অম্বুদা— যিনি একাই তিনশো

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে  - ১৮

আগের পর্বে

বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্কুলের অভিভাবক অমরদার মামা তিনি। কোনো সাহিত্যসভায় বা অমরদার সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সংযত, আত্মমর্যাদা-সম্পন্ন একজন মানুষ। আমাদের কাকাবাবু হলেও তিনি ছিলেন বন্ধুস্থানীয়। 'ঋতি' নামের একটি সাহিত্যপত্র প্রকাশ করতেন তিনি। সকলের লেখা নিয়েই সেখানে সমালোচনা হত, প্রশংসাও হত মুক্তকণ্ঠে। কাকাবাবু সবসময় চাইতেন আমরা যেন বেশি করে লেখা পড়ি, ভাল লিখি আরও। তবে নিজে বাড়ির থেকে সাহিত্যচর্চায় সমর্থন পাননি সেভাবে। তবুও দুই পৃথিবীর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন চিরকাল। তারপর...


১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাস। হাওড়া ষ্টেশানের প্ল্যাটফর্মে বসে আছি আমরা, মানে বেঙ্গল আর্চারি টিম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু তফাতে বসেছে খোখো এবং কবাডি টিমও। যাচ্ছি অন্ধ্রপ্রদেশের বিজওয়াড়ায় নবম সর্বভারতীয় ক্রীড়ায় অংশ নিতে। 

ক্রীড়া প্রতিযোগিতা তখন চারটি ডিসিপ্লিনে হত সর্বভারতীয় — কবাডি, খোখো, তীরন্দাজি ও কুস্তি। গোবর গোহ-র রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ কুস্তিতে অংশ নিত না।

যাই হোক সবাই অপেক্ষা করছি ট্রেনের। কিন্তু ঘোষণা হয়ে গেলেও ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস তখনও প্ল্যাটফর্মে দেয়নি।

যেহেতু দক্ষিণ ভারত যাওয়া, তাই উত্তর-পূর্ব ভারতের দলগুলিও, যেমন আসাম, মণিপুর, মিজোরাম এরাও অপেক্ষারত ঐ একই ট্রেনের জন্য। একই প্ল্যাটফর্মে। 

এরই মধ্যে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে আমাদের লাগেজ, ইকুইপমেন্ট ও অন্যান্য জিনিসপত্র গোনাগুনতি করছিলেন। হঠাৎই দেখা গেল উনি হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকে চোখের বাইরে চলে গেলেন। এর একটু পরেই ওনাকে ফিরতে দেখা গেল হাতে ঝোলান বেশ কয়েকটি ওয়াটারবটল-সহ। আমাদের ট্রেনে তুলে দিতে যাওয়া অভিভাবকদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন করেছিলেন — ‘এতগুলো ওয়াটারবটল্‌ কোত্থেকে নিয়ে এলেন?’

আরও পড়ুন
আমাদের কাকাবাবু

‘আসলে গুনে দেখলাম যে আমার বাচ্চাদের ওয়াটারবটল্‌ কয়েকটা কম আছে। এতটা রাস্তা যেতে হবে তো! তাই এখান-ওখান থেকে কয়েকটা সংগ্রহ করে আনলাম।’ তাঁর সাফ উত্তর। এই হলেন শ্রী অসিত বিশ্বাস। আমাদের অম্বুদা। এখানে উল্লেখ থাক যে তখন Mineral water-এর এত চল ছিল না। নিজের খাবার জল নিজেকেই বহন করতে হত। প্ল্যাটফর্ম তো দূরস্থান, গোটা হাওড়া স্টেশানে একমাত্র ক্যাফেটেরিয়াতে পাওয়া যেত এবং তা কিনতে ও খেতে দেখা যেত কেবল ভারত ঘুরতে আসা ইয়াংকি ও অন্যান্য বিদেশীদের।

অম্বুদা অকৃতদার মানুষ। খেলা অন্ত প্রাণ। খেলোয়াড়দের সন্তান স্নেহে দেখতেন। খেলা এবং খেলোয়াড়দের নিয়েই ভালোবেসে কাটিয়ে দিলেন একটা জীবন।

