ঘোর লাগা সেই ভোরবেলায়

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ১৪

আগের পর্বে

১৯৮৯ সালে বেলুড় শিক্ষক শিক্ষণ মন্দিরে আলাপ শিশির মহারাজের সঙ্গে। তিনি তখন হোস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট। নিয়মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন তিনি। গান গাইতেন দরাজ গলায়। হোস্টেলের বাকিদের চেয়ে আমার বয়স ছিল কিছুটা বেশি। মহারাজ তাই একটু বেশিই খাতির করতেন আমাকে। তাঁর সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যস্থতার কাজটাও করতাম হাসিমুখে। আমার তখন বাড়িতে ছোট সন্তান। ছুটির দিনে গোপনে বাড়ি যাওয়ার সুযোগও করে দিয়েছিলেন মহারাজ। তিনি ছিলেন সন্ন্যাসী, আর আমি ঘোর সংসারী। তবু যোগাযোগ ছিল বহুদিন। আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে এবং বাড়িতেও এসেছেন। সদা হাস্যময় মানুষটি জানতে দেননি তাঁর মুখের ‘পার্সিয়াল প্যারালিসিস’-এর কথা।

১৯৬৮-র মফস্বল উত্তরপাড়া। স্থানান্তরিত হয়ে এসেছি থাকব বলে। মামাবাড়ির শহর। আমাদের ভাড়া বাড়ির একদিকে রাস্তা, তিনদিকে বাগান। খানিক পাকা, খানিক টালির বাংলো বাড়ি। বাগানে বল্লম ডিজাইনের কাঠের সাদা গেট। বড়ো একটা আম গাছ। বাকি বাগান বাবার সঙ্গে একটু একটু করে সাজাচ্ছি আমরা। মাঝে লন, এবং তাকে ঘিরে চারপাশে জবা, গোলাপ ও পাতাবাহার গাছ। ঘিয়ে রঙের গোলাপ ‘পিস’, দু’রঙা ‘মন্টিজুমা’, প্রায় কালো ‘নিগ্রেটি’- সব গাছ খুবই দুর্লভ ছিল তখন। আর ছিল ‘ড্যাফোডিল’ নামের হলুদ রঙের পঞ্চমুখী জবা।

প্রাক সত্তরের সে শহরতলিতে ভোরবেলায় নগর সংকীর্তনে বেরত একদল মানুষ – খোল ও খঞ্জনি নিয়ে, প্রতিদিন। গঙ্গা পাড়ের শহরে গঙ্গাস্নানে নিয়মিত যেত বহু লোক। কিন্তু এসবেরও অনেক আগে আমাদের ঘুম ভাঙত মায়াময় এক বাঁশির সুরে। আমাদের বাড়ির গায়ে যে রাস্তাটি পশ্চিমে, তার সমান্তরাল আরেকটি রাস্তা, শান্তিনগর রোড। মাঝে কেবল একটি মাঠ ছিল (আজ আর নেই)। সেই রাস্তাটি সোজা গিয়ে যে বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁক নিয়ে আবার সোজা হয়ে এগিয়ে গেছে সেটিই ওঁর বাড়ি। সেই বাড়িরই দোতলার বারান্দার দাঁড়িয়ে নিজের আড়বাঁশিতে অপার্থিব সব সুর তুলে ভোর নিয়ে আসতেন মোহিতমামু। শ্রী মোহিত কুমার সিংহরায়। দশাসই চেহারা, একমাথা বাবরি চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, সাদা পাঞ্জাবি ও ধুতি পরতেন। শীতে ওই সঙ্গে জহরকোটও। আমরা মোহিতমামুই বলতাম।

মূলত জমিজমা কেনাবেচারই কারবার ছিল তাঁর। আর ছিল স্টিলের আলমারি তৈরির কারখানা। উত্তরপাড়ার এ অঞ্চলের বসতিটি ওঁর হাত ধরেই শুরু হয়। নিজের বিএসএ সাইকেলে চেপে দু’বেলা পুরো অঞ্চল টহল দেওয়া ওঁর অভ্যাস ছিল। ওঁর সাইকেলের বেলটিও ছিল বেশ অন্যরকম। সাধারণত সাইকেলে বাটির মতো যে ঘণ্টাটি হয়, ওঁর সাইকেলে তা ছিল আলাদারকম। দুটি বাটি জুড়ে দিলে যেমন গোল বলের মতো হয়, অনেকটা তেমন দেখতে।

