয়েক’শ ক্যাডারের মধ্যেও আলাদা করে নজর কেড়েছিল তাঁর।
আরও পড়ুন
দিগন্তজোড়া সবুজের অভিভাবক
প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ। সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এনসিসি ক্যাডেট-রা এক মাস আগে থেকে দিল্লিতে পৌঁছে প্রতিদিনের ‘কুচ’-এ মহড়া দিচ্ছে দেশের সেরা সেনা রেজিমেন্টগুলির সঙ্গে— যার মধ্যে আছে ‘প্রেসিডেন্ট’স গার্ডস’-এর মতো এলিট ক্যাভালরি ইউনিটও। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্ট থেকে বেছে বেছে আনা সৈনিকদের নিয়ে তৈরি সেই অশ্বারোহী বাহিনী প্রেসিডেন্টকে পাহারা দেয় দুটি দলে ভাগ হয়ে এবং দিনে দু’বার তারা নিজেদের ডিউটি বদল করে। দায়িত্বের এই জাঁকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরকে বলা হয় ‘চেঞ্জ অফ গার্ডস’। একজন সিনিয়ার অফিসারের নির্দেশ বা কমান্ডে এই পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়।
তো সেই তরুণ ক্যাডারটিকে পরীক্ষা করতে জেনারেল কারিয়াপ্পা একদিন সকালে তাকে ডেকে বললেন, ‘Amal, today you do the honour!’
‘Thank you sir!’, বলে স্যালুট করে চলে এলেও অমল জানে না সে এবার কী করবে। কারণ বেশ কয়েকদিন যাবৎ ‘চেঞ্জ-অফ-গার্ড’ সেরিমনিটি চোখের সামনে দেখলেও কমান্ডগুলি মন দিয়ে শোনার সে প্রয়োজন বোধ করেনি। এখন কী করা!
আরও পড়ুন
এলেবেলে নন, তিনি ‘A’লেভেলের
হঠাৎ বিদ্যুতের মতো বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়। অফিসার কমান্ডিং ইউনিট থেকে যতটা দূরে দাঁড়িয়ে পরিচালনা করেন ব্যাপারটি, তার চেয়েও অনেকটা পিছনে চলে যায় অমল এবং সেই দূরত্ব থেকেই চেঁচিয়ে কমান্ড দিতে থাকে ‘স্কোয়াড হাই-হাপ’, ‘স্কোয়াড ইয়ে করেগা’, ‘ওহ্ করো’, ইত্যাদি। যার শব্দগুলি নয়, কেবল আওয়াজগুলি পৌঁছায় বাহিনীর কাছে। আর সেই দক্ষ, সুশিক্ষিত, রণদর্পী বাহিনী নিজ দায়িত্বে পুরো অনুষ্ঠানটি করে নেয় ‘রাজপথ’ জুড়ে। পরিশেষে রেজিমেন্টাল ফ্লাগ তুলে দেয় তাদের ঐদিনের কমান্ডিং অফিসার অমল কুমার গাঙ্গুলীর হাতে। অমল সেই পতাকা জেনারেল কারিয়াপ্পার হাতে তুলে দিয়ে স্যালুট করে বলে ‘Change of Guards done sir!’
পুরো ভাঁওতাটি বুঝতে পেরেও তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে মুগ্ধ হয়ে জেনারেল বলেন, “Well done my boy! From today onwards you will be called the ‘Cadet General’!”
