ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ১৩
আগের পর্বে
রেবতীভূষণ ঘোষ, রেবতীদা। ভারতবিখ্যাত এই কার্টুনিস্টের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ছোটভাই কেশব কুমার ঘোষালের ছাত্র কুশল মজুমদারের সৌজন্যে। তার সঙ্গেই রেবতীভূষণের বেলুড়ের বাড়িতে প্রথম যাওয়া। সেখানে গিয়েই পরিচয় হয়েছিল আদ্যপ্রান্ত মিশুকে, বৈঠকী, আড্ডাবাজ মানুষটির সঙ্গে। রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু পত্রিকার সংখ্যায় লিখে দিয়েছিলেন একট ছড়া। তারপর ঘনিষ্ঠতা। আমার ‘শেষ তক তির্যক’ বইটির প্রচ্ছদ, অলংকরণের পাশাপাশি পরিচিতিটুকুও লিখে দিয়েছিলেন তিনি। ইচ্ছে ছিল সাইকেল চালিয়েই তিনি বেলুড় থেকে আসবেন আমাদের উত্তরপাড়ার বাড়িতে। তবে শেষ অবধি তাঁর সেই আশি বছরের উদ্যোমকে ঠেকানো গিয়েছিল বৌদিকে বলে।
১৯৮৯-এর জুলাইয়ে পাই শিশির মহারাজকে। বেলুড় শিক্ষক শিক্ষন মন্দিরের হস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট তখন তিনি।
গোলগাল, ফর্সা, বিরাট চেহারা, সব সময় মুখে হাসি। অনেক বিষয়েই খুব কড়া ছিলেন, কিন্তু ভেতরটা খুব নরম ছিল মানুষটার। খুবই ছাত্রবৎসল ছিলেন, তবে বুঝতে দিতেন না। তফাৎ গড়ে রাখতেন।
রাত ১২টার আগে হস্টেলের চেঁচামিচিতে ঘুমাতে পারতেন না, ভোরে ব্রহ্মমুহূর্তে মূল মন্দিরে প্রার্থনায় যোগ দিতেন। তারপর সকালে একটু নিজের (সুপারের) অফিসে বসে ৮টা/৮-৩০টার মধ্যে জিপ নিয়ে মেদিনীপুর চলে যেতেন রোজ। ফিরতেন বিকেলে বা সন্ধ্যার প্রার্থনার আগে। ওই জেলায় বিবেকানন্দ যুব মহামণ্ডল প্রসারের কাজে ব্যস্ত তখন তিনি। এইসব কাজেই তাঁর নিয়মনিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ছাপ ছিল।
চমৎকার গান করতেন তিনি — দরাজ গলায়। গায়ক সবিতাব্রত দত্ত ওঁর বন্ধু ছিলেন খুব।
সেই সূত্রেই আমাদের কলেজ ফাংশনেও গেয়ে গেছেন সবিতাব্রত।
ব্যাচের ২২৫ জন ছাত্রের মধ্যে আমি এবং সুব্রতদাই বয়সে সবচেয়ে বড়ো ছিলাম। তার ওপর আমি আবার সংসারী। সন্তানের পিতা। কাজেই শিশির মহারাজ ‘সব ব্যাটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর’- এই প্রবচন মেনে আমাকে কিছুতেই ছাড়তেন না। হয়তো ভেবেছিলেন আমার থেকে খবরাখবর পাবেন। সেটা সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে মুখে না বললেও মনে মনে চাইতেন ওঁর সঙ্গে ছাত্রদের সমস্যাগুলির মধ্যস্ততা করি আমি। অন্তত এরকমই আমার মনে হয়েছিল। আর সেটুকু আমি খুব খুশি মনেই করতাম।
তিনতলা হস্টেলবাড়ির দুটি উইং, V.S ও S.S - বাণীসদন ও শিক্ষাসদন। একদম সোজা নয় সে বাড়ি। বাইরে ২২০ ডিগ্রি এবং ভিতরে ১৪০ ডিগ্রিতে খানিক মুখোমুখি তার অবস্থান।
সকালে এবং সন্ধ্যার প্রার্থনায় আমাকে নিজের পাশে নিয়ে বসতেন। হয়তো মনে ভাবতেন যে পালের গোদাটাকে পাশে নিয়ে বসলে বাকিদের সামলাতে সুবিধা হবে।
কিন্তু মহারাজের বুঝতে বেশিদিন সময় লাগেনি যে ওঁর চিন্তাটা ভুলই ছিল। প্রার্থনার সময় প্রত্যেকদিন আমার ঠিক পিছনেই বসত কেশব। কেশব কুমার ঘোষাল। বর্দ্ধমানের সাদিপুরের ছেলে। নিজের বিষয় ইংরাজিতে তুখোড় জ্ঞান, দারুণ রেডি উইট এবং সেন্স অব হিউমার। প্রথমদিন আমার হস্টেলরুমে ঢুকেই টেবিল থেকে কাফসিরাপের শিশিটা তুলে ঢকঢক করে অর্ধেকটা খেয়ে ফেলে বলল, “ধন্যবাদ দাদা। আপনার মতো অতিথিপরায়ণ মানুষ বিশেষ দেখা যায় না। হস্টেলরুমেও কাফ সিরাপ এনে রেখেছেন!” বিরক্ত হব, না হাসব বুঝতে পারিনি প্রথমে। শেষে ভালোই বেসে ফেললাম ছেলেটাকে।
