পাঁচির পঞ্চকথা – ৬
আগের পর্বে
সকাল থেকেই এক উন্মাদনা কাজ করছিল ভাই-বোনেদের মধ্যে। আজ বোসবাবুদের বাড়ি যাত্রা দেখতে যাওয়ার কথা। অর্থাভাব, একবসন, এঅ খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও আলোর রোশনাই দেখতে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে। সন্ধেবেলায় যখন সেই সুযোগ এল আলোর জাঁকজমকে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল পাঁচির। কাহার পাড়া শুনে বসার জায়গা দেখিয়ে দিল গোঁফওয়ালা দারোয়ান। চার কোণায় বাঁশ দিয়ে মাথার ওপরে টাঙানো কাপড়। চতুর্দিকে জ্বলছে হ্যাজাক। সামনে রাজা, রানী, সৈন্যরা হাজির মঞ্চে। তবে পাঁচি দেখতে থাকে বোসেদের প্রকাণ্ড বাড়ি, দুর্গা প্রতিমার চকচকে চোখ আর বোস গিন্নিদের সাজের বাহার। অথচ মায়ের শরীরে সাদা রং ছাড়া কিছুই নেই। মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে পাঁচির। যাত্রা শেষের হাততালির মধ্যেও তার চোখে জল।
দুগ্গা পুজো গিয়ে কালীপুজো শেষ হয়েছে আজ দিন পনেরো হল। শীত পড়েছে পাড়াগাঁয়ে। শীতের সময় পাঁচিদের একটু কষ্ট বেশি। তবে বর্ষাতেই ঐ একই অবস্থা। একটায় ঘরে জল পড়ে, অন্যকালে হাওয়া ঢোকে। তবে দুগ্গা পুজোয় বোসেদের বাড়ির যাত্রা পাঁচি, বিরাট, ভক্তদের মতো কচিকাঁচাদের অনেকদিন ধরেই বেশ চনমনে রেখেছে। নিজেদের মধ্যে পালাগানের নকল হয়েছে বহু বার চৌধুরীদের বাগানের ভেতরে। পাঁচি রানি সাজলেও খুব বেশি কিছু করে দেখাতে পারিনি। কারণ, সে দিনের ঘোর আজও ওর মনে বসে আছে। বেশি করে বাবুদের গিন্নিদের সাজ। আলোর রোশনাই সব যেন ভিড় করে আছে চোখে-মাথায়। সেদিনের পর থেকে নিজের মাকে অনেকবার সে সেই সাজে কল্পনা করেছে। বাপডা যদি অকালে না চলে যেত, তাহলে সে তার বাপরে বলত মাডারে ঐ রকম চকমকে শাড়ি কিনে দিতে।
চৌধুরীদের বাড়িতে গেল রাতে কালী পুজোর অন্নকূট ছিল। বোস বা নাগবাবুদের বাড়ির পুজোর মতো ধুমধাম না হলেও কম কাণ্ড হয় না। শহর গঞ্জের থেকে বহু আত্মীয়স্বজন এসে ভিড় করে। তবে মায়ের মূর্তিখানা ছোট হলে কি হবে। দেখে বেশ ভয় করেছিল পাঁচির। বছরে ঐ একটা দিন বাবুদের বাড়িতে পাঁচিদের দুদিন ধরে পাত পড়ে। পুজোর দিন সকাল থেকে খেনেবউ, পাঁচি, বিরাট, ভক্ত সবাই চৌধুরী বাড়ির কাজে লেগে পড়েছিল। দুপুর বেলা নিরামিষ ভাত তরকারি; রাতে আবার পাত পেড়ে লুচি তরকারির এলাহি আয়োজন। মিষ্টি পেয়ে বিরাট আর ভক্তের চোখ দুটো চকচক করছিল। আজ দুই ভাইয়ের চোখে ঘুম নেই। চৌধুরী বাবুদের বাজি পোড়ানো দেখেছে। সন্ধ্যের ঠান্ডা বাঁচতে গলায় গিন্নি মায়ের দেওয়া সাদা তিনখানা থান কাপড় পেয়েছে ঘেনেবউ। অনেকটা সন্ন্যাসীদের গলায় গিঁট বেঁধে পরার মতো করে পরিয়ে দিয়েছে। ভাইদের মিষ্টির প্রতি লোভ দেখে, নিজে একখানা গালে দিয়ে, বাকি একখানা ভাইদের পাতে ভাগ করে দিয়েছে। তাতে যেন পাঁচির মনডা শান্তি পেয়েছে। বাড়ির জন্য খাবার বেঁধে নিয়ে এসেছিল খেনেবউ। “ঘেনেবউ তুমি এতোদিনে কাজ শিখলে