পাঁচির পঞ্চকথা - ৪

পাঁচির পঞ্চকথা - ৪

আগের পর্বে

ফিরিঙ্গিরা কী করেছে, তা বাবার থেকে ছোটবেলায় শুনেছিল পাঁচি। তারপর বর্ষার একরাতে কামান দাগার শব্দ, পটকার আওয়াজ। পাঁচি শুনেছিল দেশ নাকি স্বাধীন হচ্ছে। বাবার মতো তিতুমির হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল পাঁচির সেদিন। বাবা চলে যাওয়ার পর মা ‘বাপখাগী’, ‘বাপখেগো’ বলে ডাকে পাঁচিদের। পাঁচি জানে এই অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আসলে পেরে ওঠে না তার মা। একদিন সন্ধ্যায় পাঁচির বাড়িতে এসে হাজির হয় মাধব খুড়ো। চাল, ডাল, মায়ের জন্য কাপড় শাড়ি নিয়ে। তবে সেদিন মায়ের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে খানিকটা ভয়ই পেয়েছিল তিন ভাই-বোন। কিন্তু কেন এমন আচরণ তা বুঝতে আরও বছর পাঁচেক সময় লাগে পাঁচির।

কদিন ধরেই পাঁচির শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। কিরকম যেন পেটে ব্যথা-ব্যথা করছিল। মারে বলতে মা সেরকম কান করেনি। তেলকুচো পাতার ঝোল দিয়ে গ্রাম্য আমাশার চিকিৎসা করেছিল। এখন বয়সের দিক থেকে প্রত্যেকেই একটু একটু ঠেলে উঠেছে, যদিও পাঁচিদের বয়স কালের নিয়মে চাপা পড়ে, তবুও কোথায় খেনে বউয়ের সন্দেহ হয়। পাঁচির বোধহয় শরীর এবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় হয়েছে। মা কখনও কোনো কথা এর আগে সকলকে আড়াল করে বলেনি। আজ ভাইদের সরিয়ে সংসারের সকলকে দূরে রেখে, মা মেয়ে আলাদা হয়। এখন ভক্ত মাথায় বেড়েছে। বিরাট দিদির সাথে কাঠ গোটো করতে পারে। তাই এবারের ভরা বর্ষায় জ্বালানি একটু বেশিই রয়েছে বটে। রাতে ভক্ত আর বিরাট যখন ঘুমে কাদা ঠিক তখন মা পাঁচিরে কাছে ডেকে, তারই এক ফালি ছেঁড়া কাপড় এগিয়ে দেয়। আর সেই রাতেই পাঁচির বয়ঃসন্ধির বেড়া টপকে যৌবনের পথচলা শুরু হয়। বৃষ্টিও পড়ছিল অঝোর ধারায়। 

সারারাত পাঁচি ঘুমোতে পারেনি বলতে গেলে। মাও পারেনি। ভোরের আলো ফোটার আগেই মা-মেয়ে বাড়ির দাওয়ায় এসে বসেছিল। মা সেদিনের বলা কথাগুলো পাঁচির কানে বেজেছিল। কারণ, যে ঘেনে বউ ‘বাপখাগী’ ছাড়া মেয়েরে আর কোনো কথা বলত না, সেই মা বলেছিল, “নিজেরে এবারের থেকে সামলে রাখতি হবে। শেল কুকুরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কাছ থেকে বাঁচাতে হবে নিজেরে।” এ কোন মা, এ কীরকম কথা। যে মেয়েরে সে এতদিন দূর দূর করত, আজ মনে হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীর থেকে পাঁচিরে নিজের আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। “শুনে রাখ বাপখাগী, দুটো ভাই ছাড়া আর কোন ব্যাটাছেলেরে বিশ্বাস করবি না।” পাঁচির কীরকম মন খারাপ হয়ে আসে। আজ মাকে কিরকম তাদের ঘরটার মতো মনে হয়। সেখানে আগলটা লাগিয়ে দিলে আর কেউ ছুঁতে পারবে না। পাঁচি যেন সারা দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। মা-মেয়ের চোখের জলে এক নতুন খুঁজে পাওয়ার খেলার সমাপ্তি হয়। বাইরেও তখন ভোরের আধো আলো রাতের ভেজা থেকে জেগে ওঠে।