আজ সে বর্ধমানের এক বিরাট ও নামী উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক। পদের কারণে নয়, সে সম্মান কেশব আদায় করে নিয়েছে যোগ্যতার সঙ্গে, নির্ভিকভাবে তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের এবং তার শিক্ষক-শিক্ষিকা সহকর্মীদের এত বছর যাবৎ নেতৃত্ব দিয়ে।
তবে মনে রাখতে হবে আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন সে সদ্য যুবক। হস্টেল বিল্ডিংয়ের চারতলায় প্রার্থনা ঘরে গান শুরু হলেই কেশবও শুরু হয়ে যেত।
শিশির মহারাজ হারমোনিয়াম বাজিয়ে তন্ময় হয়ে গাইতেন :
রামকৃষ্ণ শরণম, রামকৃষ্ণ শরণম,
রামকৃষ্ণ শরণম, শরণ্যে...
আমার আড়ালে বসে কেশব সে গানে নিজস্ব শব্দ সংযোজন করত। যার ফলে সে গান হয়ে দাঁড়াত অনেকটা এরকম :
রামকৃষ্ণ শরণম (ভাই)
রামকৃষ্ণ শরণম (ভাই)
রামকৃষ্ণ শরণম, শরণ্যে...
আবার পরবর্তী প্যারায় :
কৃপাহি কেবলম (ভাই)
কৃপাহি কেবলম (ভাই)
কৃপাহি কেবলম শরণ্যে…
অনেক চেষ্টা করেও আমার বয়ঃকনিষ্ঠ সহপাঠীরা নিজেদের হাসি সামলাতে না পারায় প্রেয়ার হল জুড়ে মিচকে হাসির ঢেউ বয়ে যেত রোজ। আর শিশির মহারাজের ঠিক পাশটায় বসে কোনোক্রমে হাসি চেপে আমার চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়ত।
প্রার্থনার পরে বাইরে এসে নানা অছিলায় সবাইকে বকাবকি করেও আসামীর খোঁজ পাননি মহারাজ। দিন সাতেক ধরে লাগাতার বুঝিয়ে আমি কেশবকে নিরস্ত্র করেছিলাম।
আমাদের শিক্ষক শিক্ষণ মন্দিরের যে বিশাল খেলার মাঠ (প্রয়োজনে যেটা হেলিপ্যাডেরও কাজ করত) তার একদিকে আমাদের হস্টেলের কেয়ারটেকার কাম সিকিউরিটি সুকেশদার তত্ত্বাবধানে শিশির মহারাজ নানান রকম সব্জি ও আনাজের চাষ করাতেন যাতে আমাদের খাবারের মাসিক খরচটা একটু কম পড়ে।
আমাদের হস্টেল বিল্ডিংয়ের প্রবেশপথের সামনেই একটা রাউন্ড অ্যাবাউট — সেই আইল্যাণ্ডের ভিতরে বেশ সাজিয়ে গাছ লাগানো। ওখান থেকে সোজা এগিয়ে গেলে কলেজবাড়ির সামনে আরেকটি রাউন্ড অ্যাবাউট। সেখান থেকে ডান হাতে একশো মিটার গেলে শিক্ষণ মন্দিরের বাইরের গেট। পুরোটাই পিচের রাস্তা — চওড়া, পরিষ্কার। হস্টেল থেকে মেন গেট অব্দি এপথ দেড়শো মিটারেরও কিছু বেশি হবে।
সকালে বেলুড়ে থাকলে এটি মহারাজের পায়চারির প্রিয় জায়গা ছিল। এই পথে ওঁকে প্রায়শই সঙ্গ দিতাম। উনি কথা বলতে ভালোবাসতেন। আর আমার তো কথাই নেই। এভাবেই পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এবং কথা বলতে বলতে দুই অসমবয়সী মানুষ — এক সন্ন্যাসী ও এক ঘোর সংসারীর মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে ক্রমশ।
আর এই সখ্যের জেরে এবং জোরেই আমি অনেক কথাই ওনার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারতাম। যা অন্যথায় ভাবতেই পারতাম না হয়তো।
সংসারে সমস্যার কথা বললে বলতেন, ‘সংসারের ‘সং’টা বাদ দিয়ে সারটা নিয়ে নিবি। বাঁচতে গেলে গোলমাল থাকবেই। কিন্তু সেখানেও গোল বাদ দিয়ে মালটা নিতে হবে।’
সব সময়ে সৎ পরামর্শ দিতেন। আর আমাকে একটু প্রশ্রয়ও।
একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, “মহারাজ! আপনি উইকএন্ডগুলোতেও বাড়ি যেতে না দিলে তো খুবই মুস্কিল হচ্ছে আমার পক্ষে। বাড়িতে আমার এক বছর দশ মাসের একটা মেয়ে রয়েছে!”