ওঁর হাতে তৈরি ঐক্য সম্মিলনী ক্লাব এক সময় ফার্স্ট ডিভিসান ফুটবলে ময়দান কাঁপাত। পরে তীরন্দাজি শেখেন এবং এই খেলার সংগঠন তৈরি ও প্রসারেই নিবেদিত প্রাণ হয়ে যান। সাউথ সিঁথিতে ‘ক্যালকাটা আর্চারি ক্লাব’-এরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন উনি।

আরও পড়ুন
দি.দা. - তিনি দিগম্বর দাশগুপ্ত

ডানলপ থেকে শ্যামবাজার যাবার পথে মরকৎকুঞ্জের পরে এবং পেট্রল পাম্পের আগে বি.টি. রোড থেকে বাঁদিকে যে রাস্তাটি ঢুকে যাচ্ছে, সে রাস্তায় বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অম্বুদার বাড়ি। স্মৃতি যদি ভুল না করে তাহলে বলি ঐ রাস্তাতেই অম্বুদার একটি ছোটোখাটো মুদির দোকান গোছের ছিল। তবে সেটি প্রায় কৈফিয়ৎ ছিল। জীবন ছিল খেলা, খেলা এবং খেলা!

সে যাই হোক শেষ পর্যন্ত ট্রেন তো দিল প্ল্যাটফর্মে এবং আমরা অর্থাৎ বেঙ্গল টিমের ছেলেমেয়েরা হৈ হৈ করে উঠে পড়লাম আমাদের জন্য বরাদ্দ কামরায়। তা সব মিলিয়ে ষাট-পঁয়ষট্টি জন্য তো হবই, খোখো, কবাডি ও তীরন্দাজির ছেলে ও মেয়েদের দল, তাদের অফিসিয়ালরা ও সবার উপর অম্বুদা। তিনিই কন্টিনজেন্ট লিডার। তখন অন্য রাজ্যে খেলা পড়লে দলের জন্য একটা গোটা কামরাই বরাদ্দ হত — এখনকার মতো জনে জনে বার্থ বা সীট ধরে রিজার্ভেশান নয়। সে কামরাও তেমনই। গদির বালাই নেই, শক্ত কাঠের সিট। তাতেই পালা করে ঘুমোনো। তবে দুদিকের দরজাগুলি বন্ধ করে দিলে পুরো কামরাই নিজেদের দখলে। বড়দের, অর্থাৎ আমাদের দায়িত্বে দরজাগুলির পাহারা - বন্ধ-খোলা ইত্যাদি। স্টেশান আসার আগে বন্ধ করা যাতে অন্য কেউ জবরদস্তি উঠে না পড়ে। বাকি সময় দরজায় বসে পাদানিতে পা রেখে দুপাশের চলমান দৃশ্য দেখা। আর অম্বুদার নির্দেশ মতো খাওয়ার পরে সব চায়ের ভাঁড় ফেলে না দিয়ে জানলার পাশে জমিয়ে রাখা— যদি আত্মরক্ষায় প্রয়োজন হয়।

ভোরের চিল্কার পাশ দিয়ে ছুটে যায় ট্রেন, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যায় দুপাশের সবুজ সীমাহীন সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে রায়লসীমার দিকে। অম্বুদা সবার জন্য খাবারের অর্ডার দেন। পরের জাংশান স্টেশানে এসেও যায় রেলওয়ে ক্যাটারিঙের লোকজন। প্রথম ছোটরা খায় তারপর আমরা ও অম্বুদা। সবই অম্বুদার অভিভাবকত্বে, স্নেহচ্ছায়ায়!