আরও পড়ুন
মেলাবেন, তিনি মেলাবেন
সেই সময়ে শেখা সে সামরিক বিদ্যাও কাজে লেগে যায় যখন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির তরফে তেভাগা আন্দোলনে কাকদ্বীপে আত্মগোপন করে আর্মস ইনস্ট্রাকটরের কাজ করেন। আন্দোলন অসফল হওয়ার পর পালিয়েও যান শেষ মুহূর্তে, নদী সাঁতরে, পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে। পুলিশ কেবল তাঁর ফিশারম্যানস্ গামবুটটি পায়।
কর্মজীবনে পৃথিবীর বৃহত্তম ইস্পাত গোষ্ঠী GKW-র কভেনেন্টেড অফিসার ছিলেন। সে মুহূর্তে এশিয়ায় মাত্র ১১ জন ঐ পদাধিকারী ছিলেন। কর্পোরেট তাঁদের O.P.C. অর্থাৎ অপারেটিং প্রজিট সেন্টার নামে উল্লেখ করত। এসবের অনেক আগে GKW-র আন্দুল ইউনিট তার ‘নিউ মেল্টিং শপ’-এর স্কেল মডেল তৈরির জন্য গ্লোবাল টেন্ডার ডাকে। সে টেন্ডার নানা কারণে বাতিল হয়ে যখন প্রোজেক্টটিই বন্ধ হয়ে যাবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন জেনারেল ম্যানেজার ডঃ অঞ্জলি কুমার বোসকে রাজি করিয়ে নিজে দায়িত্ব নেন নিউ মেল্টিং শপ-এর স্কেল মডেল তৈরি করার। আর সারা বছর শিফট ডিউটির পরে দিনরাত জেগে ২ বছরে তৈরি করে ফেলেন সেই মডেল— নিখুঁত নৈপুণ্যে, ৬’X৩’ টেবিলের উপর। এরপর ইংল্যান্ড থেকে জিকেএন গ্রুপ-এর প্রেসিডেন্ট ডঃ নরম্যান ফিঞ্চ আসেন শিবপুর প্ল্যান্টে— সেই মডেল দেখতে এবং দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। জি.কে.ডব্লিউ-র মাদার কনসার্ন GKN (Guest Keen & Nettlefold) অমল গাঙ্গুলীকে ওয়েলস্-এ পাঠায় তাদের মাদার প্লান্ট ব্র্যাম্বো স্টিল-এ বড়ো আর্কফার্নেসে আধুনিক শংকর ইস্পাত (Alloy Steel) তৈরিতে হাত পাকাতে। যাতে তিনি ফিরে এসে নিউ মেল্টিং শপের দায়িত্ব নিয়ে পারেন। সেটা ১৯৬৫ সাল।
এখানে তাঁর জবানেই ওয়েলস্-বাসের একটি গল্প থাক।
‘উনিশ শো পয়ষট্টির শীতকাল। স্নোডন মাউন্টেনের কোলে ওয়েলস্-এর এক ছোট্ট গ্রাম রেক্সহ্যাম-এ আছি। এসেছি আমি আর সেন— কাঠ বাঙাল ফনীন্দ্রনাথ সেন, বড়ো আর্কফার্নেসে অ্যালয় স্টিল তৈরি শিখতে ‘ব্রিম্বো স্টিল’-এ। সব খরচ দিয়ে তিন মাসের জন্য পাঠিয়েছে আমাদের কোম্পানিই।
আমাদের ল্যান্ডলর্ড উইলিয়াম গ্যাফনি ও ল্যান্ডলেডি মার্গারেট গ্যাফনি খুবই অতিথিবৎসল, আমাদের কোনো অসুবিধা হতে দেয় না। এর একটি কারণ বোধহয় ভারতীয়দের অতিথিপরায়ণতা সম্পর্কে এদের উচ্চ ধারণা।
উইলিয়াম ও মার্গারেটকে আমরা তাদের ডাক নাম যথাক্রমে বব্ ও ম্যাগী বলেই ডাকি। ওরা আমাকে গ্যাং, অর্থাৎ গাঙ্গুলীকে ছোট করে ডাকে। আর সেনকে ডাকে ফ্যানী নামে, ফনীন্দ্রনাথকে সংক্ষেপ করে।
দোতলায় থাকেন বাড়িওয়ালারা। আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ভোরে উঠি। ভারী প্রাতঃরাশ করে ওয়ার্কস্-এ যাই। ওখানেই লাঞ্চ। রাতে বাড়ি ফিরে সাপার ও তাড়াতাড়ি ঘুম। রুটিন মোটামুটি এরকমই চলছিল।
আমাদের বিদেশবাসের দিন দশেক হয়েছে সাকুল্যে। সেদিন আমাদের উইকলি অফ। সবাই বাড়িতেই। হঠাৎ সকালেই সেন ধরেন আমাকে— “এই গাঙ্গুলী! আপ্নে তো দিব্য আসেন! এদিকে এক হপ্তা যাবৎ টিস্যুপেপার ব্যবহার কইরগা আমার তো সারা গায়ে গন্ধ হইয়া গেল গিয়া। আর পারতাসি না মশয়।”
মুচকি হেসে বলি, “তা টিস্যুপেপার ব্যবহার করছেন কেন? আমার মতো জল নিয়ে ঢুকলেই পারেন।”
সেন অবাক হয়ে বলেন, “হ! তাই নাকি? কিন্তু আপনে কীভাবে ম্যানেজ করেন? অ্যাগো তো কোনো ব্যবস্থা নাই। আপ্নে কি করতাসেন?”