আওয়াজ অন্যান্য সাইকেলের মতো ক্রিং ক্রিং শব্দে হত না, হত টিরিরিং, টিরিরিং করে। বাঁকের ওপাশ থেকেও বোঝা যেত যে মামুই আসছেন।

আরও পড়ুন
এক সংসারী ও এক সন্ন্যাসীর গল্প

হুগলির ভাণ্ডারহাটির মানুষ ওঁরা। কিন্তু গড়গড় করে বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। এ রহস্যের সমাধান হয় যখন জানতে পারি যে মামু এবং ওঁর অন্যান্য ভাইবোনেরাও মানুষ হয়েছেন কুমিল্লায় ওঁদের ঠাকুমার বাপের বাড়িতে থেকে। ঠাকুমার বাবা রায় বাহাদুর ছিলেন।

যদিও আদিতে সিংহরায়রা রাজপুত। অর্থাৎ মাড়োয়ার অথবা রাজস্থানের লোক। বিয়েতে রাজবেশের সঙ্গে এখনও তলোয়ার নিতে হয় তাদের এবং বরকে চড়তে হয় ঘোড়াতেও।

আরও পড়ুন
চিত্রকারের বিচিত্র কথা

ছেলেদের ভালো নামে ক্ষত্রিয় ছোঁয়া দিয়েছিলেন মোহিতমামু। তাদের নাম বিক্রমজিৎ (ঝুনুদা), সংগ্রামজিৎ (বাবলুদা), ইন্দ্রজিৎ (পিনুদা) ও স্বরজিৎ (লাট্টু)। তবে সঙ্গে সুরও দিয়েছিলেন তাদের। ঝুনুদা পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান বাজাত, বাবলুদা ড্রাম সেট, পিনুদা স্প্যানিশ গিটার ও লাট্টু কঙ্গো বাজাত। আর সঙ্গে মূলত আশার গান গাইত ওদের ছোট বোন চমা। আর এই সম্মিলিত প্রয়াসের নাম ছিল ‘সিংহরায় অর্কেস্ট্রা’। বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যেই অথচ আলাদা একতলা বৈঠকখানায় তাদের প্র্যাকটিস হত।

এদের মধ্যে বড় ভাই ঝুনুদা সত্যিই ভালো বাজাতেন পাশাপাশি ‘বেলো’ করা সেই অদ্ভুত যন্ত্রটি — পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান। রাতের কলকাতায় তার নিয়মিত অনুষ্ঠান থাকত।

আরও পড়ুন
বন্দুক, উপত্যকা ও রানা পরিবারের গল্প

মোহিতমামুর ছোট ভাই তড়িৎমামু, তড়িৎ কুমার সিংহরায়ও শিল্পী ছিলেন। তিনি চাকরিও করতেন লোকরঞ্জন শাখায় শিল্পী হিসাবেই। সব ধরণের তারের যন্ত্র (স্ট্রিং ইনস্ট্রুমেন্ট) বাজাতে পারতেন তিনি। তাঁর পুত্র প্রভঞ্জন সিংহ রায় (ভঞ্জু) এবং মোহিতমামুর ছেলে লাট্টু আমার সমবয়সী ও খেলার সাথী ছিল। লাট্টু পরে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

মোহিতমামুর তখন ভালোই প্রতাপ এতদাঞ্চলে। জমিজমা, আলমারি কারখানা ছাড়াও রয়েছে এক বিরাট পুকুর। তখন তো বটেই, আজও তা মোহিতবাবুর পুকুর নামেই পরিচিত। আমাদের ছেলেবেলায় সে পুকুর একবার নতুন করে কাটানো হল। প্রথমে পুকুরের সমস্ত জল পাম্প করে ফেলে দেওয়া হল। তারপর ধাপে ধাপে রাস্তা কেটে নিচ অবধি নেমে আবার নতুন করে গভীর করা হল সেই পুকুর। দু’একদিনেই তা আবার কানায় কানায় ভরে উঠল জলে।

আরও পড়ুন
পি’থ্রি = তিনি পতিতপাবন পাঠক

মোহিত সিংহরায়-এর বাড়ি

 

