ক্যারিঙ দ্যা ব্লু ক্রশ

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে - ২৪
আগের পর্বে

অভয়পদ ভট্টাচার্য। ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনের কিউরেটর ছিলেন তিনি। মাইলের পর মাইল সবুজ সাম্রাজ্যে শাসন চলত তাঁর। বাঁশ ও পাম প্রজাতির গাছের সংরক্ষণের সঙ্গে অরনামেন্টাল ফোলিয়েজ এবং বোগেনভেলিয়ার ওপর উল্লেখযোগ্য গবেষণা ছিল অভয়কাকুর। হাতের তালুর মতো চিনতেন ভারতের জাতীয় বাগানকে। একবার স্টিফানোটিস ফ্লোরিবান্ডা নামের একটি বিদেশি গাছের চারা তৈরি করে দিয়েছিলাম তাঁকে। কাটিং-এ সেই চারা তৈরির কৃতিত্ব দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। তারপর...

পরিবারে জীবজন্তু পোষার চল পাঁচ প্রজন্মেরও বেশি। বাবা পাখি ও কুকুর পুষতেন, বাগান করার পাশাপাশি। ঠাকুর্দা বাঘ, ভালুক ও ময়ূর পুষেছেন। শিকারি ছিলেন— মূলত বিগ গেম হান্টার। তাঁর বাঘের নাম ছিল ডোরা, ভালুকদ্বয়ের নাম ছিল ছোট্‌কা ও বড়্‌কা এবং ময়ূরের নাম ছিল মোহন। তবে হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে হবে সে গল্প।

আসলে যে কথায় আসার জন্য এসব বলা তা হল পোষা জীবজন্তুর কারণেই এ পরিবার বরাবরই ভেটদের খুব কাছ থেকে পেয়েছে। বন্ধু হিসাবে, কাছের মানুষ হিসাবে, অনেক সময়েই ত্রাতা হিসাবেও।

বাবা বলতেন, ‘ডাক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ শিশুচিকিৎসক ও পশুচিকিৎসকের। এই দুইয়ের মধ্যেও কাজ বেশি কঠিন পশুচিকিৎসকের। কারণ তাঁর পেশেন্ট কথাটুকুও বলতে পারে না। অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে যে তাদের ভাষাটা আমরা বুঝি না।’

সে যাই হোক ভেটেনারি সার্জেন, অর্থাৎ যাঁরা সারা জীবন ধরে নীল ক্রশচিহ্নটি বয়ে বেড়ান তাঁদের জন্য অনেকের মতোই আমাদের পরিবারেও এক দারুণ ভালোবাসা ও সম্মানের জায়গা বরাবরই ছিল এবং এখনও আছে।

আরও পড়ুন
দিগন্তজোড়া সবুজের অভিভাবক

আমাদের ছেলেবেলা ১৯৬৮-৭০ সাল। উত্তরপাড়া তখনও প্রাসাদনগরী। অনেকটা হয়ত বহরমপুরের মতোই।

সরকারি পশুচিকিৎসালয় সাধারণত গ্রামাঞ্চলেই হত। কিন্তু উত্তরপাড়া শহরেও একটি ছিল, অনেক আগে থেকে এবং অনেকদিন পর্যন্ত— লিচুবাগানে। একটি টালির বেশ বড়ো দোচালা বাড়িতে। বোধ হয় রাজাদের পোষ্য হাতি, ঘোড়া, কুকুর এবং অন্যান্য জীবজন্তুদের চিকিৎসার জন্যই চালু হয়েছিল। তবে যেহেতু ছিল এবং একজন পশুচিকিৎসক ও একজন কম্পাউন্ডার সব সময়ে থাকতেন তাই এ শহরের নাগরিকরাও প্রয়োজনে পরিষেবাটুকু পেয়েই যেতেন।

