পাঁচির পঞ্চকথা – ১০

পাঁচির পঞ্চকথা – ১০
আগের পর্বে

বিয়ের পর পাঁচির নতুন ঠিকানা হয়েছে ঈশ্বরীগাছায়। বিয়ের পর নিয়মমাফিক দু’বার গিয়েছিল মায়ের কাছে। প্রতিবার ফিরে এসেই উথালপাতাল চলেছে মনের মধ্যে। বাড়িতে ছোট ননদ আর শাউরি। শাউরি মানুষটা খুব একটা ভালো না। ননদের সঙ্গে ঘুঁটি খেলার জন্য একদিন বেশ খানিকটা রোশের মুখে পড়তে হয়েছিল পাঁচিকে। রাতে আদর করতে করতে স্বামী হেবোল প্রসঙ্গ তুলেছিল সেই কথার। আশ্চর্য লেগেছিল পাঁচির। কীভাবে পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছল ঘরের কথা? পরদিন টের পেয়েছিল অলক্ষ্যে স্বামী-স্ত্রীর আলোচনাও পৌঁছেছে তার শাউরির কানে। হেবোল কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পরই প্রতিবেশীর সঙ্গে একচোট চেঁচামিচি হয়ে যায় শাউরির। অন্যদিকে ঘরের দাওয়ায় বসে কাঁপতে থাকে পাঁচি। তারপর...

শরীরটা কদিন ধরেই দিচ্ছে না পাঁচির। মাস দুয়েক যেতে না যেতেই গা থেকে নতুন বউয়ের গন্ধ মিলিয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে শাউরি মায়ের কাছে। সকাল, বিকাল মানে যতক্ষণ ছেলে বাড়ি না আসে, কিরকম খেঁকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মা, দুই ভাইয়ের জন্য মন কাঁদে পাঁচির। যদিও মা খবর নিয়েছিল মাঝে নলে কাকারে দিয়ে। নলে কাকার মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তারই শ্বশুরবাড়ির পাড়ায়। সঙ্গে করে গোটাচারেক নারকেল আর ভাজা মুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল মা। নারকেল পাওয়ার পর সেখানা হাতে করে বসেছিল পাঁচি। নারকেলের গায়ে নিজের বাড়ির গন্ধ খুঁজছিল যেন। ভক্ত, বিরাট আর বাপখাগি বাপ মাটার গন্ধ। কিছু পরে শাউরি যখন বাড়ি এল, কাঠ পাতা কুড়িয়ে এমন করে বলল - নারকোল ধরে বসে আছো কেন, তোমার কি কোনো কাজ নেই? 

পাঁচি বলেছিল- আসলে আমাদের গাছের নারকোল। মা পাঠিয়েছে। 

‘হ্যাঁ তা ওই সারাদিন ধরে বসে থাকো আর কি?’

এঁটো কটা বাসন পুকুরে মাজতে যাওয়ার নাম করে চোখের জল ফেলতে গিয়েছিল। কিছু সময় পড়েই হাজির হয়েছিল ছোট ননদটা। কোথা থেকে খানিক তেঁতুল এনে পাঁচিরে খাওয়ার জন্য বলে। এই একখানা মানুষ সে পেয়েছে। সে তার একটু হলেও বাড়ির চিন্তা থেকে দূরে রাখতে পারে। তবে শয়তানিও খুব ননদের কথা একবার না মানলে খালি শাউরিরে বলে দেওয়ার ভয়।  

