আমাদের কাকাবাবু

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে  - ১৭
আগের পর্বে

দীগম্বর দাশগুপ্ত, সংক্ষেপে দি.দা.। প্রায় আড়াই দশক আগে কবি দীপ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ‘ব্যঙ্গমা’র সভায় আলাপ তাঁর সঙ্গে। প্রথম দিন থেকেই কাছে টেনেছিলেন তিনি। উদার প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনা করতেও তিনি পিছপা হতেন না। দিগম্বরদা ছিলেন বহু-ভাষাবিদ, প্রযুক্তিবিদ, জাদুপ্রেমী, অভিযাত্রী, সুলেখক, ছড়াকার, ক্যালিগ্রাফার এবং অসাধারণ চিত্রশিল্পী। রঙিন দিগম্বরদার পৃথিবীটা ছিল বিরাট। বিভিন্ন পেশা আর নেশার মানুষকেই তিনি জায়গা করে দিতেন ‘ব্যঙ্গমা’-য়। বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বারবার তাঁর চিঠি গলিয়ে দিত অভিমান। সম্প্রতি বন্ধু প্রদীপ দেববর্মনের পাঠানো ‘সুসারথি’র শারদ সংখ্যা থেকেই জানতে পারি দিগম্বরদা চলে গেছেন গত জুন মাসেই।

শ্রী অমর চট্টোপাধ্যায় আমার স্কুলের অভিভাবক ছিলেন। পেশায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই গ্রন্থাগারিক। অত্যন্ত রসিক, আগ্রাসী পাঠক এবং সাহিত্যানুরাগী। তাঁর পুত্র অর্কব্রত ও কন্যা অদিতি — দুজনেই আমার ছাত্র-ছাত্রী ছিল। তিনি বয়সে আমার চেয়ে কিছু বড় হলেও, আমাদের ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সম্ভবত তাঁর সূত্রেই প্রথম আলাপ শ্রী বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অমরদার মামা তিনি।

আবার এমনও হতে পারে যে বিশ্বনাথবাবুর সঙ্গে প্রথম পরিচয় মাখলার সমতা পরিষদের সাহিত্যসভায়। অনেকদিন আগের কথা, এখন আর সঠিক মনে নেই।

স্থানীয় সাহিত্য সংগঠনগুলির সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। তিনি যেতেনও তাদের সাহিত্যসভায়, পত্রিকা প্রকাশের জন্য চাঁদা ইত্যাদিও দিতেন কিন্তু খুব একটা জড়িয়ে পড়তেন না। এমনই কোনো একটি সভার জমায়েত শেষে উনি আমায় আলাদা ডেকে বললেন, ‘গৈরিক তুমি আমাদের ‘ঋতি’র সাহিত্যসভায় আসবে? তোমাকে পেলে আমাদের ভালো লাগবে!’

আমি বিশেষ চিন্তাভাবনা না করেই রাজি হয়ে যাই এবং যেতে শুরু করি ‘ঋতি’র সাহিত্যসভায়।

আরও পড়ুন
দি.দা. - তিনি দিগম্বর দাশগুপ্ত

বিশ্বনাথবাবুই আরো কয়েকজন সাহিত্যানুরাগীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯০ নাগাদ ‘ঋতি’ নামে এই সাহিত্যগোষ্ঠী তৈরি করেন এবং ঐ একই নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতে থাকেন। সে পত্রিকার ক্যাচলাইন হল ‘ঋতি – অনিয়মিতভাবে নিয়মিত প্রকাশিত’।

আরও পড়ুন
আলোর পথযাত্রী

ওঁরা আমাকেও সদস্য করে নেন। আমাকে যা প্রথমেই অবাক ও আকর্ষিত করেছিল তা হল এই গোষ্ঠীর প্রত্যেক বৈঠকে যোগদানকারী সকলের লেখা নিয়েই তৎক্ষণাৎ সমালোচনা করার রেওয়াজ। লেখককেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হত। এর মানে অবশ্যি এই নয় যে ভালো লাগলে প্রশংসা করা হত না, তাও করা হত মুক্তকণ্ঠে। নিঃসন্দেহে খুবই স্বাস্থ্যকর অথচ সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল এটি। পরস্পরের পিঠ চুলকে দেওয়ার সংস্কৃতি ছিল না। যদিও এই কারণেই সদস্য সংখ্যা যথেষ্ট কম ছিল। তবে যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই উপকৃত হতেন এই ব্যবস্থায়। 

ঋতি’তে প্রাণপুরুষ বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও ছিলেন স্বপন মজুমদার, অমর চট্টোপাধ্যায়, রনজিৎ মল্লিক, মিতা চট্টোপাধ্যায়, সুনীল বরাট, অমিতা চট্টোপাধ্যায় ও আরও কয়েকজন। মাসিক আসর বসতো মাসের শেষ রবিবার সন্ধ্যায়। এক একবার এক এক সদস্যের বাড়ি।

