‘কালাপানি’ আন্দামান - ৯
আগের পর্বে
মানিকতলার বাগানবাড়ি থেকে বারীনদের গ্রেপ্তারের পর, তোলপাড় পড়ে যায় কলকাতায়। প্রচুর অস্ত্র, বোমা বাজেয়াপ্ত হয়। বন্দি করা হয় অরবিন্দ ঘোষ-সহ বহু বিপ্লবীকে। তবে জেলে বেশিদিন খবর চাপা থাকেনি জমিদারবাড়ির ছেলে নরেন মুক্তির লোভে হতে চলেছে রাজসাক্ষী। কাজেই দরকার পড়ে তাকে সরিয়ে দেওয়ার। হয়ও তেমনটা। জেলে লুকিয়ে নিয়ে আসা রিভালভার দিয়েই তাকে হত্যা করেন বিপ্লবী সত্যেন বসু এবং কানাইলাল। ফাঁসি হয় দু’জনেরই। তবে কানাইলালের শেষযাত্রায় মানুষের ঢল দেখে সত্যেন বসুর দেহ দাহ করা হয় জেলের মধ্যেই। তবে আলিপুর বোমা মামলার বাকি ১২ জন মূল বিপ্লবীদের ফাঁসির দণ্ড থেকে বাঁচান চিত্তরঞ্জন দাশ। তাঁদের শাস্তি কমে দাঁড়াল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে। তারপর...
উনিশ শতকের শেষ ভাগে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে, তখন ব্রিটিশ শাসক আন্দামানে একটি বড়ো বন্দিশালা গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে আন্দামানের মাটিতে ঘটে গেছে ভয়ংকরতম ঘটনা, পৃথিবীর ইতিহাসে যা নজিরবিহীন, ঔপনিবেশিক শাসনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূ বড়োলাট, লর্ড মেয়োর হত্যা। ঠিক হল আন্দামানে যদি রাজদ্রোহীদের পাঠাতেই হয় তাহলে এমন ব্যবস্থা করা দরকার যাতে সেখানে তারা কোনমতে নিজেদের মধ্যে মেলামশা না করতে পারে। ১৮৯০-এর লায়াল এবং লেথব্রিজ কমিটির সুপারিশে ১৮৯৬ – ১৯০৬ আন্দামানের বিভিন্ন দ্বীপের (ভাইপার, নেভি বে, ফিনিক্স, ব্রিচগঞ্জ, ডানডাস পয়েন্ট প্রভৃতি) বন্দিদের দিয়েই গড়ে তোলা হল সেলুলার জেল। ভাইপার আইল্যান্ডের বন্দিদের দিয়ে ২০,০০০ কিউবিক ফুট পাথর ভাঙানো হল, বার্মা থেকে নিয়ে আসা হল প্রচুর পরিমাণে নির্মাণ সামগ্রী, বিশেষত তামাটে রঙের ইঁট যা দিয়ে সেলুলার জেলের দেয়ালগুলি তৈরি। ১৮৯৭ সালের মধ্যে ৪০০-টি সেল প্রস্তুত হলেও পুরোটা শেষ হতে ১৯০৬ গড়িয়ে গেল। পোর্ট ব্লেয়ারের অ্যাবারডিনে আটলান্টা পয়েন্টে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০ ফুট উচ্চতায় গড়ে উঠল সেলুলার জেল।
এই সেলুলার জেলের গঠনটি অনন্যসাধারণ। এটা অনেকটা দেহের সেল-এর মতো, একে অপরকে নজরে রাখে। জেরেমি বেনথাম-এর প্রস্তাবিত ‘প্যানঅপ্টিকন’-এর আদলে এই আদর্শ কারাগারটি তৈরি করা হল। প্রবেশ দ্বারে একটি বিশাল লোহার ফটক। প্রথমেই প্রশাসনিক ব্লক। মেন গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটি অঙ্গন। সেখানে সদ্য প্রবেশ করা বন্দিদের প্রথমেই নিরাশ করে ভয় দেখানোর জন্য উপদেশ বিতরণ করা হত। এখান থেকে জেলের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এক রহস্যময় ভয়প্রদ রূপ ধরা দিত। এই জেলের কাঠামো প্রথমদিনই যেন বলে দিত এখানে প্রবেশের দরজা আছে কিন্তু বেরিয়ে যাবার কোনো রাস্তা নেই। ওই অঙ্গনের আরো ডানদিকে রয়েছে দুটি রান্নাঘর – একটি হিন্দুদের জন্য এবং অপরটি মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট। রান্নাঘরের পাশেই ফাঁসিমঞ্চ। এখানকার ফাঁসিমঞ্চে একসঙ্গে তিনজনকে ফাঁসিতে চড়াবার ব্যবস্থা ছিল।
সেলুলার জেলে মোট ব্লকের সংখ্যা সাতটি। একটি কেন্দ্রীয় মিনার বা গম্বুজকে কেন্দ্র করে বাইসাইকেলের সাতটি স্পোকের মতো সাত দিকে প্রলম্বিত সাতটি ব্লকের বিস্তৃতি। সেলুলার জেল যেন একটা বিষাক্ত মাকড়সার মতো। শুধু তার সাতটি পা, মাঝখানে একটা লম্বা টাওয়ার। পুলিশের চোখ সর্বত্র। সাতটি ব্লকের প্রতিটি উইং তিনতলা। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি চারতলা। প্রত্যেক ব্লকের প্রতিটি তলে ঢোকা ও বেরনোর রাস্তা শুরু হয় শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় মিনার থেকে। এই কেন্দ্রীয় মিনারে রয়েছে একটি বড়ো ঘন্টা, যা প্রত্যেক ঘন্টায় ও বিপদের সময় বাজানো হয়। দিনের বেলা কয়েদিদের কাজের জন্য বাইরে বের করা হয় আর সন্ধ্যার আগেই তাঁদের নির্দিষ্ট সেলে আবদ্ধ করা হয়।