বিয়ের প্রথম প্রথম হেবোল রাতে টুকটাক কথা বলত তার সঙ্গে। এখন যেন কথা অনেকটা কমে গেছে। আসলে মানুষটা সারাদিন হাড়খাটুনির পর আর শরীরে দেয় না। তবে আরেকটা বিষয় এযাবৎ পাঁচি লক্ষ্য করেছে। মাঝে মাঝে হেবোল কিরকম অচৈতন্য হয়ে বাড়ি ঢোকে। হেবোল নেশা করে কি না ঠাহর করতে পারে না। কারণ, বাপরে সে ছেলেমানুষ বয়সে দেখেছে। মায়ের কাছে বাপের নেশা করার কথা শুনেছে পাঁচি। সাহস করে হেবোলরে জিজ্ঞাসা করতে পারে না সে। এদিকে যেদিন যেদিন ওরকম অবস্থায় ফেরে সেদিন সেদিন শাউরি যেন একটু বেশি যত্ন নেয় ছেলের। ‘ছেলে খাবে ছেলে শোবে’, একথা গুলো যেন বেড়ে যায়। পাঁচির বিয়ের পর থেকে শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া আর কোন আনন্দ সে পায়নি। প্রথম প্রথম খুব ভয় পেত সে। রাত হলেই কীরকম ভয় তাড়া করে আসত। তবে মাস ঘুরতেই কিরকম পাঁচির মন বুঝতে পারে। পুরুষের শরীর রাতের অন্ধকারকে ভেদ করে, আরেক রূপ ধারণ করে। সেখানে মানা না মানা কিছুই দাঁড়ায় না। আজও সময়ের নিয়ম অনুযায়ী শুরু হয়েছিল শরীরের খেলা। পাঁচির শরীর কিরকম পাকিয়ে ওঠে। যদিও কদিন ধরেই একটু খারাপ যাচ্ছিল। আজ আর সে শুয়ে থাকতে পারে না। গলা দিয়ে খাবার ভাত তরকারি বেরিয়ে আসে। পাঁচি কোনরকমে শাড়ি, শরীর সামলে নিয়ে ঘরের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে উল্টে দেয়। শাউরি ধড়মড় করে উঠে পড়ে। ননদটাও শাউরির পাশে বসে। হেবোল ঘরের ভেতর থাকে। হয়তো, পাঁচির ভেতরে যাওয়ার আর কাজসম্পন্ন হওয়ার অপেক্ষা রয়েছে। পাঁচির সে কথা ভাবতে অসুবিধা হয় না। শাউরি মা পাঁচিরে কি যেন জিজ্ঞাসা করে। ননদ শুনতে পায় না। পাঁচি মাথা নাড়ে। শাউরি মা বলে- ‘এখন আর কাঠ কুড়োতি যেতে হবে নি। আমি আর এই ছুরি যাবোখন। তবে একেবারে শুয়ে পড়ো না যেন।’

পাঁচির সেই রাত তার জীবনে আরেক রাত হয়ে আসে। দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না, অনবরত চোখের জল বয়ে যায়। মায়ের কাছে ছুটে চলে গিয়ে লুকোতে ইচ্ছা করে, পাশে হেবোল কাহিল শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে চলেছে। পৃথিবীর কোনো আওয়াজ, কোনো অবস্থায় পাঁচিরে ছুঁতে পারে না। আজ অবধি পাঁচির জীবন একপ্রকার ছিল। আজ থেকে কেমন যেন অজানা অনুভূতি তাকে আরেক মানুষ করে তুলছে। কিছু মাথায় আসে না। সকালের আলো, সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো অকল্পনীয় লাগে। চোখের জলের ধারা, আর নিজের শরীরের অন্তদে সেই অঙ্কুরে হাত বোলানো চলতে থাকে। 

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা - ৯

প্রথম সন্তানের জন্মানোর গল্প থেকে জীবনের শেস দিনলিপি সবই পাঁচি ছায়ার উঠোনে সময়ে সময়ে উজাড় করে দিয়েছে। হঠাৎ গেট খোলার আওয়াজে ছায়ার চমক ভাঙে। তাহলে শান্তনু এলো। শীতের রাতে কুয়াশার বুক চিরে শান্তনুর গাড়ির আলো আসে। ছায়া আজ রাতের মতো ঘেনেবউ, ভক্ত, বিরাট, পাঁচি, হেবোল, শাউরি, ননদ আর আগামীর কুলুন্দিতে চাপা দেয়। যা সে কোনদিন কারো কাছে খুলবে না। সে তারই সম্পত্তি।

Powered by Froala Editor