পাঁচির পঞ্চকথা

আজ থেকে প্রহরে শুরু হচ্ছে নতুন উপন্যাস 'পাঁচির পঞ্চকথা'। বিশ্বনাথ বসুকে অভিনেতা হিসাবেই আমরা চিনি। কিন্তু সেই পরিচয়ের আড়ালে থাকা লেখকসত্তাকে তিনি তুলে এনেছেন এই উপন্যাসে। এর মধ্যে আছে তাঁর শৈশব-কৈশোরে দেখা গ্রাম এবং সেই গ্রামে দেখা নানা চরিত্রের আখ্যান। আজ  প্রথম পর্ব।



বাড়ির খাওয়া দাওয়া মিটতে মিটতে রাত এগারো সাড়ে এগারোটা হয়ে যায় ছায়াদের। আর যদি ছেলে শেষ রাত্রে ফেরে, তাহলে এখনও আধো আলো চোখে অপেক্ষা করে ছায়া। বৌমা দুটো বাচ্চা নিয়ে ওপরে শুতে চলে যায় এগারোটার মধ্যে। এদিকে অনিল মানে ছায়ার পতিদেব তিনি তার সময় অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করেন। সে চাকরি থাকাকালীন সময় থেকে আজ রিটায়ারমেন্টের বারো বছর বাদেও। তবে বিগত আট দশ দিন রুটিনটা একটু পরিবর্তন হয়েছে; এবারের শীতটা গ্রাম পাড়াগাঁয়ে একটু জাঁকিয়ে বললে কম হবে। একেবারে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপার মতো অবস্থা। সারাদিন বেলেপুরে লোক চলাচল থাকলেও, বিকেল গড়াতেই সব ফাঁকা শুনশান। বাজারে যাতায়াত করা সারা বছরের মানুষজনও কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মাঝে মাঝে সাইকেল বেলের আওয়াজ কিংবা দু-একটা বাটর গাড়ির শব্দ কানে আসে রাস্তার ধারে ঘর থাকার জন্য। ছায়ার অভ্যাস গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত এই জাত ঋতু অনিলবাবু, যিনি এই মাসেই বেলেপুরে পরিচিত। তাকে খেতে দিয়ে তারপর তিনটি ঘরের বাইরের লোকদের খাইয়ে তারপর শুতে যাওয়া। তাও আবার যদি ছোটোবেলার কথা, কিংবা বাংলাদেশের স্মৃতি চোখের বা মাথার মধ্যে এসে ভিড় করে, তবে নিজেকে সংসার, ছেলে মেয়ে সবথেকে সরিয়ে বাড়ির বারান্দাটায় আরো আধঘণ্টা এক ঘণ্টা কাটিয়ে নেয়। তার মধ্যে শান্তনু ফিরে আসে। কারেন্ট অফিসের চাকরি, দশটা-পাঁচটা তো নয়। বর্ষা আর কালবৈশাখীর সময় তো অফিস থেকে অর্ধেক দিন বাড়িমুখও হতেই পারে না। তাছাড়া গ্রামেগঞ্জে গাছপালা বেশি থাকার জন্য ফল্টও হয় ঘনঘন। তবে শান্তনু আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। হাফ রাত্রে বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে, বাইরের বারান্দায় বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করে। এমনও অনেকদিন হয়েছে মা ছেলের গল্প সকালের আলো দেখিয়েছে দুজনকে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় বছর কুড়ি। জামাই ভদ্র চাকরি ও স্বভাবে, এক নাতিও; কলেজে পড়ে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে সেরকম কষ্টের ছোঁয়া নেই। একসময় অসম্ভব লড়াই ছিল ছায়ার। স্বামী সাধারণ চাকরি করত ট্রাম কোম্পানিতে। বাড়িতে বৃদ্ধা শুচিবাইগ্রস্ত শাশুড়ি। আর নিত্যনতুন অভ্যাগত লেগে থাকত। আসলে তো আর কাউকে জানিয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া বাঙাল হওয়ার দৌলতে একটু বেশি অতিথিপরায়ণ ছায়া। এমন কথাই বেলেপুরের আদি বাসিন্দারা বলে। সকাল থেকে এবাড়ির চায়ের সসপ্যান নামত না স্টোভ থেকে। একমুখ হাসি সবাইকে উপহার দিয়ে গেছে। অনিলবাবু আবার মাছ পাগল। আসলে দেশের বাড়ি ছেড়ে এসেছে আজ প্রায় ষাট বছর, তবুও বাংলাদেশের মাছের গন্ধ নাকে লেগে আছে। মাছবিহীন অনিলবাবু আর জলহীন মাছ একই রকম। 