আরও পড়ুন
এলেবেলে নন, তিনি ‘A’লেভেলের

তখন বাড়িতে বাড়িতে এত কুকুর পোষার চল ছিল না। ব্যানার্জীপাড়ায় সজলদা-রাজকুমারদাদের বাড়ি ও চম্পকদা ও চন্দনদের বাড়িতে এবং চড়কডাঙ্গায় আমাদের বাড়িতে কুকুর ছিল। সবগুলিই অ্যালসেশিয়ান। আমাদের বাড়িতে যখনও অন্য ব্রীডও। তো আমাদের পরিবারগুলির জন্য ঐ চিকিৎসালয়টি দারুণ ভরসার জায়গা ছিল। আর অসাধারণ সব ডাক্তারবাবুও কাজ করে গেছেন সেখানে। এঁদের মধ্যে ডাঃ নির্মাল্য আচার্য ও ডাঃ জিতেশ চক্রবর্তীর কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। ডাঃ নির্মাল্য চক্রবর্তী এক সময় ‘ক্যালকাটা মাউন্টেড পুলিশ’-এর ঘোড়াদের দায়িত্বে ছিলেন। ডাঃ জিতেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে দুজনেই খুব ভালো ডাক্তার ছিলেন।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ থাক যে এঁরা অর্থাৎ ভেটেনারি ডাক্তাররা সকলেই ঘোড়ায় চড়তে জানতেন। কারণ, এম. ভিএসি করতে হলে তখন (এখনকার কথা জানা নেই) অশ্বারোহন শেখা বাধ্যতামূলক ছিল।

আরও পড়ুন
মেলাবেন, তিনি মেলাবেন

ডাঃ সুবিত বাসুর সঙ্গে বাবাই পরিচয় করিয়ে দেন। যথেষ্ট বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল দুজনের। যদিও ওঁর থেকে আমার পিতৃদেব বয়সে বেশ বড়ো ছিলেন। কি কারণে জানি না আমি ওঁকে প্রথম থেকেই সুবিতদা নামেই সম্বোধন করতাম।

সুবিতদার অফিস ছিল নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে। উঁচু পদের সরকারি আধিকারিক ছিলেন প্রাণীসম্পদ দপ্তরে। রাজ্যের পশুশালাগুলিতে পোস্টিং হত ওনার হাত দিয়েই। ওঁর সূত্রেই আলাপ ডাঃ তুহিন চক্রবর্তী (একশৃঙ্গ গণ্ডার বিশেষজ্ঞ) ও শ্রী এন. সি. বহুগুনার সঙ্গে। শ্রী বহুগুনা সে সময় দার্জিলিং জু’র ডিরেক্টর ছিলেন। পরে তিনি চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন ওয়েস্ট বেঙ্গল হন। আর পশুচিকিৎসক হিসাবে সুবিতদা কেমন ছিলেন বোঝাতে একটি ইংরাজি উদ্ধৃতি দিতে চাই :

আরও পড়ুন
রক্ত যখন নীল

“The best doctor in the world is the veterinarian. They can’t ask their patients what is the matter, they’ve just got to know. Good veterinarians talk to animals. Great veterinarians hear them talk back.”

Subitda was great!

নিজের বাড়িতেই চেম্বার করতেন তিনি। তবে আমাদের প্রয়োজনে বারংবার তাঁকে বাড়িতেও পেয়েছি।

আমাদের বিশাল আয়তনের ডাবল কোট অ্যালসেশিয়ান ডগ জুনোর কানে ‘হেমাটোমা’ অপারেশন করেছিলেন মুখ না বেঁধে। আমি জিজ্ঞেস করায় সুবিতদা বলেছিলেন, ‘গৈরিক, তোমাদের বাড়ির কুকুরদের টেম্পারামেন্ট খুব ভালো। ওদের মুখ বাঁধার কোনো দরকার নেই।’ আমাদের পুষ্যিদের ওপর এতটা বিশ্বাস ওঁর ছিল ঠিকই কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হল সেই পুষ্যিদেরও তাদের ডাক্তারবাবুর উপর কতটা ভরসা ও বিশ্বাস ছিল।

এতটা ভালোবাসা ওঁর মনুষ্যেতর জীবগুলির প্রতি ছিল, কারণ বোধ হয় এই যে উনি নিজেও বরাবর বাড়িতে এক বা একাধিক কুকুর পুষেছেন। কেবল চিকিৎসাই করেননি।

আমাদের অ্যালসেশিয়ান বিচ নেকী যে বার প্রথম কনসিভ করল, আমরা একটু নার্ভাস ছিলাম। বাবার কাছে কেবল ফোনে জানতে পেরে সুবিতদা বাড়ি এসে নিজে হাতে ১১টি বাচ্চা ডেলিভারি করিয়ে যান।

একবার নেকীকে চোরেরা বিষ খাইয়ে দিল। সম্ভবত খাবারে মিশিয়ে। সন্ধের মধ্যে নেকী ২৮ বার রক্ত পায়খানা করল। আমরা দৌড়ে গেলাম সুবিতদার বাড়ি— ভীষণ ভয় পেয়ে। সব শুনে সুবিতদা বললেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। নেকী ঠিক হয়ে যাবে। তবে যা বলব একেবারে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে, পারবে তো?’ আমরা জবাব দিই, ‘অবশ্যই পারব, আপনি বলুন কী করতে হবে?’