আমি আমার কোটের বুকপকেট দেখাই, যেখানে একটা খালি নিপ বটল্-এ গরমজল রাখা থাকে সব সময়।
সেন বলেন, “হেয়াতো আপনের বুকের ব্যথার লইগ্যা।”
এবার বাধ্য হই গোপনীয়তা ভাঙতে। ওনাকে বলি যে আমার বুকের ব্যথার ব্যাপারটা বানানো— বাড়িওয়ালিকে বোকা বানানোর জন্য। অসুবিধাটা আমারও ঐ একই ব্যাপারে।
“তবে আজ থিকা আমারও বুকে ব্যথা”, বলে আমার পকেট থেকে প্রায় ছোঁ মেরে গরমজলের বোতলটা নিয়ে নেন সেন এবং এক দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে যান।
আমি ঘরে ফিরে সেনেরই অপেক্ষায় থাকি। মিনিট দশেক পরে বন্ধ দরজার বাইরে থেকে সেনের গলার চাপা ডাক শোনা যায়। দরজা খুলি। সেন বলেন, “এই গাঙ্গুলী! কেলেঙ্কারী হইসে!”
আমি জানতে চাই কী ব্যাপার? সেন উত্তরে যা বলেন তা থেকে এই উদ্ধার হয় যে, অনেকদিন পর স্বাধীনতা পেয়ে মনের আনন্দে উনি যা করেছেন তাতে পুরো বাথরুমের দেওয়াল (ওদেশে তখন ঘর ছাড়াও অধিকাংশ বাথরুমের দেওয়ালে ওয়ালপেপার লাগানো থাকত) মেঝে থেকে বেশ উঁচু পর্যন্ত ভিজে গেছে। সেন বলেন “অখন কি হইব?”
যদিও বব্ ও ম্যাগী দুজনেই যথেষ্ট শিক্ষিত ও ভদ্র, কিন্তু ওদের মাপকাঠিতে ব্যাপারটা প্রায় অসভ্যতা হয়ে গেছে। কাজেই পাছে ওরা জানতে পারে, এই চিন্তায় লজ্জায় ও ভয়ে আমরা মনমরা হয়ে যাই। ভাবতে থাকি কী করা যায়। কীভাবে এই দেওয়াল শুকানো যায়। এক্ষেত্রে শুধু আমাদের নয়, জড়িয়ে গেছে দেশের সম্মানও।
এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে ম্যাগীর হেয়ারড্রায়ারের দিকে চোখ পড়তেই বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়। “আরে! এটা দিয়ে তো দেওয়াল শুকানো যেতে পারে! কিন্তু আওয়াজ? এ আওয়াজ দোতলা থেকে স্পষ্ট শোনা যাবে। তখন? তখন আমরা দুজন পুরুষমানুষ হেয়ারড্রায়ার চালানোর কি যুক্তি দেব ম্যাগীকে?”
সেনকে জিজ্ঞেস করি “গান জানেন?”
সেন বলেন “না”।
মরিয়া আমি বলি “যে কোনো গান?”
সেন মন হাতড়ে বলেন “না”।
আমি বলি “নিদেন পক্ষে জাতীয় সঙ্গীতটা?”
সেন এবার বলেম “হ! হেঢা এট্টু জানি”।
ম্যাগীর হেয়ারড্রায়ার অন করি দেওয়ালের দিকে তাক করে এবং মিলিত কণ্ঠে গেয়ে উঠি— “জন গণ মন অধিনায়ক…”।
আমাদের মান বাঁচানোর তাগিদে গাওয়া কান ফাটানো গানের আওয়াজে হেয়ারড্রায়ারের শব্দ চাপা পড়ে যায়। কিন্তু দোতলা থেকে মার্গারেটের গলা পাওয়া যায় “হেই গ্যাং! আর ইউ ফিলিং হোমসিক?”
