ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ১২
আগের পর্বে
২০০৬ সাল। দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে যাওয়া ছেলেকে নিয়ে। সেখানেই যশপল রানাকে প্রথম কাছ থেকে দেখা। ১৯৯৪ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে যাঁর সংগ্রহে ৬০০-এর বেশি পদক। পরের বছর ২০০৭ সালে সপরিবারে জি ভি মালাবাঙ্কার দেখতে গিয়ে লাঞ্চে আলাপ সুভাষ রানার সঙ্গে। যশপল রানারই ছোটো ভাই। তখন তিনি পিস্তল শুটারের পাশাপাশি কোচও। সেখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন ইক্যুইপমেন্ট গুছিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়া পাহাড়ি পথে। সেই উপত্যকাতেই হঠাৎ দেখা হয়ে যায় যশমিত সিংজির সঙ্গে। সেই সঙ্গে যশপল রানার বাবা এস এন রানা। বছর কয়েক পর ২০১১-তে পুনার বালেওয়াড়ি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল যশপল রানার সঙ্গে।
অরিত্র পাল নামে যে ছেলেটি এবার মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছে ৯৯ শতাংশেরও বেশি নম্বর পেয়ে, তার স্কুলের নাম মেমারি ভি.এম.ইনস্টিটিউশন(ইউনিট ১)। সেই স্কুলের প্রধানশিক্ষক মশাই শ্রী কেশব কুমার ঘোষাল আমার ছোটো ভাই হন। এই ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ১৯৮৯ সালে বেলুড় শিক্ষক শিক্ষন মন্দিরে বি.এড পড়তে গিয়ে। সে তখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য বাংলায় স্নাতকোত্তর করে এসেছে। আর আমি শিং ভেঙে বাছুরের দলে। স্ত্রী-কন্যাকে বাবা-মায়ের জিম্মায় রেখে চাকরি ছেড়ে পড়তে গেছি বি.এড।
বি.এড সম্পূর্ণ করে এসে সদ্য শুরু করেছি ‘বিদ্যাভবন’। এমন এক সময়ে কেশবের চিঠি নিয়ে আমার কাছে হাজির তার এক ছাত্র, কুশল মজুমদার। চিঠি পড়ে বোঝা গেল যে সে কলকাতায় থেকে তার পরবর্তী পড়াশোনা চালাবে এবং একটি লিটল্ ম্যাগাজিন প্রকাশ করবে ‘প্রেঙ্ক্ষণ’ নামে। সেজন্য আমার সাহায্য চাই।
কেশবের চিঠি তো ছিলই, কিন্তু না থাকলেও কিছু তফাৎ হতো না। কারণ কুশল এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে দেখে বাইরের ঘরে বসানো যায় না, যে দরজা ঠেলে সিধে হৃদয়ে স্থান করে নেয়। কাজেই আমি আমার যথা সাধ্য করেছিলাম। তবে তাতে ওর বা সে অর্থে ‘প্রেঙ্ক্ষণ’-এর কতটা উপকার হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না।
তো সেই কুশল মজুমদার একদিন পাকড়াও করল আমাকে, “দাদা, শিল্পী রেবতীভূষণ ঘোষ দিল্লি থেকে ফিরে ওনার বেলুড় রাসবাড়ির বাড়িতে রয়েছেন এখন, চলুন আলাপ করবেন তো!” এরপর জোর করেই একদিন নিয়ে গেল রেবতীভূষণের বাড়িতে, বেলুড়ে। জি. টি. রোড রাসবাড়ি স্টপেজ থেকে পুবমুখো হাঁটলে গঙ্গা, গঙ্গার ঘাট ও মন্দিরগুলির থেকে ৩-৪টি বাড়ি আগে, বাঁহাতে রেবতীদার মস্ত বাগান ও পুকুরসহ বাড়ি। দোতলায় বাগানমুখী বিরাট বারান্দা। একতলায় বসার ঘর। রেবতীদার মতো আড্ডাবাজ, মিশুকে, বৈঠকী মানুষের কারণে সেঘরকে বৈঠকখানাও বলা যেতে পারে। তবে তখনও আলাপ হয়নি তাঁর সঙ্গে। আমরা পৌঁছে সাইকেলগুলো স্ট্যান্ড করেছি। কুশল হাঁক দিলো, “রেবতীদা, ও রেবতীদা!” উপর থেকে জবাব এল, “কে? কুশল? আসছি ভাই!”