আরও পড়ুন
ঘোর লাগা সেই ভোরবেলায়

এরই মধ্যে অমরদার মামা কবে কবে যেন আমাদের কাকাবাবু হয়ে যান। স্নেহ, ভালোবাসা তো ছিলই। সঙ্গে ছিল তাঁর স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের অমোঘ আকর্ষণ। বহু তুলনামূলক নামি জায়গায় পাঠ বাদ দিয়ে নিয়মিত ‘ঋতি’র সভায় গিয়েছি এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই — উপকৃতই হয়েছি।

আরও পড়ুন
এক সংসারী ও এক সন্ন্যাসীর গল্প

সব সভায়, প্রতিটি আসরেই নিজেকে একটু আড়ালে রাখতেই ভালোবাসতেন আমাদের কাকাবাবু। আজ বুঝতে পারি তিনি সব সময়েই চাইতেন যেন আমরা আরো পড়ি, আমরা আরো ভালো লিখি, নিজেদের জন্য নিজস্ব লক্ষ্য স্থির করি এবং এগিয়ে যাই। ওঁর অবস্থান ছিল অভিভাবকের মতো, শিক্ষকের মতো। তবে সবটাই ভীষণ প্রচ্ছন্নভাবে।

আলেকজান্দ্রা কে ট্রেনফর-এর সেই বিখ্যাত উক্তিটির মতো, ‘The best teachers are those who show you where to look but don’t tell you what to see.’

আয়তাকার কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত, দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষটি তাঁর সদ্য প্রকাশিত কোনো বইয়ের কপি অথবা নিছকই ঋতি’র পরবর্তী সভার খবর দিতে এসে নিজের সাইকেলটিসহ আমার স্কুলের গেটেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন। যখন নিজেও জানতেন যে সেই স্কুলের হেডমাস্টার তাঁকে কত শ্রদ্ধা করে। এতটাই সংযত, বিনয়ী ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। একটুও কি শিখতে পেরেছি? কে জানে?

উত্তরপাড়া রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ইংরাজিতে এম.এ. করেছিলেন। কিন্তু শুনেছি কর্মজীবন শুরু করেন গাড়ির গ্যারাজে কাজ করে। 

এরপর পরীক্ষা দিয়ে মেদিনীপুরের গড়বেতায় স্কুল ইন্সপেক্টারের চাকরি। এই সময়েই কাছ থেকে দেখেন আদিবাসী জীবন। কিন্তু স্থানীয় এক অর্থবান মাতব্বরের সরকারি শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে নিয়ত খবরদারি বরদাস্ত করতে না পেরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সে কাজে ইস্তফা দেন।

এরপর যোগ দেন খড়গপুরে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের স্কুলে — শিক্ষক হিসাবে। সেই স্কুলের স্কাউটমাস্টারও ছিলেন তিনি। ছাত্রদের নিয়ে বহু ক্যাম্প, কম্পিটিশান ও এক্সপিডিশান করেছেন – রাজ্যে এবং রাজ্যের বাইরেও।

কমিউনিস্ট পার্টি করেছেন সক্রিয়ভাবে। কিন্তু দল ভাগ হয়ে যাবার পর একদিনও নয়। যদিও বিশ্বাসে থিতু ছিলেন বরাবর। যেহেতু কুপমণ্ডুক ছিলেন না তাই ততদিনই সঙ্গ দিয়েছেন দলকে যতদিন গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হত, সিদ্ধান্তের গণতন্ত্রীকরণ নয়।

সাহিত্য ব্যতীত অন্যান্য বিষয়েও সকলের মতামত জানতে চাইতেন। ওঁর মধ্যে একটা ‘যাবৎ বাঁচি, তাবৎ শিখি’, মানসিকতা লক্ষ্য করেছি সব সময়। এ জিনিস সবার আয়ত্ব নয়।

বেশ কম বয়সেই বি.এড. পড়তে বর্ধমানে গিয়েছিলেন। সেখানেই আলাপ, ভালোবাসা ও বিবাহে পাওয়া জীবনসঙ্গীনীকে।

কিন্তু তাঁর সাহিত্যপ্রেম, সাহিত্যচর্চা বা বাইরের পৃথিবীতে তাঁর বিপুল সক্রিয়তায় বিশেষ সমর্থন পাননি পরিবার থেকে। তবে তা নিয়েও কাকাবাবুর কোনোদিন কোনো অভিযোগ ছিল না। বরাবর হাসিমুখে রেশন তোলা, বাজার করা, সকল নিকটজনের খবর নেওয়া — করে গেছেন।

আশ্চর্য দক্ষতায় ভারসাম্য বজায় রেখেছেন নিজ সংসার ও বিশ্বসংসারের। 

আমরা অবাক হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি তাঁকে দেখে — বারংবার।

আর কাকাবাবু তাঁর লেখনীতে ভারাক্রান্ত সাক্ষর রেখেছেন :

‘নদী যদি দুকূল ভাঙার সাহস পেত
আজকে তো নয়, কবেই একটা সাগর হত!’

Powered by Froala Editor