পাঁচি হঠাৎ করে সকলের চোখে ধরা দিতে শুরু করে। যে সে আর চুকিৎকিৎ, গাদি খেলার সেই সময় নেই। শরীর বাঁক নেয় তার গতিপথ ধরে। বর্ষা শেষের কাশফুল ফুটে ওঠে মাঠের ধারে। যদিও ঘেনে বউয়ের আর পুজো? তবুও বাবুর বাড়ি থেকে পুজোর সময় একথান কাপড় পাওয়া যায়। আর যদি কিছু ফেলে দেওয়ার মতো থাকে তার থেকেও দু-একখান কপালে জোটে। ভক্তটা ছোটবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে বাবুর বাড়ি যাওয়ার দৌলতে সিকি আধুলি পায়। আসলে বাবুর চুল তুলে দেওয়ার খাতিরে বেশ খানিকটা মনে জায়গা করে নিয়েছে ভক্ত। তবে দুগ্গাপুজোর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটু যেন অন্যরকম ঠেকে পাঁচিদের। আসলে বেলেপুরের কাহার পরিবার হলে কী হবে, আদতে গ্রামটায় অনেক বাবুদের বাস। তাই পুজোও হয় প্রায় খান আষ্টেক। সারাদিন ধরে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে বাবুদের পাড়া থেকে। গেলোবার মায়ের সঙ্গে পাঁচি, দুই ভাই গিয়েছিল বোসেদের দালানে। বোসেদের দালানে লুচি পড়ে পুজোর তিনদিন। যদিও সে পাওয়া মুখের কথা নয়। প্রথমে বামুনদের পাত পড়বে। পরে কায়স্থ হয়ে তারপর তো তাদের মতো কাহার পরিবারের হাতে আসবে। 

পুজো শুরুর দুদিন আগে পাঁচি, ভক্ত আর বিরাট ঠিক করে এবার বোসেদের বাড়ির সন্ধে বেলায় যাত্রা দেখতে যাবে। গেলোবার তাদের পাড়ার অনেকে গেছিল দেখতে। কী যেন এক পালা হয়েছিল। সে এক রাজা না কি শেষে শ্মশানের ডোম হয়ে নিজের ছেলেকে পোড়াতে বউয়ের কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল। কিন্তু মাকে বলবে কে? তবে গেলো মাসখানিক ধরে পাঁচির যেন মায়ের সঙ্গে একটু ভাব তৈরি হয়েছে। কারণ, তার জীবনের লুকানো মা শুধু জানে। তাই রাতে দেওয়ার সময় তিন ভাইবোনের গুজুর গুজুর, হাসি একটু বেশি মনে হয় মায়ের। হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে খেনে বউ— 

‘কী হল কী গুজগুজ করছিস তোরা?’
‘এড্ডা কথা বলব মা? মারবে না তো?’ পাঁচি বলে।
‘কী কথা?’
‘মা আমাদেরকে এ বছর বোসবাবুদের বাড়ি যাত্রা দেখাতে নিয়ে যাবে?’- পাঁচি একদমে বলে ফেলে।
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
‘ও মা’ বলতেই পাঁচি দেখে মা কাঁদছে।
‘কী হল?’
‘ও কিছু না’ কান্না গলায় বলে ওঠে ঘেনে বউ। 

পাঁচি বেশ বুঝতে পারে বাপের কথা মনে পড়েছে মায়ের। আসলে বাপটা কেত্তন, যাত্রা, খেউড়, তরজা শুনতে খুব ভালবাসত। বাঁশের বেড়ার কীরকম একটা চুপ নেমে আসে। চারটে প্রাণী তাদের মন খারাপ সব এক হয়ে জাপটাতে চায়। দূরে তখন মাঠের ধারে পেঁচা চিৎকার করে উড়ে যায়। পাঁচির চোখে তখন ভেসে আসে বাপের সঙ্গে ঈশ্বরীগাছায় কেত্তন শুনতে যাওয়ার স্মৃতি।

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা - ৩

Powered by Froala Editor