‘প্রথমেই এক তাল পুরনো তেঁতুল জোগাড় করে এক গামলা জলে সেটা গুলে নাও। তারপর ড্রপারে বা চামচে করে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ৫ এম.এল পরিমাণ ওকে খাওয়াতে থাকো, সারা রাত। প্রয়োজনে দুজনে পালা করে। কাল সকালে ও উঠে বসবে এবং খেতেও চাইবে। কিন্তু কোনো কারণেই আগামী সাতদিন ওকে জল ছাড়া কিছু খেতে দেওয়া যাবে না। তারপর লিকুইড ডায়েট, সলিড খাবার আরও পরে। আর রোজ সকালে তোমরা আমায় রিপোর্ট করে যাবে।’

সুবিতদার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আমরাও লড়ে গিয়েছিলাম। আর আমাদের নেকী সেবার ফিরে এসেছিল যমের দুয়ার থেকে।

সুবিতদা আমাদের বাড়ি এলে তৎক্ষণাৎ তাঁর পেশেন্টরা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে তাঁকে ঘিরে ধরত। শুঁকে এবং অনুমতি পেলে হাত চেটে দিয়ে ওঁর খবর নিত এবং নিজেদের কথাও বলত। সুবিতদাও ওদের পিঠ চাপড়ে, কান টেনে দিয়ে বা কখনও নাকে নাক ঘষে দিয়ে প্রত্যুত্তর দিতেন, আদর করতেন। ভেটকে তারা ভয় পেত না। তাদের পরম আত্মীয় ছিলেন তিনি।

যদিও ওদের আবদার মেটাতে গিয়ে প্রত্যেকবারই সেন্টার টেবল্‌-এ সুবিতদার চা ঠান্ডা হয়ে যেত।

বছর দশেক আগের ঘটনা। আমাদের হারলিকুইন গ্রেট ডেন ‘রাধা’ খুব অসুস্থ হল। এতটাই যে তাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সুবিতদা ততদিনে প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন। তবুও ওঁরই শরণাপন্ন হলাম। শেষে সুবিতদার অনুরোধে তাঁর অনুজপ্রতিম ডাঃ স্বপন ঘোষের মতো চিকিৎসক বাড়ি এসে আমাদের ‘রাধা’কে দেখে গেলেন। আরও পরে তিনিই মারাত্মক ব্লাড-ডিসেন্ট্রি থেকে জীবন বাঁচিয়েছিলেন আমাদের প্রাণের প্রিয় ‘রোদ্দুর’-এর।

সুবিতদার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। মনে পড়ছে আর একবারের কথা। আমি তখন লিলুয়া রেল কলোনির মুখোমুখি উল্টোদিকে আশোক স্টিল কর্পোরেশানে চাকরি করি। শিফট-ইন-চার্জ। লাঞ্চ ব্রেক-এ বেরিয়ে দেখি কারখানা গেটের দু’চারটি বাড়ি পরে জি.টি. রোডের উপরেই যে ভেটেনারি ওষুধের দোকানটা— সেখান থেকে ‘গৈরিক, এই গৈরিক’ বলে কেউ ডাকছে আমায়। তাকিয়ে দেখি সুবিতদা। নতুন চেম্বার। বসে একসাথে চা খাওয়া গেল। গল্পও হল অল্প।

এর কিছুদিনের মধ্যেই লিলুয়ায় একটি অত্যন্ত নির্দয় ঘটনা ঘটে। একটি পোষা হাতিকে নিয়ে তার মাহুত একটি মিষ্টির দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে নমস্কার করিয়ে শুঁড় বাড়িয়ে দিয়েছিল— বোধহয় খাবার অথবা অর্থের আশায়। ময়রা সেসবের পরিবর্তে শুঁড়ে গরম রস ঢেলে দিয়েছিল। হাতিটি যন্ত্রণায় ময়রাকে আক্রমণ করে এবং মারাত্মক আহত করে।

এরপর ঐ হাতিটি তার মাহুতসহ নিয়মিত আসত সুবিতদার ঐ চেম্বারে চিকিৎসা করাতে— যতদিন না সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়।

মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে ডাঃ সুবিত বাসু মানুষ এবং চিকিৎসক হিসাবে সাধারণ নন, সত্যিই ‘Awe-সামান্য’ ছিলেন!

Powered by Froala Editor