আরও পড়ুন
আলোর পথযাত্রী

ট্রেন ছুটতে থাকে দু’পাশের ঘন সবুজ ফেলে লালমাটির বুক চিরে, ক্রমাগত পিছনে ফেলে ছোট ছোট রেল স্টেশান — যাদের টালির বিভেলশেডের একেবারে নীচে কাঠের বল্লম ডিজাইনের নক্‌সা ঝুলছে। এসব স্টেশানের প্ল্যাটফর্মগুলি তখনও বেজায় নীচু। তাই আমরাও দিব্য দু’পা ঝুলিয়ে বসে থাকছিলাম দরজায়। এভাবেই উড়িষ্যা (তখনও ওড়িষা নয়) ও অন্ধ্র উপকূল হয়ে ইস্ট কোস্ট আমাদের পৌঁছে দেয় পূর্বঘাট গিরিমালার কোলে বিজয়ওয়াদা (তখন বিজয়ওয়াড়া নয়) নামক পাহাড়ি মফঃস্বল শহরটিতে।

শহরের ঠিক বাইরে পাহাড়ের গায়ে সদ্য গড়ে ওঠা এবং তখনও চালু না হওয়া সিদ্ধার্থ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেঝেতে মার্বেল লাগানো পাকা বাড়ি। বিরাট বিরাট ঘর প্রায় হলের মতো। প্রশস্ত করিডর। দুবেলাই বুফেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। সরকারি আতিথেয়তা — কাজেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। অন্ধ্রপ্রদেশে তখন কংগ্রেস সরকার। মুখ্যমন্ত্রী এম. চেন্না রেড্ডি। এন.টি. রামা রাও তখন অভিনয় করছেন। টি.ডি.পি. অর্থাৎ তেলেগু দেশম পার্টি জন্মায়নি।

কেবল কলেজের স্নানাগারগুলি তখনও সম্পূর্ণ না হওয়ায় আমাদের জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বড় মাঠের একপাশ ধরে সারি দিয়ে পায়খানা তৈরি করা হয়েছিল — যার দরজার জায়গাগুলিতে পাল্লার পরিবর্তে চট টাঙানো। আর তারপরেই লম্বা পাইপ টেনে পরপর অন্তত ৩০-৪০টি জলের কল লাগানো — বেশ উপর থেকে। তো সেই উঁচু পাইপেরই একদিকে গামছা টাঙিয়ে রেখে কেবলমাত্র নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাসটি পরে আমরা ছেলেদের পুরো টিম স্নান করতাম :

‘লাইফবয় যেখানে
স্বাস্থ্যও সেখানে...’ গাইতে গাইতে।

এসব অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকের কাছেই নতুন ছিল। কিন্তু মানিয়ে নিতে যে একটুও অসুবিধা হয়নি তা ঐ মানুষটির জন্য। মানিয়ে তো নিয়েইছিলাম বরঞ্চ বেশ উপভোগই করেছিলাম সেসব ব্যাপারগুলি।

অফিসিয়াল হিসাবে তাঁর জন্য একেবারেই আলাদা বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও উনি টিমের সঙ্গেই থাকতেন, খেতেন, শুতেন। প্রত্যেকদিন স্নান এবং ব্রেকফাস্টের পর ভ্যান রিক্সায় ইকুইপমেন্ট নিয়ে আমাদের সঙ্গে স্টেডিয়ামেও যেতেন অম্বুদা।

এভাবেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বাড়তে থাকে স্কোর এবং উত্তেজনার পারদ। প্রত্যেকদিন। দ্বিতীয় দিন থেকেই আমরা নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী মণিপুরের থেকে লিড অনেকটা বাড়িয়ে নিই। তবুও চাপ একটা ছিলই। তৃতীয় দিনও কাটে ‘উতর্‌ চড়াও’-এ। চতুর্থ অর্থাৎ প্রতিযোগিতার শেষ দিন সক্কালে অম্বুদা এসে জানতে চান ‘কিরে কেমন নামালি?’ মানে ‘পটি’ কেমন হয়েছে। সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্যে শেষ দিন সকালে জিজ্ঞেস করার মতো প্রশ্ন বটে! তবু আমরা বলি ‘চমৎকার’!