আরও পড়ুন
বন্দুক, উপত্যকা ও রানা পরিবারের গল্প
আমরা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে সোফায় বসেছি। দোতলা থেকে একটি ড্রেসিংগাউন গায়ে চাপিয়ে অতি দ্রুত নেমে এলেন ৭৫-৭৬-এর এক নওজোয়ান। এত বড় শিল্পী, অমন গুণী মানুষ - উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। উনি হাত দেখিয়ে বললেন, “আরে বসুন বসুন। কুশল আমাকে বলে রেখেছিল আপনাকে নিয়ে আসবে।” হ্যাঁ! প্রথম সম্মোধন ‘আপনি’ই ছিল ওঁর তরফ থেকেও। তবে তা চকিতে ‘তুমি’তে নেমে আসে যখন গল্প জমে ওঠে আমাদের। তাঁর কার্টুন, দিল্লী প্রবাসী হওয়া, বালি-প্রেম, পাখি ও জীবজন্তু ভালোবাসা, শংকর’স উইকলি, প্রেঙ্ক্ষণের পরের সংখ্যার প্রচ্ছদ – কী ছিল না সে আড্ডায়, কে ছিল না!
এরইমধ্যে “আমি এক মিনিট আসছি।” বলে দৌড়ে উঠে গেলেন দোতলায়। পরক্ষণেই নেমে এলেন হাতে একটি বই নিয়ে। রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু পত্রিকার রেবতীভূষণ সংখ্যা। টেবিল থেকে একটা পেন টেনে নিয়ে ততক্ষণাৎ লিখে দিলেন :
আরও পড়ুন
পি’থ্রি = তিনি পতিতপাবন পাঠক
দেশ চেতনার কেতন ওড়ে
সবুজে গৈরিকে
প্রথম চেনার স্মরণীতে
এই কথা দিই লিখে।
আরও পড়ুন
রাম-রাজত্ব
একই সঙ্গে লেখার পাশে একটি উড্ডীয়মান জাতীয় পতাকার ছবিও এঁকে ফেললেন। তারপরেই আবার ছুটে দোতলায় গেলেন এবং রঙিন স্কেচ পেন এনে সে-পতাকা রাঙিয়েও দিলেন শ্যামলে-গৈরিকে। নিচে সই করলেন রেবতীভূষণ এবং পাশে বালি, ২৩শে ডিসেম্বর ১৯৯৭ লিখে চিরস্মরণীয় করে দিলেন তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটি।
কার্টুনিস্ট হিসাবে তাঁর রাজনৈতিক ভূগোল, সাম্প্রতিক ও ঐতিহাসিক বিষয়-জ্ঞান, তাঁর অসাধারণ সেন্স অফ হিউমার, বাংলা ছাড়াও ইংরাজি, হিন্দি ও সংস্কৃতে তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তির আন্দাজ আমার ছিল – পাঠক ও ভক্ত হিসাবে। কিন্তু তাঁর শিশুসুলভ সারল্য, কিশোরের মতো উদ্যম এবং খোলা মনে নবীনদের কাছে টেনে নেবার যে উদারতা প্রথম সাক্ষাতেই তা আমাকে মুগ্ধ করে দিলো।
আরও পড়ুন
ক্যাকটাস চর্চার পিতামহ
এরপর একদিন তাঁর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে হবে, এই শর্তে সেদিনের মতো ছুটি মিলল। আসলে ঐ সময়টি তাঁর বাগানের পাখি-বন্ধুদের খাওয়াবার সময় ছিল। আর উনি চেয়েছিলেন যেহেতু আমিও পাখি ভালোবাসি উনি ওদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন। সেও হল একদিন।
এখানে অবশ্যই বৌদির কথাও একটু বলে নেওয়া দরকার। অত্যন্ত স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের মানুষ সুষমা বৌদি। আর ভীষণ আন্তরিক। অমন বড় মাপের শিল্পীর যোগ্য সহধর্মিণী। তাঁর আপ্যায়নও ও-বাড়ি যাওয়ার এক বড় কারণ ছিল।
