পাঁচির পঞ্চকথা – ২

আগের পর্বে

হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে বেলেপুরে। তবুও তার মধ্যেই ছেলে শান্তনুর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছেন ছায়া। অফিস থেকে ফিরবে সে মধ্যরাতে। এগারোটা-সাড়ে এগারোটা মানেও এই শীতের সময় একটু গ্রামের দিক মধ্যরাত। স্বামী অনিলবাবুও ঘুমিয়ে পড়েছেন বহুক্ষণ। বৌমার গান শোনার অভ্যেস। একাই তাই অপেক্ষা করা। চাদরটা টেনে নিয়ে বারান্দায় বসলেন ছায়া। কুকুরগুলোকে খেতে দেওয়ার জন্যও ডাকতে হল বেশ কয়েকবার। এই শীতের দিনে সকলেই জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। ওদের খেতে দেওয়ার সময়ই কানে ভেসে এল ট্রেনের আওয়াজ।

মুখের পান চিবোতে চিবোতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে ছায়া। আজ সন্ধে থেকেই একটু মনটা খারাপ। যদিও শান্তি পেয়েছে মানুষটা, তবুও অনেক দিনের সম্পর্ক। উনিশশ চুয়াত্তর সাল থেকে দুজনার চেনা-জানা। চোখের সামনে কত পরিবর্তন দেখল এই বেলেপুরের। বাংলাদেশ থেকে সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। তখন অনিল মাঝের আড়ঙের ম্যানেজার। ছয় বোনের ছোটো বোন ছায়া। তাকে বিয়ে দিয়ে হেলথে আর রেলে চাকরি বড়দা মেজদা বাংলাদেশের বাস তুলে দেয়। এমনকি ছায়ার মা বাবাকে নিয়েও চলে আসে। পরে মাকে ছোটভাই। সে আজও বর্তমান। দেশের বাড়িতে। মাঝে মাঝে ছায়ার ইচ্ছা করে, ষোলো বছর বয়সে ছেড়ে আসা গ্রামখানাকে দেখতে। শুনেছে সেখানে মাটির বাড়ি বলে কিছু নেই। সব পাকা বাড়ি। পিচ রাস্তা তাদের বাড়ির উঠোন ছুঁয়েছে। তবে গাছপালার পরিমাণ কম। ছোটভাইয়ের ছেলে ছবি পাঠায়। একবার বলেছিল শান্তনু, বাবা মাকে দেশের বাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে বলে। বাবার তৎক্ষণাৎ জবাব – “না। তোর মা গেলে যাক। আমি আর ওদেশমুখো হব না।” ছায়া বোঝে মানুষটার কোথায় একটা কষ্ট আছে বাংলাদেশকে নিয়ে। অভিমান বলা যেতে পারে। হঠাৎ ঘরের ঘড়িটা থেকে বারোটা বাজার ডাক আসে। ‘না – শান্তনু আর এলো না’ – মনে মনে বলে ছায়া। উঠে বসে। একবার গেটের তলাটা নিয়মমাফিক দেখে নেয়। উঠোনের মন্দিরের দিকে তাকিয়ে প্রণাম ঠোকে। আর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে – ‘ভগবান সবাইকে ভালো রেখো’। ঠিক সেই সময় কানে আসে দূর থেকে ‘হরিহরি বোলো, হরিবোল।’ বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে ছায়ার। প্রায় ৪৬ বছরের সম্পর্কটা আজ একেবারে নির্মূল হয়ে গেল। পাঁচিকে পুড়িয়ে ফিরছে তার পাড়ার লোকজন। বৌদি বলে শেষ মাসতিনেক এ-চত্বর মাড়ায়নি পাঁচি। তবুও পাঁচির মেজো মেয়ের কাছে খবর নিয়েছে প্রায় রোজ। আর কিছু দরকার লাগলে বলিস, কারণ। পাঁচির জমানো টাকার ব্যাঙ্ক বলো, পোস্ট অফিস বলো, আর ফিক্সড ডিপোজিট সবই ছায়া। শুধু পাঁচির কঠিন নির্দেশ ছিল, “ আমি যদি তোমায় না বলি, তুমি আমায় মেয়ে পাত। কাউকে এ টাকা দেবা না বৌদি” – ছায়ার কানে ভেসে আসে সেদিনের কথা। সঙ্গে আরো বলেছিল “বৌদি আমো মরে যাই তালি পরে আমার মেজো মেয়েরে ডেকে দে দোবা।” শীতের রাত্রে ইথার পৃথিবীর বুকের উপর নেমে আসে। শব্দ ছুটে যায় দূর থেকে আরো দূরে। আরো পরিষ্কার শোনা যায় ‘হরিহরি বোলো, হরিবোল’।