ওর প্রশ্নেই আমাদের জবাব পেয়ে যাই। চেঁচিয়ে উত্তর দিই “ইয়েস! ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি রাইট”। আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে গেয়ে চলি— “জয় হে, জয় হে, জয় হে…”
পাহাড়ি শহরতলির ভোরের কুয়াশার ফাঁকফোকর দিয়ে দুটো বেসুরো গলার গান ছড়িয়ে পড়ে দূরে— বহু দূরে।
ভারতীয় রেলপথের আধুনিকীকরণের সময় কংক্রিট স্লিপারের সঙ্গে রেললাইনগুলি জুড়তে যে স্পিং-এর মতো বস্তুটি ব্যবহার করা হয়েছিল তার কারিগরি নাম Pan-roll-clip (ইদানিং বিভিন্ন সময়ে খবরে ও খবরের কাগজে বিকৃত হয়ে যা ‘প্যান্ড্রোল ক্লিপ’ নাম পেয়েছে)।
তো সেই প্যান-রোল ক্লিপ যে ইস্পাত দিয়ে তৈরি হয় তাকে বলা হয় ‘স্প্রিং স্টিল’। ঐ ইস্পাতে সিলিকন ও ম্যাঙ্গানিজ-এর পরিমাণ বেশি থাকায় অনেক সময় ‘সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ’ও বলা হয়। এই ‘স্প্রিং স্টিল’-ও এদেশে তৈরি করে প্রথম আদর্শীকরণ করেন তিনিই।
কিন্তু এখন পর্যন্ত যা কিছু বললাম সেগুলি তাঁর পরিচয় নয়। আচ্ছা বেশ। বলা যাক সম্পূর্ণ পরিচয় নয়।
কারণ গেস্ট কিন উইলিয়াম’স যখন তার কভেনেন্টেড অফিসারদের থিয়েটার রোডে (তখনও সেক্সপিয়ার সরণী হয়নি) বাংলো দিচ্ছে থাকার জন্য, আর ঠিক একই সময়ে জিকেএন-এর প্রাক্তন চিফ এক্সিকিউটিভ ডঃ নরম্যান ফিঞ্চ তাঁকে লাগাতার ডেকে পাঠাচ্ছেন জিম্বাওয়ের প্রথম ইন্টিগ্রেটেড স্টিল প্ল্যান্টের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তিরিশ হাজার ডলার মাসিক সাম্মানিকে— উনি মহানগর ছেড়ে হুগলির মফঃস্বল উত্তরপাড়ায় চলে গেলেন ছেলেদের মাটির কাছাকাছি সবুজের মধ্যে রেখে বড়ো করবেন বলে। সেটা ১৯৬৮ সাল।
কখনো মুখে বলে কিছু শেখাতেন না। সব সময়েই করে দেখাতেন— নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে, ব্যবহারে, জীবনচর্য্যায়। তবে মাঝে মধ্যেই উদ্ধৃতি দিয়ে যেসব কথা বলতেন তাতেও তাঁর বিশ্বাস এবং মানবপ্রেম প্রতিফলিত হত। যেমন বলতেন ‘To belittle is to be little’, কাউকে ছোট করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই ছোট হই। অথবা ‘Don’t defeat anybody, win him over’, অর্থাৎ ‘কাউকে পরাজিত কোরো না, তাকে (তার মন) জিতে নাও’।
ছেলেদের জন্য নিয়ম ছিল খাবার সময় (তা হাতে হোক অথবা কাঁটাচামচে) দুই কনুই ডাইনিং টেবল্ ছেড়ে উঠবে না। এতে অযথা এনার্জি নষ্ট হয়।
খাবার সময় যদি প্লেট এবং সামনে দিকেই তাকিয়ে থাকবে— কিন্তু ঐ অবস্থাতেই ডানদিক ও বাঁদিকে মোট ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল-এ দেখতে পেতে হবে। অর্থাৎ তোমার দু’পাশে যাঁরা বসেছেন তাঁদের এবং তাঁদের গতিবিধি— দেখতে পেতে হবে। একেবারে পাইলটের ট্রেনিং— তাও ফাইটারের।
খাওয়ার প্লেটে একটিও ভাত ফেলে ওঠা যাবে না। কারণ ‘ভারতবর্ষে কয়েক কোটি মানুষ এখনও দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায় না।’
কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষটি ছেলেদের মেলামেশা, খেলাধুলো, গানবাজনা— সব বিষয়ে সুযোগ ও স্বাধীনতা দিতেন। পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়ায় উৎসাহ দিতেন— তবে পরোক্ষে। তাদের সব সাফল্য উদযাপন করতেন। পাশে থাকতেন প্রত্যেকটি ব্যর্থতায়। কিন্তু তাদের সম্ভাবনার উপর কখনো বিশ্বাস হারাতেন না। বলতেন, ‘The only way to make a man trustworthy is to trust him.”