না। তোমায় দিয়ে যদি কিছু হয়।” গিন্নি মা যতই বলুক না কেন, আসলে ও বাড়ির সব্বাই মারে খুব ভালোবাসে। বাড়িতে আনা খাবার সকালটা বেশ চলে যাবে। তবে খাবারের ওপরে মিষ্টি দুখান দেখে পাঁচি বুঝতে পারে। নিজের মিষ্টিখানা না খেয়ে মা তাদের জন্য নিয়ে এসেছে- ‘বাপখাগি’ ‘বাপখেগো’দের জন্য। মনের ভেতরটা ডুকরে ওঠে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে চোখে জল গড়ানোর আগে। ভাইদের ডেকে তোলে। বাবুর বাড়ির কালীপুজো আর সেখান থেকে খাবার যেন ঝড়ঝঞ্ঝা শেষের সকাল; যেখানে দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতিময় পাখিদের খেলে বেড়োনোর অনন্ত অবকাশ।
মা আগে বলে গেছিল, বেলায় স্নান সেরে তিন ভাইবোনে হাজির হয় চৌধুরীদের দালানে। আস্তে আস্তে লোক আসতে শুরু করেছে চৌধুরীদের দালানে। যদিও দালানে ওঠার অনুমতি নেই পাঁচিদের। মারে খুঁজে বার করে। মা বলে পাঁচিরে -
‘আমাদের পাড়া থেকে যারা আসবে তাদের ভোগ দিবি।’ আর কিছুক্ষণ বাদে আবার বলে ওঠে - ‘বিরাট আর ভক্তরে জল পেড়ে দিতে বলবি’।
আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ৫
এই বিরাট দায়িত্ব পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিন ভাইবোনে। পাড়ার লোক ওদের ‘বাবু’, ‘গিন্নিমা’ বলে একটু ঠাট্টা করে। কিন্তু সব্বাইরে ভোগ দিয়ে যেন অজানা তৃপ্তি পায় পাঁচি। সবাই কি আনন্দ করে খাচ্ছে। শেষপাতে নিজেও পাড়ার খুড়িমাদের সঙ্গে বসে পড়ে পাঁচি। যদিও ভক্ত আর বিরাট অনেক আগেই খেয়ে, ঢাকের তালে তালে নাচছে। মা কালী বিসর্জন যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সবাই চওড়া করে সিঁদুর পরে মারে পান, মিষ্টি মুখে তুলে ধরছে। পাঁচি আবার হারিয়ে যেতে থাকে। জীবনের অদৃশ্য অসমাপ্ত ঘটনাগুলো ভিতরটাকে খামচাতে থাকে। আলোর রোশনাই, ঢাকের বাদ্যি সহকারে এগিয়ে যায় কালী মা চৌধুরীদের ঘাটের দিকে। দুভাইয়ের হাত ঘেনেবউ আর পাঁচি শক্ত করে ধরে এগিয়ে যায়। ‘বল কালী মা কি জয়’ চিৎকার, ‘আসছে বছর আবার হবে’— সবার চিৎকার সপ্তম সুরে ওঠার পর যখন কালীমার দেহখানই অমাবস্যার অন্ধকার পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাঁচির মনে হয় এক দুদিনের চেনা মানুষকে কে ফেলে দিল। ইচ্ছা করে যদি সে আটকে দিতে পারত। জানে তার দাম নেই। সেই দাম তার চোখের জল দিয়ে মেটায়। পাশে থাকা ভাইদের হাত না ছেড়ে মন থেকে চোখের জল দিয়ে প্রণাম করে। মাকে দেখে। ঘেনেবউ তখন ভক্তের হাত ছেড়ে দু’হাতে আজকের পুকুরে তলিয়ে যাওয়া মারে উদ্দেশ্য করে, কপালে হাত রেখে দুচোখে জল নিয়ে কী বলে চলেছে। সে বলার কিছু মানে না থাকতে পারে। তবে পাঁচি জানে তিনটে ভাইবোন, একটু ঘরের চাল, গায়ের কটা কাপড়ের জন্য তার মার এত আকুতি। নিজের বেঁচে থাকাটাও আছে। সকালের সন্দেশ দুটো তারই প্রমাণ দিয়েছিল।
আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা - ৪
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা - ৩