শ্মশানযাত্রীদের ফেরার আওয়াজের সঙ্গে ছায়ার স্মৃতিতে ভিড় করে আসে পাঁচির জীবনের কথা। সেই সেদিনের কথা। যেদিন বড়ো মেয়ের ছেলেটা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলল। সেদিন উঠোনে বসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে পাঁচি বিড়বিড় করছিল – ‘এটারেও যদি জন্মের সময় গলাটা টিপে দিতি পারতাম, তালি আজকের মতো কষ্ট হত না।’ ছায়া সেদিন প্রশ্ন করেনি, কারণ পাঁচির ‘এটারেও’ মানে সে জানে। কানাঘুষো বেলেপুরে চাউড় হয়েছিল। কিন্তু পাঁচিরে জানতে দেয়নি সে। পাঁচি বলেছিল সেদিন তার জীবনের হরেক কথা। কথা নয়, দুঃখ, বিষাদ ভরা করুণ কাহিনি। ছায়াও খাওয়া দাওয়া ভুলে পাঁচির কথা শুনছিল। আজও সে কথা পৃথিবীর কাউকে জানায়নি সে।

সোফার কোনটাতে কখন এসে বসে পড়েছে কে জানে। শুধু জ্ঞানত একবার মনে মনে বলে, পাঁচ হাজার সাতশো কুড়ি টাকা কুলুঙ্গিটা তার মেজো মেয়ের কাছে খুলতে হবে। যদিও এর থেকে অনেকবারই টাকা নিয়েছে পাঁচি। ছায়া নিজের থেকে ভরে রাখে। শ’দুয়েক টাকা তার পক্ষে বিরাট বিষয় নয়। তবে পাঁচির বিশ্বাস পাওয়ার আনন্দটাই তার জীবনের অন্যতম প্রাপ্ত বিষয়। যদিও অনেক মনের কান্না ছায়া লালিত রেখছে তার মনের তরুছায়ায়। মা কোনদিন আলোর পৃথিবীর মুখ দেখেনি। দেখবেও না। সেটাই ছায়ার চাপা মনের কিঞ্চিৎ অহঙ্কার। মাকে সে লালন করে, পালন করে। শুধু পাঁচির সেদিনের কথাগুলো আজ ধারণ করতে কষ্ট হয়। নেমে আসে শীতের রাতের শিশিরের মতো, অদৃশ্যলোকে।

 ‘কোথায় গেলি বাপখাগি’ – চর থেকে কথাটা কানে পৌঁছাতে সময় নেয় না। মা খুঁজছে। এখনই যদি হাতের সামনে পায়, সারাদিনের রাগ তার ওপর তুলবে। তখন চৌধুরী বাগানের নিচে গোল করে গাদি খেলছিল পাঁচি। ছোটোভাইটা মাটিতে শুয়ে। দুএক প্রকার কেঁদেছিল। কিন্তু হুঁশ নেই দশ বছরের মেয়ের। আর মা সেই সকাল বেলায় বাবুদের গোলায় কাজ করতে বেরিয়ে যায় পাঁচির কাছে রেখে। পাঁচির দুই ভাইয়ের তুলনায় মায়ের শাসনটা যেন তার ওপর একটু বেশি। পাঁচির পরের ভাইটার নাম ভক্ত আর ছোটোটার নাম বিরাট। এই তিনজনকে বলতে গেলে মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিয়ে পাঁচির বাবা ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেলো। তখন পাঁচির আট, ভক্ত ছয়, আর বিরাটটা মায়ের দুধ খায়। বাপটা খুব যে খারাপ ছিল তা নয়। মাঠের কাজ করত লোকের জমিতে, আর সন্ধের পর গাঁজায় টান দিত। ব্যাস্। বোমভোলে হয়ে মায়ের জানায় জানায় ব্যাগড়ব্যাগড় শুনত কি শুনত না পাঁচি জানে না। বাপটা গান গাইত হরে কেত্তন। কিন্তু ঐ বাড়ির উঠোনে। কারণ, কাহারপাড়ার ছেলে কেত্তন গাইছে শুনলে গ্রামের পুরুষ বা ব্রাহ্মণের দল পিটিয়ে মারবে। একবার পাঁচিকে সঙ্গে নিয়ে ঈশ্বরীগাছায় বাপ কেত্তন গান শুনতে গিয়েছিল। নবদ্বীপ থেকে নাকি কেত্তন গাইবার জন্য কে এসেছিল। দূর থেকে বসে বাপ মেয়ে শুনেছিল। বাপের চোখের জল দেখেছিল পাঁচি। আর একটা অদ্ভুত মানুষকে দেখেছিল সে। দূরে এক চেয়ারে বসে রয়েছে এক লাল চুলের লোক। পায়ে কালো মতো কী একটা হাঁটু অবধি পরা। আর গায়ে সাদা রঙের জামা।

আরও পড়ুন
‘আমায় যে হত্যা করেছিল সে তোমাদের মধ্যেই আছে!’

Powered by Froala Editor