ছুটির দিনে দুই পুত্রের হাত ধরে বোটানিক্যাল গার্ডেনের হাজার রকম সবুজের মধ্যে গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গান ধরতেন, ‘শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি…’।
সেনজিভেরিয়া মেটালিকা-র মাত্র ১টি চারা জোগাড় করার জন্য সাত মাস লাগাতার ঘুরেছিলেন বোটানিক্যালের আধিকারিকদের পিছনে। অবশেষে সফলও হয়েছিলেন।
জানুয়ারির কুয়াশা ঢাকা ভোরে সকাল ৬টার মধ্যে তারাতলা মোড়ে হাজির হয়ে যেতেন কালিম্পং থেকে আসা বন্ধুটি, সেরিঙ-এর থেকে ‘গোটা মুগডাল’ মাপের এক ডজন অ্যাস্ট্রোফাইটাম অ্যাস্টারিস-এর চারা নেবার জন্য। সেইসব চারা বড়ো করার পর চাওয়া মাত্র দিয়েও দিয়েছেন কোনো ক্যাকটাসপ্রেমীকে। তিনিও গাছ ভালোবাসেন শুধু সেই সম্পর্কের মান রাখতে।
তাঁর যত্নে বড়ো করা বহু গাছ বছরের পর বছর পুরস্কার পেয়েছে, ‘বেস্ট-ইন-শো’ হয়েছে এগ্রি-হর্টি-কালচারাল সোসাইটির অ্যানুয়াল ফ্লাওয়ার শোয়ে। কিন্তু সেসব গাছের এন্ট্রি থাকত বন্ধুবান্ধবদের। নিজে কোনোদিন তিনি শোয়ে নামেননি বন্ধুদের প্রতিদ্বন্দ্বী করবেন না বলে।
ছেলেদের পুজোর ছুটি, শীতের ছুটি, গ্রীষ্মের ছুটিতে হোল্ড-অল, ট্রাঙ্ক গুছিয়ে সপরিবার রওনা দিতেন দেশের বাড়ি পুরুলিয়ার বলরামপুর মুখো ট্রেনে। সঙ্গে Dog Box-এ একই ট্রেনের অন্য কামরায় যেত পরিবারের একমাত্র চতুষ্পদ সদস্য অ্যালসেসিয়ান রিনটিনও।
তারপর প্রান্তিক ‘না-শহর’ বলরামপুরের ক্ষেত, মাঠ, বন ঢুঁড়ে নদীর ধারে পারিবারিক চড়ুইভাতি। কখনো পাহাড়ে অভিযান।
অযোধ্যা ও সংলগ্ন পাহাড়গুলিতে সিলভার ফার্ন ও বুনো মুসাণ্ডা খুঁজে বেড়ান। রাঙ্গাডির ঘন শালবনে তিন প্রজাতির লতানে ফার্ন খুঁজে পাওয়া। আজ যারা সবাই হারিয়ে গেছে। এমনকি সেই হার্বেরিয়ামটিও। যদিও স্মৃতিতে অটুট।
ডাকবাংলোর কাছে রেল কালভার্টের নিচে অল্প অল্প ভিজে মাটিতে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম পতঙ্গভুক উদ্ভিদ ‘সূর্যশিশির’ চিনিয়েছিলেন। যারা মূলত মশা খেয়েই বাঁচে।
আগাছাকে আগাছা বললে ভয়ানক রেগে যেতেন। বলতেন ‘নিজের অজ্ঞতাকে আগাছা নামের পিছনে ঢেকো না। বরং ওদের নাম জানতে চেষ্টা করো। সঙ্গে একথাও মনে রেখো যে ওরাও আমাদের অক্সিজেন যোগায়।’
সত্যিই এক অসাধারণ ‘সাধারণ মানুষ’ ছিলেন তিনি। অপরিসীম সৌভাগ্য আমার এ জীবনে আমি তাঁকে পিতা হিসাবে পেয়েছি।
Powered by Froala Editor