মহারাজ বললেন, ‘হস্টেলে তোকে দুজনের রুমে দিয়েছি। রুম পার্টনার তাপসকে ম্যানেজ করে খাটে কোলবালিশটা চাদর চাপা দিয়ে মশারি খাটিয়ে বাড়ি চলে যাবি শনিবার কলেজ শেষ হলে। এও আমায় বলে দিতে হবে!’
‘আর হ্যাঁ! পিছনের গেট দিয়ে বেরোবি। সোমবার ফিরবিও ওদিক দিয়েই। সঙ্গে মনে রাখিস আমি কিন্তু এসবের কিছুই জানি না!’
তিনতলা হস্টেলবাড়ির কোথাও একটা পাখা ছিল না, মহারাজের থাকার ঘর ও তার বাইরে অতিথিদের বসার জায়গাটি ছাড়া। রুটিনে কোথাও একটু ছাড় থাকলে নানা বাহানা করে ওখানে গিয়ে বসতাম। তখন বিএড-এর টেস্ট পরীক্ষা এবং তৎপরবর্তী ফর্ম ফিলাপ হয়ে গেছে। রোজের রুটিনে তেমন কড়াকড়ি আর নেই - গিয়ে বসেছি সনাতনানন্দজীর ঘরের বাইরে। ঘর থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে? তোর কী ব্যাপার? সবাই দীক্ষার ফর্ম তুলল, তুই তো তুললি না?’
বলি, ‘আপনার কি মনে হয় যারা ফর্ম তুলেছে তারা সবাই দীক্ষা নেবে?’
উনি অবাক হয়ে বলেন, ‘নেবে না?’
‘না নেবে না। এরা বেশির ভাগই ফর্ম তুলেছে আপনাদের ইম্প্রেস করে ইন্টার্নাল মার্কিংটা বাড়িয়ে নিতে।’
‘আর তুই তুলিসনি কেন?’
‘কারণ আমি এখানে দীক্ষা নেব না। আর এত সামান্য কারণে আমি মিথ্যাচার করতে পারব না।’ এমন জবাবও হাসিমুখে নিয়েছিলেন তিনি।
একদিন সকালে হস্টেল সুপারের ঘরে মহারাজের চিৎকার শুনে উঁকি দিয়ে দেখি উনি ভয়ানক রেগে গিয়ে হস্টেলেরই দুজন কর্মচারীকে ভীষণ বকাঝকা করছেন।
ওইদিনই পরে একান্তে পেয়ে ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি সন্ন্যাসী মানুষ, এত রেগে যান কেন?’
উনি বলেন, ‘সকালের কথা বলছিস? ওটুকু দেখাতে হয়। না হলে কন্ট্রোল করা যাবে না। তবে ভিতরটা হাসছিল!’
কী কারণে যেন একদিন আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুই তো ফিরে গিয়ে স্কুল করবি? তা কী শিখলি বিএড পড়তে এসে?’
জবাবে বলেছিলাম, ‘ম্যানেজমেন্ট শিখলাম আপনাদের দেখে। মাত্র ৩৯ জন সন্ন্যাসী মিলে বেলুড়ে বসে নিজেদের শৃঙ্খলা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে কেমন অবলীলায় চালিয়ে নিচ্ছেন বিশ্বজোড়া রামকৃষ্ণ মিশনের হেডকোয়ার্টার।’
এই উত্তরের উনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি হাল্কা হাসি ছাড়া। সাংগঠনিক কারণে তা হয়তো সম্ভবও ছিল না।
বি.এড শেষ করে আসার পরও তাঁর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।এমনকি উনি বরানগর আশ্রমে যাওয়ার পরও। আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে এবং আমাদের বাড়িতেও তিনি এসেছেন বহুবার।
কিন্তু কোনোদিন জানতে দেননি তাঁর গৌরবর্ণ সদা হাস্যময় মুখমণ্ডলে ‘পার্সিয়াল-প্যারালিসিস’ ছিল।
Powered by Froala Editor