রক্ত যখন নীল

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ২০

আগের পর্বে

খেলা, খেলা আর খেলা। এমনই এক জীবন ছিল অসিত বিশ্বাস ওরফে আমাদের অম্বুদার। খেলোয়াড়দের তিনি দেখতেন সন্তানের চোখে। তাঁর হাতে তৈরি ঐক্য সম্মেলনী ক্লাব একসময় ময়দান কাঁপিয়েছে। ‘ক্যালকাটা আর্চারি ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ১৯৭৯ সালে বিজয়ওয়াড়া সর্বভারতীয় ক্রীড়ায় বেঙ্গল দলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনিই। প্রতি খেলোয়াড়ের জন্য সেই আমলেও ওয়াটার বটল নিয়ে হাজির হওয়া থেকে প্রত্যেকের ব্যাগের হিসাবে— একা হাতেই সামলেছেন অম্বুদা। ভরসা যুগিয়েছেন খেলোয়াড়দের। সেই প্রতিযোগিতায় ২১টির মধ্যে ২১টি পদকই নিয়ে এসেছিল বাংলার খেলোয়াড়রা। যার পিছনে ছিল অম্বুদারই অদৃশ্য কৃতিত্ব।

পিতৃদেবের বন্ধু তিনি। বাবা ডাকতেন শৈলেনদা আর উনি বলতেন অমলদা।

শ্রী শৈলেন মুখার্জী মানে আমাদের শৈলেনজ্যেঠু ধুতি আর পাঞ্জাবি পরতেন। চোখে কালো সরু ফ্রেমের চশমা। শীতকাল এলে পাঞ্জাবিটা আদ্দির বদলে সার্জের হয়ে যেত এবং সঙ্গে থাকত শাল — অবশ্যই পশমিনা। মৃদুও ও স্বল্পভাষী মানুষটির নিরহংকার আভিজাত্য আমাদের নিরন্তর মুগ্ধ করত।

১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সালের কথা হবে। ওই সময়ে দেবীদাস চৌধুরী, বিমলদাস চৌধুরী, অমল কুমার গাঙ্গুলী, এস.এস. ভিমল, শচীন ব্যানার্জী, সুভাষ গুহ নিয়োগীদের সঙ্গে তিনিও অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন Cacti and Succulent Association of India গঠনে এবং সেই সংগঠনের মুখপত্র Xero News প্রকাশনাতেও।

শৈলেন মুখার্জীর বাবা শ্রী কীর্তিনারায়ণ মুখার্জী গোলাপ করতেন। বিদেশ থেকে বহু দুর্লভ প্রজাতির গোলাপ গাছ আনিয়েছিলেন তিনি। করেছিলেন চাঁপদানীর বাড়িতে। চাঁপদানীর জমিদার ছিলেন ওঁরা। ওঁদের ছিল স্টিভেডার ফার্ম অর্থাৎ পুরনো জাহাজ কিনে ভেঙে বিক্রি করার ব্যবসা। এখানে বলে রাখা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে তৎকালীন বাংলা সিনেমার সুদর্শন নায়ক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের উনি মামা হতেন সম্পর্কে।

আরও পড়ুন
অম্বুদা— যিনি একাই তিনশো

বিহার (এখন ঝাড়খন্ডে)-এর শিমূলতলায় বিরাট বাড়ি ছিল ওঁদের। হাওয়া বদলে যাওয়ার জন্য। যেমন অনেক শিক্ষিত এবং অর্থবান বাঙালিরই সে সময় পশ্চিমে একটি বাড়ি থাকত। কেবল পরিবারের লোকজনই নয়, সেখানে বেড়াতে গেছেন দূর সম্পর্কের অনেক আত্মীয় এবং বন্ধুরাও।

মধ্যমগ্রামে বাগানবাড়ি করেছিলেন শৈলেনজ্যেঠু। অনেক জায়গা নিয়ে। আমাদের সপরিবার নিমন্ত্রণ করে নিজের অ্যাম্বাসাডার গাড়িতে করে নিয়েও গিয়েছিলেন সেই বাগানে। বেশ বড়ো একটা দিঘি ছিল তাতে। বাঁধানো ঘাট, চারপাশে কেরলিয়ান ডোয়ার্ফ নারকেল গাছের সারি। বাগানের মাঝ বরাবর সেন্ট্রাল লন। তখনকার দিনেই লন তৈরি করিয়েছিলেন কেনটুকি ব্লু ঘাস আমদানি করে। অতি যত্নে করা লনের মাঝখানে চমৎকার আধুনিক বাংলো। বড় বড় কাচের জানলা তাতে। ঢোকার দরজাটিও কাঠের ফ্রেমে নক্সা করা কাচের। দু’টি ম্যাকাও ছিল আলাদা আলাদা দাঁড়ে একটি মেরুন ম্যাকাও (Ara chloroptera) এবং অন্যটি স্কারলেট ম্যাকাও (Ara macaw)। এত কাছ থেকে প্রিয়তম পাখি ম্যাকাও দেখা, তাও একসাথে দুটি – স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো লেগেছিল!