আরও পড়ুন
দরজার কোণে লুকিয়ে থাকা ক্যাকটাসেই ঘায়েল ডাকাত, শখ বাঁচিয়েছিল গোটা পরিবারকে
ছড়া লেখা এবং পাখি পোষা ও পাখি ভালোবাসার কারণেই রেবতীদার ক্রমশই আমার প্রতি স্নেহ, প্রশ্রয় এবং দাবিও বাড়তে থাকে। ওঁর খুব ইচ্ছা আমার জীবজন্তু ও পাখির বইয়ে ইলাস্ট্রেশন করার। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার কোনো পাণ্ডুলিপি তৈরি নেই। এদিকে রেবতীদাও ছাড়বেন না। শেষে ঠিক হল আমার বড়দের জন্য লেখা ছড়ার বইয়ে রেবতীদা অলংকরণ করবেন আর কুশল সেই বই প্রকাশ করবে। সে বই ‘শেষ তক তির্যক’ প্রকাশিত হল ১৪০৫ এর বইমেলায়। পরম সৌভাগ্য আমার সে বইয়ের অলংকরণ ও প্রচ্ছদ তো করেই ছিলেন পিছনের মলাটে পরিচিতিটুকুও ছড়ায় লিখে দিয়েছিলেন রেবতীভূষণ ঘোষ।
শেষ তক তির্যক
ঝালঝাল টকটক
ছড়াকার হচ্ছেন গৈরিক গঙ্গো।
কুশল মজুমদার
এ-বই প্রকাশকার
রেবতীভূষণ-কৃত রেখা অনুষঙ্গ।
এবার বই-এর হাটে
কী-জানি কেমন কাটে
ছড়ার দাওয়াই কড়া পরিহাস রঙ্গ।
আরও পড়ুন
ভাষা বাঁচাতে সুদূর মানভূম থেকে হেঁটে কলকাতায় এলেন বাঙালিরা, নেতৃত্বে বাসন্তী রায়ও
এদিকে রেবতীদার খুব ইচ্ছে একদিন আমার উত্তরপাড়ার বাড়িতে আসেন, আমার পোষা ও বাগানের পাখিদের সঙ্গে আলাপ করতে। ‘সে তো খুবই আনন্দের কথা’ আমি বলি “আপনি কবে যাবেন বলুন। আমি গাড়ি করে আপনাকে নিয়ে যাব, আবার পৌঁছে দিয়ে যাব।”
কিন্তু দাদা তাতে রাজি নন। উনি বলেন, “আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি নাকি, যে গাড়িতে যাব? তুমি সাইকেল নিয়ে উত্তরপাড়া থেকে বেলুড় আসতে পারো, আর আমি পারি না যেতে! মাঝে তো শুধু বালিখালটা।”
রাস্তাটা কমপক্ষে ৮-৯ কিলোমিটার হবে, একদিকে। অর্থাৎ যাতায়াত মানে ১৬-১৮ কিলোমিটার রাস্তা। রেবতীদা তখন ৮০। বৌদিকে ডেকে মধ্যস্থতা করিয়ে কোনোরকমে ঠেকাই সেবারের মতো।
সেই বছরই (২০০১) রেবতীদার ৮০ বছরের জন্মদিন খুব ঘটা করে পালন করা হয়। সম্ভবত বাংলা একাডেমি সভাঘরে। একটি অসাধারণ স্মারক পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয় এই উপলক্ষে। কিন্তু সেই বইতেও আমার সৌজন্য সংখ্যাটিতে তিনি আবার লিখে দিলেনঃ
কল্যানীয়েষু
গৈরিক
আমরা তো ভাই
বালিখালের
এপার-ওপার থাকি
এই পাড়াতে উড়ে আসে
তোমার চেনা পাখি
বইখানিতে সই দিচ্ছি, এবার কই
ওদের সাথে আমার চেনাশোনা
যে রয় বাকি
বালি রেবতীভূষণ
২১.১১.২০০১
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে সাইকেলে চেপে আমার বাড়ি যেতে না পারার দুঃখটা তিনি ভুলতে পারেননি।
এর আগে পরে আমারই নিমন্ত্রণে তিনি আমাদের স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে গেছেন উত্তরপাড়া গণভবনে। কিন্তু আমার বাড়ি আর আসা হয়ে ওঠেনি তাঁর। একী আমারই কম আফশোষ!