আজকের ঠান্ডায় কুকুরগুলোকে বার কয়েক বেশি ডাকতে হল ছায়ার। আসলে প্রবল ঠান্ডায় তারই দেওয়া চটে একেবারে গোটানো কেন্নোর মতো পড়ে আছে। কুকুরগুলোকে খেতে দেওয়ার সময় হঠাৎ কানে ভেসে এল একটা ট্রেনের আওয়াজ ও হর্ন। তার মানে এখন এগারোটা কুড়ি হবে যদি ঠিক সময় ট্রেনটা দৌড়ে থাকে। অনিলবাবু শুতে চলে যান সেই সঙ্গে সাতটায়। কোনোদিন ইচ্ছা হলে খেতে ওঠেন তিনটে রুটি আর দুধ। আর যেদিন উঠতে পারেন না, সেদিন খাটে বসেই দুধমুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েন। ঠান্ডায় ছায়ারও হাঁটুর ব্যথা যেন বেড়েছে কিঞ্চিৎ। এখন সকালে অনিলবাবু যখন ঘুরে ঘুরে বাগান ঝাঁট দেন, তখন উঠোনে পায়চারি করে ছায়া। ছেলে বারান্দায় থেকে তদারকি করে। বৌমা একটু দেরিতে বিছানা ছাড়ে, কারণ রাতে গান শোনা অভ্যাসে আছে। বিয়ের প্রথম দিকে শ্বশুর শাশুড়ি এমনকি পাড়ার অনেকেই শুনতে পেত। বড়ো মেয়েটার হওয়ার পর থেকে গান শুধু তানিয়ার কানে গিয়ে পৌঁছয়, হেডফোন দিয়ে। পাছে মেয়ের ঘুম ভেঙে যায়। বিয়ের পনেরো বছর বাদে মেয়েদের সকালে ওঠা বা পড়তে বসার খাতিরে হেডফোন কালোত্তীর্ণ হয়েছে। ছায়া ট্রেনের আওয়াজ পাওয়ার পরে মনে মনে ভাবে শান্তনু বোধহয় আসছে। যদিও মোবাইলে জানা যায়, তবুও মন চায় না ফোন করতে। কারণ, স্টেশন থেকে এই তিনমাইল ছোট্ট স্কুটিতে করে ফেরে। পাছে ফোন ধরতে অসুবিধা হয়। আজ নাইট ডিউটি করতে হতে পারে বলে বেরিয়েছিল। তাই ছায়া ফোন করেনি। বৌমা হয়ত জানে ফেরার খবর। বাইরে শিশির পড়ার আওয়াজ স্পষ্ট পরখ করে ছায়া। পাশের কাশ বাগানের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে। আবার কলাবাগানের ওপর যে নারকোল গাছখানি আছে, সেখান থেকেও চুইয়ে পড়ছে শীতল জলকণা; পূর্ণিমার রাতে স্ফটিকের মতো চোখে ঠাহর হয়। কিন্তু এখন ঘোর অমাবস্যা। রাস্তার সরকারি পোলের আলোগুলোও ভিজে উঠেছে। মনে হয় যেন কেউ বাল্বের গায়ে খানিকটা ভেসলিন লাগিয়ে রেখেছে। তার মাঝখান থেকে আলোক শিখা ছটার মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। 

ঘর থেকে বড়ো মোটা চাদরটা গায়ে দিয়ে বসে ছায়া বারান্দার সোফাতে। প্রথমে ভাবে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। আর শান্তনু এসে দেখে যদি মা বাইরে, রাগ করবে। যতই রাগুক ছেলে, মাকে ভালোবাসে। আজকের বৃদ্ধাশ্রমের বাজারে এই অনেক পাওয়া। তবে বৌমার সঙ্গে রুটিনমাফিক কথা বন্ধ থাকে। সে শান্তনু’র কারণেই। না হলে ছায়া সাতচড়ে রা কাটবার মহিলা নয়। হ্যাঁ ঠোঁটকাটা শ্বশুরের জন্য গোল বেঁধেছে সংসারে। ছায়া একবার বুঝিয়েছিল তানিয়াকে। শান্তনু বন্ধ ঘরে রোজ বোঝায়। কিন্তু দুজনেই দমবার পাত্র বা পাত্রী নয়। 

‘বাবা খেয়ে নাও, বেলা হচ্ছে’
‘ও বাবা স্নানে যাবে না?’
‘এই দ্যাখো কত মাছ এনেছে’
‘আবার চা খাবে?’
‘তোমার এই মাছের ছবি দেখার জন্য’
‘মনে রেখো প্রিয়তমা সিরিয়ালটা দেখা হল না’

আরও পড়ুন
‘নিচু জাতের’ হওয়ায় হেনস্থা, অপহরণ, ধর্ষণ; ক্রমশ ডাকাতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে গৌরী

বলার পরের দিন নতুন টিভি আনতে বাধ্য করেছিল ছায়া শান্তনুকে। বৌমা কতবার বলেছে “বাবাকে খাওয়া দাওয়ার তাড়া দিও না বৌমা। স্বাধীনচেতা মানুষ, নিজের কাজের পরে নিজেকে নিয়েই থেকেছে।” কিন্তু শ্বশুর আর বৌমার দড়িটানাটানি থামেনি। বৌমারও গোঁ - ‘আমার নিজের বাবা বেঁচে থাকলে যা করতাম তাই করছি’ ব্যস।

অলংকরণ - ছন্দক গুহ

আরও পড়ুন
বন্দুক, উপত্যকা ও রানা পরিবারের গল্প

Powered by Froala Editor