আরও পড়ুন
আমাদের কাকাবাবু

শৈলেনজ্যেঠুর মুখে শুনেছি, এগুলি তাঁর বাবারই কেনা পাখি। নিউমার্কেটের চিড়িয়া মার্কেট (যা এখন অবলুপ্ত) থেকে একসঙ্গে ৬টি বড় পাখি তিরিশ হাজার টাকায়। যার মধ্যে ২টি আমাজন এবং ২টি কোনুরও ছিল। আমি যে সময়ের কথা বলছি সেই ১৯৭৫-৭৬ সালের থেকেও সে ঘটনা আরো অন্তত ৩০ বছর আগের।

বহু নামি এবং দামি গাছ ছিল সেই বাগানে। আর একটা সাদা পোর্সেলিনের বাথটাব লাগান বাথরুম ছিল সেই বাগানবাড়িতে যার একটা দেওয়াল সম্পূর্ণ কাচের। সিলিং থেকে মাটি অব্দি টাঙানো লম্বা পর্দা সরিয়ে দিলেই বাগানের ম্যাজিক – লন, গাছপালা, পুকুর সব দেখা যেত সেখান থেকেই। যেন গোটা বাগানটাই ঢুকে পড়ত বাথরুমে!

আরও পড়ুন
দি.দা. - তিনি দিগম্বর দাশগুপ্ত

মুসাণ্ডার সব ক’টি প্রজাতি তো ছিলই সেই বাগানে আর ছিল বহু প্রজাতির বোগানভিলিয়া, জ্যাকারাঞ্জা, সাকুলেন্ট, ক্যাকটাস, অর্নামেন্টাল ফোলিয়েজ, ল্যাটিনিয়া রুব্‌রা নামের এক অতি দুর্লভ পাম গাছ। যার প্রায় নীলচে রঙের পাউডার লাগানো পাতার সীমারেখাগুলি লাল (আর তাইতো রুব্‌রা)। আরও ছিল অনেক প্রজাতির অর্কিড আর পেট্রিয়া ভল্যুবিলিস নামক ছোটো ছোটো বেগুনি থোকা ফুলের সেই লতানে গাছ। শুনেছি রবীন্দ্রনাথ যার নাম দিয়েছিলেন ‘নীলকান্ত মণি’।

ওঁর সে বাগিচায় Hedera helix variagata অর্থাৎ দু’রঙা আইভি লতা ছিল। খাঁজ কাটা সাদা-সবুজ পাতার সে এক ভারী সুন্দর গাছ। সাইকাসের যে চারটি প্রজাতি ভারতবর্ষে পাওয়া যায় (আমি Endemic বলতে চাইছি), তার মধ্যে তিনটিই ছিল তাঁর বাগানে। সাইকাস সারসেনালিসের একটি চারাও সেখান থেকে এনে লাগিয়েছিলাম আমাদের দক্ষিণের বাগানে। সে গাছ আজ উচ্চতায় এবং তার কয়েকশো অফসেটসহ বহরেও বিশাল আকার ধারণ করেছে। 

আরও পড়ুন
আলোর পথযাত্রী

ওঁদের কলকাতার বাড়ি ছিল ক্রিক রো-এ। বিশাল তিনতলা বাড়ি। অনেক লম্বা ড্রাইভওয়ে। সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ ছিল রিলিফে মা দুর্গার মূর্তি — চার ছেলেমেয়ে, বাহন সমেত।

তিনতলার ল্যান্ডিং-এর পাশে অ্যান্টি চেম্বারের মতো একটি ছোট্ট ঘরে সারাদিন ধরে বসে দুটি ধুতি ও শার্ট-কাটের পাঞ্জাবি পরা লোক নানান মাপের তুলি ও ব্রাশ বানাত। আর ঐ তিনতলাতেই ছিল ছ’ফুট লম্বা এক বিশাল ‘অল গ্লাস অ্যাকোয়ারিয়াম’। তাতে অ্যামাজন সোর্ডপ্লান্টের ফাঁক দিয়ে ঘুরে বেড়াত ইয়াব্বড় বড়ো অ্যাঞ্জেল, টাইগার আর শার্পে টেট্রার ঝাঁক।

তিনতলার বসবার ঘরটিতে মাঝে ছিল মেহগনি কাঠের সোফাসেট, সেন্টার টেবল ইত্যাদি। আর চারিদিকের দেওয়াল ঘিরে ছিল ১৬-১৭টি বার্মাটিকের বড়ো বড়ো কাচ লাগানো আলমারি বা ডিসপ্লে ক্যাবিনেট। সেই সমস্ত আলমারি ভর্তি সারা পৃথিবীর সেরা পোর্সেলিন ডলস্‌ - বিভিন্ন দেশের, আলাদা আলাদা আলমারিতে। জ্যেঠুর সারাজীবনের সংগ্রহ। কেবল তাকিয়ে থাকলে দিন কেটে যায়।

আমরা ওঁর বাগানবাড়িতে ঘুরে আসার বেশ কিছুদিন পর শৈলেনজ্যেঠু একদিন এলেন আমাদের বাড়ি। খুব কুণ্ঠা নিয়ে একটি অ্যাস্ট্রোফাইটাম অ্যাস্টারিস-এর চারা চাইলেন আমার কাছে। বললেন, ‘আলো আমায় একটা চারা দেবে?’

আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বলি, ‘আপনার যেটা পছন্দ হয় নিয়ে যান’। খুব খুশি হয়েছিলেন।

সেই মানুষটা অসময়েই চলে গেলেন একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে। অসুস্থ অবস্থাতেও বাবার কাছে লোক মারফৎ খবর পাঠিয়েছিলেন যেন আমি তাঁর ম্যাকাও দুটি এবং তাঁর বাগানের দুর্লভতম দুটি গাছ - ল্যাটিনিয়া রুব্‌রা (পাম) ও ক্যাটেলিয়া ভ্যারাইগাটা (অর্কিড) নিয়ে আসি। আমি পারিনি।

Powered by Froala Editor