অম্বুদা বলেন ‘তবে আর চিন্তা কী! বিকেলে P.D. (প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশান)-তে আমরাই ট্রফি তুলব!’ সেদিনের খেলা শেষে বেঙ্গল বয়েজ অ্যান্ড গার্লস টিম কম্পিটিশানের মোট ২১টি পদকের মধ্যে ২১ই জিতে নেয়। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী মণিপুরকে বিরাট ব্যবধানে হারিয়ে উইনার্স ট্রফি দুটিও।

সন্ধ্যায় প্রাইজ নেবার জন্য আমরা যখন স্টেডিয়ামে ঢুকছি মাইকে নাম ঘোষণা হচ্ছে টিমের এবং আমাদেরও। গোটা বিজয়ওয়াড়া স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়েছিল আমাদের সম্মানে! Standing Ovation! অম্বুদা আমাদের কাছে জড়ো করে নিয়ে বলেছিলেন ‘কীরে, বলেছিলুম? কনস্টিপেশান নিয়ে অল ইন্ডিয়া জেতা যায় না!’

এরপরে কল্যাণী স্টেট মিট, দাসনগর স্টেট মিট, বিভিন্ন ক্লাব ও ইন্টার ক্লাব কম্পিটিশানে অম্বুদা আমাদের মাতিয়ে রাখতেন, মুগ্ধ করতেন তাঁর নিজস্ব হ্যালোয়! সেভেন ট্যাঙ্কস্‌ লেনে কাশীপুর এস্টেটের ভিতর সেবার স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপ হচ্ছে। লং ডিস্টেন্স অর্থাৎ ৯০ মিটার ও ৭০ মিটারের কম্পিটিশান হয়ে গেছে। এরপর লাঞ্চ ব্রেক এবং তারপর ৫০ ও ৩০ মিটারের প্রতিযোগিতা। ৩০ মিটারে তখন বড়রা অনেকেই ৩৪০ পয়েন্টের ভিতর ৩০০-র উপর মারছেন। কিন্তু সেবার সম্ভাবনা আছে আমাদেরও দু’একজনের ৩০০+ স্কোর করার।

খেতে বসেও নিজের উত্তেজনা কাবু করার চেষ্টা করছি। দূর থেকে বোধহয় দেখছিলেন। এগিয়ে আসেন অম্বুদা। বলেন ‘কি এত ভাবছিস গৈরিক? আর দুটো তপসে ফ্রাই খা! কি সাইজ দেখেছিস, আর একটু ছোট বড় হলে আর এই টেস্ট হবে না।’

আমি বারণ করি, উনি শোনেন না। হাঁক দেন ‘এই গৈরিককে আরো দুটো তপ্‌সে দে তো’। আমাকে বলেন ‘৩০০ মারার জন্য সারাজীবন অনেক কম্পিটিশান পাবি, কিন্তু এমন তপ্‌সে আর পাবি?’

এভাবেই টেনশান কমিয়ে দেন আমার। যাই হোক সেবার ৩০ মিটারে ৩০০-র উপরেই স্কোর করেছিলাম। প্রথমবার!

এসবের বহু বছর পর একবার হঠাৎ করেই দেখা ওঁর সঙ্গে উল্টোডাঙ্গার হাডকো মোড়ে। আমি সল্টলেকে একটা কাজ সেরে ফিরছিলাম আর অম্বুদা যাচ্ছিলেন বিধান শিশু উদ্যানে। উনি তখন শিশু উদ্যানে ছোটদের তীরন্দাজি শেখাতেন এবং অন্যান্য কাজেও জড়িয়ে থাকতেন। উনিই দেখতে পেয়ে ডেকেছিলেন ‘গৈরিক না!’ আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করি। অনেক পুরনো কথা হয়। অম্বুদাকে বলি ‘চলুন না ভি.আই.পি.তে দই খেতে খেতে কথা বলি!’ দই খেলাম দুজনে, গল্পও হল অনেক কিন্তু কিছুতেই টাকা দিতে দিলেন না, রোজগেরে আমাকে। উনিই দিলেন।

সেই শেষবার দেখা। সেও তো বিশ বছর হয়ে গেল প্রায়। অম্বুদা কি বেঁচে আছেন? থাকলে কেমন আছেন?

কিছুই জানি না। জানতে চাইও না। কারণ আজও বাজারে তপসে মাছ দেখলে অম্বুদার কথা মনে পড়ে। পথে তেষ্টা পেলে ব্যাগ হাতড়ে জলের বোতল না পেলেও মনে তিনিই হাজির হন ওয়াটার বটল হাতে!

Powered by Froala Editor