বেলুড়েই বছরের বেশি সময়টা থাকলেও মাঝেমধ্যে দুজনে দিল্লি ও ব্যাঙ্গালোরে চলে যেতেন ছেলেদের কাছে। ফিরে এসে ফোন করলেই আবার আমরা যাওয়া আসা শুরু করতাম। এরকমই একবার, ফিরেছেন শুনে দেখা করতে গেছি। গিয়ে দেখি বাড়িতে দাদা একা। জিজ্ঞেস করি “বৌদি কোথায়?” রেবতীদা বলেন “ও ছেলের কাছে এবার দিল্লিতেই রয়ে গেছে দরকারে। আমার সঙ্গে ফিরতে পারেনি।”
খানিক উৎকণ্ঠাতেই বলে ফেলি “তাহলে আপনি এখন একাই রয়েছেন!”
রেবতীদা মজা করে বলেন, “কী আর করব বলো? একাই আছি। আমার বান্ধবীদের কয়েকজনকে ফোনে বললাম, দেখো এই সুযোগ, চলে এসো। কিন্তু তারা অনেকেই ঘোর সংসারী। আর বাকিরা ভীষণ বুড়ো হয়ে গেছে। অগত্যা একাই রয়েছি।”
এমনই রসিক ছিলেন অবন ঠাকুরের চেলা আমাদের রেবতীদা।
তিনিই শেষ বাঙালি কার্টুনিস্ট যিনি সর্বভারতীয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বললে কি একটুও বাড়িয়ে বলা হবে? তাঁর করে যাওয়া কাজ হাসতে হাসতে তাঁকে আরেক শতাব্দি পার করে দেবে নিশ্চিত। আর উদারমনা, পরোপকারী, সদ্চিন্তক মানুষটিও টিকে থাকবেন আগামীদিনের সব মহৎ হৃদয় ভালোমানুষদের মধ্যে।
ওঁকে একদিন একান্তে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে বিভিন্ন দৈনিকপত্র ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় কার্টুন এত কমে আসছে কেন?
জবাবে রেবতীদা বলেছিলেন, “দ্যাখো গৈরিক, আমরা কার্টুন আঁকি কেন? আঁকি সমাজের বিভিন্ন অসাম্য সরস চিত্রণে মানুষের কাছে হাজির করতে। এরফলে অনেক রাজনৈতিক চরিত্রকে নিয়েও আমাদের ব্যঙ্গাত্মক ছবি আঁকতে হয়। একইসঙ্গে ঐ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও নিজেদের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারার কালচার থাকা দরকার। দিল্লিতে থাকাকালীন নেহেরুজীর সঙ্গে প্রথম আলাপে তিনি আমায় বলেছিলেন “রেবতী, আমি শংকরস্ উইকলি নিয়মিত রাখি শুধু তুমি আমায় কীভাবে আঁকলে তা দেখার জন্য।”এই কালচারটা সে সময়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতারই ছিল। যা বর্তমানে প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে কার্টুন আর প্রিন্ট মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা সেভাবে পায় না। এটাই অন্যতম কারণ। আরও একটা কারণ অবশ্য আছে। সেটা হল, এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশই এত হাস্যকর চরিত্রের যে আমজনতা তাঁদের কাজকম্ম দেখেই হেসে গড়িয়ে পড়ছেন – কার্টুনের আর দরকারই হচ্ছে না!
Powered by Froala Editor