পাঁচির পঞ্চকথা – ৩
আগের পর্বে
বাংলাদেশ থেকে সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল ছায়া। তারপর বেলেপুর, সংসার। কেমন আছে সেই দেশ, দেখতে ইচ্ছে হয় তার মাঝে মাঝেই। শুনেছে সব বদলে গেছে সেখানে। ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বারোটা বেজে যায়। দরজা বন্ধ করার জন্য উঠতে গিয়েই ছায়া শুনতে পায় হরিধ্বনি। পাঁচির সৎকারের পর ফিরছে গ্রামের লোক। শেষ হল ৪৬ বছরের সম্পর্ক। এই সেদিনই নিজের জীবনের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণার কথা বলত পাঁচি। তার ছোট্ট তিন ভাই-বোনকে রেখেই চলে গিয়েছিল বাবা। সেও গাইত হরে কেত্তন। তবে কাহারপাড়ার ছেলে কীর্তন গাইছে শুনলে ব্রাহ্মণরা পিটিয়ে মারবে, তাই ঘরের উঠোনেই। বাবার সঙ্গে একবার নবদ্বীপে কীর্তন শুনতে গিয়েছিল, এমনটা বলেছি পাঁচি।
রাতে কেত্তন শুনে বাড়ি ফেরার সময় যখন বাবা রাস্তার ধারে বললে বিলের পাশে গ্যাজায় সুখটানে দিচ্ছিল। তখন পাঁচি জিজ্ঞাসা হয়েছিল, “ঐ লোকডা কেয়া বাপ”; বাপ বলেছিল ‘শয়তান। আমাদের দেশের মানুষের রক্ত চুষে খায়।’
‘তুমি চেনো বাবা ওরে?’
‘চেনবোনা শোরের বাচ্চা ফিরিঙ্গিরে আমাদের ধান, পাট, পটল, কপির মাঠগুলোতে জোর করে নীল চাষ করানোর জাত’
‘ওরা কি আমাদের শত্রু?’
‘শত্রু মানে, আমার যদি তেমন সাহস থাকত আমিও তিতুমিরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তাম।’
বাড়ি ঢুকে দুঘা পড়েছে পাঁচির পিঠে। চুলের ঝুঁটি ধরে ঘুরিয়েছেও দুবার মা। এখন চোখের জল শুকনো। বিরাটটার চেহারা বড়ো। তাই ওর নাম বিরাট দিয়েছে পাড়ার মানুষ। সত্যিই ওরে বেশ করে পিঁপড়ে কামড়েছে। ভক্তটা মায়ের সঙ্গে বাবুর বাড়ি যায়। বাবুর বউটা মা ছেলেরে দুমুঠো ভাত দেয়। ভক্তও টুকটাক কাজ করে। দুপুরে শুয়ে থাকা বাবুর পাকা চুল তোলে। যদিও মা জেগে থাকলে পাকা চুলে হাত দিতে পারে না। কাহারের ছেলে। ভক্তটা হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। বিরাট মায়ের পিছনে বসে ঘ্যান ঘ্যান করছে। মা ব্যাগড় ব্যাগড় করেই চলেছে। বাপ বেঁচে থাকাকালীন জ্যান্ত বাপটারে গালাগালি করত। এখন মরা বাপরে বাপ বাপান্তর করে। চোখটা চুল্কে উঠতেই পাঁচি চোখে হাত দিয়ে দেখে, চোখের জল শুকিয়ে গিয়ে ধুলোর গায়ে জমে রয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রবল বিতর্কের মধ্যে দিয়েই হস্তিনাপুরের রাজা হলেন ধৃতরাষ্ট্র
মায়ের যখন যার ওপর রাগ হয়, তখন তাকেই ‘বাপখাগী’, ‘বাপখেগো’ বলে ডাকে। আসলে দশবছর বয়সে পাঁচি বোঝে। মা পেরে উঠছে না। সেই ভোর থেকে নিয়ে রাত পর্যন্ত মায়ের খাটনির শেষ নেই। হাঁড়িতে ভাত রেঁধে দিয়ে, ভক্তরে সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। তারপর থেকে ছোটোভাই বিরাটের দায়িত্ব পাঁচির। বাবা মরার পর থেকে একটা দিনও বসেনি পাঁচির মা, পাড়ায় থাকলে ঘেনে বউ বলে ডাকে। দুগ্গা পুজো মিটেছে আজ মাস ঘুরতে গেলো। শীতের ঠান্ডা বাতাসের ধাক্কা মাঠের থেকে আসে। ঠিক তেমনি, ঝড় আর জলের সময় টেঁকা দায়। দুগ্গা পুজোর মাস খানেক আগের তারে বর্ষা তখন, মাথার ওপর হঠাৎ পটকার আওয়াজ। কামান দাগার আওয়াজও নাকি ছিল। খুব ভয় পেয়েছিল ওরা তিনভাই বোন। ‘কি হচ্ছেগো মা’— পাঁচি জিজ্ঞেস করেছিল। তিনটের গায়ে হাত রেখে বলেছিল ‘দেশ নাকি স্বাধীন হচ্ছে। চৌধুরবাবুরা বলছিল।’ পরের দিন বেলায় মা রেগে ছোটভাইটাকে কোলে নিয়ে বাড়ি এল। গ্রামের এক মাস্টারের কাছে গিয়েছিল। যদি ঘরখানা ছাওয়ার কিছু পাওয়া যায়। মাস্টার নাকি শুধু হেসে, বাড়ি ফিরে যেতে বলেছে। ওইদিনও বাপকে গাল পাড়ছিল মা। তখন পাঁচির মনে পড়ে, লালমুখো সাহেব, তিতুমির আর বাপের ঝাঁপিয়ে পরার ইচ্ছার কথা। হঠাৎ গায়ে একটা হাত পড়ে। পাঁচি তড়াক করে মাকে জড়িয়ে ধরে। মাও ভয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে। ভক্ত আর বিরাট তখন ঘুমের রাজ্যে। খেনে বউ যেন দুঃখের বয়ামখানা উজাড় করে দেয় দশ বছরের পাঁচির জন্য। পাঁচির কান্না বেরোয়। শুধু সে মায়ের জন্য তা নয়। বাপের জন্য মন খারাপ করে তার। যদিও মারে সে কোনদিন বলে না। “চল ভাত খাবি চল। ও দুডোরে ডাক। না ওঠে তো ঘুমের মধ্যে ভক্ত ডারে দুগাল মুখে দে দিস। আমি বিরাড ডারে দেখতিস।”
আজ আর পিঠে দুঘা পড়েনি। পাঁচি সারাদিন বিরাটরে চোখে চোখে রেখেছিল। দিনের আলো গাছের তলায় আবছা হতে শুরু করলেই বাড়ির দিকে চলে এসেছে। যদিও চৌধুরীদের ঘন বাগানের থেকে রাস্তায় আলোর জোর ভালোই ছিল। তবুও মারে আর চেঁচাতে দেখে, রাতে চোখের জল ফেলতে দেখতে আর ভালো লাগে না পাঁচির। বাড়ি এসে অবাক দেখে মা উঠোনে চুপটি করে বসে আছে। চোখ দুটো লাল। শুকনো বিধবার মুখখানা আরও শুকনো যেন। কিছু বলে না পাঁচি। বিরাট মায়ের কোলে গিয়ে বসে। মা যেন ওঠার নাম নিচ্ছে না। রান্না করার জন্য দুটো কাঠপাতা। বিজলি আনেনি। যদিও বাড়ির পিছনে পাঁচি চৌধুরী বাগানের কাঠ জমা করে রেখেছে। আস্তে আস্তে ওঠে খেনেবউ।
‘পাঁচি উনুনডা ধরা দিকিন। আমি হাঁড়ি আর চাল নে আসি।’
আরও পড়ুন
উত্তমকুমারের ডামি হিসেবে রাজাদাকে খুঁজে পাননি চলচ্চিত্র-নির্মাতারা
পাঁচি স্বাভাবিক দেখে মাকে। উঠে যায় ঘরে। টেমি জ্বালিয়ে তিনভাই কোণে গুটি খেলছিল। হঠাৎ আজ শীতের ছোঁয়া লাগা সন্ধ্যায়। কে যেন বাড়ির উঠোনে এসে আস্তে করে হাঁক পারে ‘ঘেনে বউ’। পাঁচি বাইরে এসে দেখে মা উনুনের থেকে একটা কাঠ বার করে, শক্ত গলায় বলে ওঠে ‘কেডা?’। এই দ্যাখে গলা শুনে বুঝতে পাত্তিস নে, আমি মাধব।’
‘কী চাই?’ মায়ের গলা একটু জোরে হয়ে ওঠে। ‘তোর ছেলে মেয়ের জন্যি এই বাজার করে এনেছি দ্যাক। চাল, ডাল, তেল, নুন আর তোর একখান শাড়ি আছে।’
‘আমার এগুলো দরকার তোরে কেডা বলল? তুই এখান থেকে যা মাধব।’
আরও পড়ুন
পুজোর গান— শারদ অর্ঘ্য
ঘেনে বউ লক্ষ্য করেনি, পিছনে পাঁচি দাঁড়িয়ে আছে। মাধব পাঁচিকে দেখতে পেয়ে বলে ‘ওই ছুরি এগুলো ঘরের ভিতরে নে যা।’ খেনেবউ এবার চিৎকার করে উঠে বলে ‘এই বাপখাগী এখান কি করছিস? ঘরের খোলে যা।’ ভাইগুলোকে চ্যাঁচাড়ির দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে যায় পাঁচি। মার গলা শুনতে পায় তিনজন-
“দ্যাখো মাধব, তুমি যা মনে করতেসো, তা তুমি পাবে না, আর যদি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো, ঘরের থে কাটারি আনতে হবে বলো।”
তারপর মা ঘরের ভিতর দুরদুর করে ঢুকে এসে, তিনজনরে জড়িয়ে ধরে। মা বেশ কাঁপছিল, ঘেমে গেসল মায়ের গা। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছিল, আর চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। দুইভাই মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। পাঁচি খালি ভাবছিল, কী এমন চাইতে এলে মাধব খুড়ো যে মা একাজ করছে। বুঝতে পারচিল না। বুঝতে সময় লেগেছিল আরও পাঁচটা বছর।
আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ২
Powered by Froala Editor