সে সময়ে ভোরের গঙ্গায় স্নান করতে যেতেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অনেকেই এর ওর বাগান থেকে হাত দিয়ে টেনে অথবা আঁকশি দিয়ে ফুল তুলে নিয়ে যেতেন বাড়ির পুজোর জন্য। যাঁর বাগানের ফুল তাঁকে জিজ্ঞেস করার অথবা অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করতেন না।

আরও পড়ুন
রাম-রাজত্ব

একদিন বেশ ভোর ভোর রাস্তায় চিৎকার শুনে বাবা-মার সঙ্গে আমরাও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি মোহিতমামু গঙ্গাফেরৎ এক স্নানযাত্রীকে তারই গামছা গলায় জড়িয়ে টেনে ধরেছেন। আর বলছেন, ‘লজ্জা করে না লোকের বাগান থেকে না বলে রোজ ফুল তুলে নিয়ে যেতে। এমন হলুদ রঙের পঞ্চমুখী জবা কোনোদিন দেখেছো? জামাই (ভগ্নীপতিকেও সেসময়ে জামাই বলার রেওয়াজ ছিল) কত কষ্ট করে জোগাড় করে যত্ন করে তার ফুল ফুটিয়েছে। আর তুমি রোজ না বলেই সেই ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছ! তোমার ওই চুরির ফুল ঠাকুর নেবেন ভেবেছ?’ কোনোরকমে মামুকে শান্ত করে তাকে মুক্ত করা হয়। এমনই মানুষ ছিলেন তিনি। সকলকে ভালোবাসতেন। এক অভিভাবকের মতো উপস্থিতি ছিল তাঁর। 

গুণী শিল্পী মোহিত কুমার সিংহরায় নিয়মিত বাঁশি বাজিয়েছেন নিউথিয়েটার্স স্টুডিয়োতে। এমনকি বাজিয়েছেন কাননবালার গানের সঙ্গেও। মোহিতবাবুর মেজছেলে বাবলুদা দুঃখ করছিলেন ‘কাননদেবীর সঙ্গেও বাবার ছবি ছিল। আমরা দেখেছি সে ছবি। কিন্তু আমরা সে ছবি যত্ন করে রক্ষা করতে পারিনি।’

আরও পড়ুন
ক্যাকটাস চর্চার পিতামহ

এছাড়াও ভোরবেলায় আকাশবাণীর অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় যে বাদনটি দিয়ে, তাতেও রয়ে গেছে তাঁর বাঁশির সুর।

আমাদের শিশুকালে সুরে সুরে ভোর এনে দেওয়া মানুষটি মধ্য পঞ্চাশে একদিন ভোরেই চলে গেলেন। সেটা ১৯৭৪-এর গ্রীষ্ম। সকালে বেরিয়ে আমরা দেখতে পেলাম মাথা নিচু করে গালে হাত দিয়ে বাড়ির বৈঠকখানার বাইরের রোয়াকে বসে রয়েছে বড় ছেলে ঝুনুদা। আর মামুকে শেষযাত্রায় নিয়ে যেতে খাটিয়া নয় এক বিশাল পালঙ্ক আনা হয়েছে।

আরও পড়ুন
সবুজ দ্বীপের রাজা

আজও অবাক করে একথাই যে জমিজমার কারবারি সেই আদ্যন্ত বিষয়ী মানুষটিও  দূর-রাখালের বাঁশির সুরটি শুনতে পেয়েছিলেন এবং শোনাতে চেয়েছিলেন আমাদেরও। 

আমাদের শহরতলি তখন বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। আমরা বড় হচ্ছি। আর আমাদের মনের কথাগুলিতে সুর দিয়ে শচীনকর্তা গাইছেন : 

আরও পড়ুন
দরজার কোণে লুকিয়ে থাকা ক্যাকটাসেই ঘায়েল ডাকাত, শখ বাঁচিয়েছিল গোটা পরিবারকে

‘শোনো গো দখিন হাওয়া
প্রেম করেছি আ-আ-মি
লেগেছে চোখেতে নেশা
দিক ভুলেছি আ-আ-মি...’

অথবা রফি সাহেব -

‘বাহারোঁ ফুল বরসাও
মেরা মেহবুব আয়া হ্যায়...
হাওয়ায়োঁ রাগ্‌নি গাও
মেরা মেহবুব আয়া হ্যায়...’

Powered by Froala Editor