এই সেলুলার জেলে মোট সেল বা কুঠুরির সংখ্যা ছিল ৬৯০ (বারীন্দ্রনাথ ঘোষের হিসাবে, দ্বীপান্তরের কথা, ও অন্য রেকর্ডে সেলের সংখ্যা পাওয়া গেছে ৬৯৮)। এই জেলে কোনো ব্যারাক বা ডর্মিটরি নেই। প্রতিটি সেলই স্বতন্ত্র, তাই এই জেলের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সেলুলার জেল’। এখানে এক একটি সেলের পরিমাপ ১৩.৫ x ৭ ফুট। প্রতিটি সেল লোহার গরাদযুক্ত ফটক দিয়ে আঁটা। এই লোহার ভারী দরজাগুলি বাইরের দিকে এমনভাবে তালা দিয়ে আঁটা হয় যে সেই তালায় ভেতর থেকে হাত পাওয়া কোনো বন্দির পক্ষেই সম্ভব নয়। সেলের ভেতরে পেছন দিকে মেঝে থেকে ১০ ফুট ওপরে একটি ৩ x ১.৫ ফুটের লোহার গরাদ দেওয়া ভেন্টিলেটর যার বাইরের দিকে রয়েছে হেলানো কার্ণিস। প্রতিটি সেলের একমাত্র ঢোকা-বেরনোর পথ সামনের বারান্দার দিকে।
আরও পড়ুন
আলিপুর বোমা মামলা এবং এক বেইমানের শাস্তি
বারীন্দ্র কুমার ঘোষের দ্বীপান্তরের কথা থেকে আমরা জানতে পারি, কুঠুরিগুলি সারি দিয়ে লম্বা চলে গেছে, আর তাদের সামনে দিয়ে একটি তিন চার ফুট চওড়া বারান্দা। বারান্দাটি গরাদে ঘেরা, তার মাঝে মাঝে থাম এবং থামগুলির গায়ে খিলানের মাঝে লোহার শিকের দরজা, এই দরজাগুলি খিলানে আঁটা। সব দালানগুলির মুখ সেন্ট্রাল টাওয়ারে গিয়ে মিলেছে। এইখানে লাইন বা সেলসম্মুখস্থ বারান্দায় প্রবেশ করার ফটক। রাত্রে এ ফটক বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি ব্লক তিনতলা। রাত্রে প্রতি লাইনে চারজন করে ওয়ার্ডার থাকে। এরা প্রহরী। প্রতি তিনঘন্টা একজন করে হারিকেন লন্ঠন হাতে লাইনের এমোড় ওমোড় ঘুরতে থাকে এবং কয়েদিদের ওপর নজর রাখে। সমস্ত জেলে সাতটি ব্লকের একুশটি লাইনে একই সময়ে একুশজন ওয়ার্ডার পাহারায় থাকে এবং নিজের রাউন্ডের পালা ফুরালে অন্যকে জাগিয়ে দেয়। এইভাবে পালাক্রমে চুরাশি জন প্রহরী সারারাত ধরে পাহারা দেয়। গুমটিতে একজন পুলিশ সিপাই লন্ঠন হাতে – “অবিশ্রান্ত উপগ্রহের মত উপর নীচে ঘুরিতে থাকে। সে এক ব্লকের কাছে আসে, আর সেই লাইনের ওয়ার্ডার হাঁকিয়া রিপোর্ট দেয়, “বিশ তালা বন্ধ, চার ওয়ার্ডার, সব ঠিক হ্যায়”। এই পুলিশ ও লাইনের ওয়ার্ডারে ভক্ষ্য-ভক্ষক সম্বন্ধ, কারণ ওয়ার্ডার কখন দৈবাৎ বসিয়াছিল বা বাতি মাটিতে রাখিয়াছিল বলিয়া পুলিশ সান্ত্রী রিপোর্ট বা নালিশ করিলে ওয়ার্ডারকে শাস্তি ভোগ করিতে হয়। সেই ভয়ে তটস্থ ওয়ার্ডার বেচারী সিপাহী সাহেবের মন হরণ করিবার আশায় যে ছলা কলা হাব ভাব ও চাতুরী কৌশলের শরণ লয়, তাহার অর্দ্ধেক ছলনা মুনিমনহারী মেনকা রম্ভারা জানিতেন কিনা সন্দেহ, জানিলে ঋষির কুল বেমালুম উজাড় হইতেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।”
এক একটা সেলে আসবাব ও তৈজসপত্রের যে বর্ণনা পাওয়া গেছে তা হল – ঘরে আসবাবের মধ্যে দেড় হাত চওড়া একখানি নীচু তক্তপোশ, আর ঘরের কোণে এক একখানি আলকাতরা মাখানো মাটির ভাঁড়। এই খাটে ঘুম হয় খুব সজাগ, কারণ একটু অসাবধানে পাশ ফিরলেই মাটিতে পড়তে হবে। আর ওই আলকাতরা মাখানো “ভাঁড়টি জীবের বিষ্ঠা চন্দনে সমজ্ঞান আনিবার অপূর্ব যন্ত্র, কারণ ঐটিই রাত্রের শৌচাগার এবং তাহা লইয়া সুঘ্রাণে কৌতুহলে রাত্রি বাস করিতে হয় আর বসিবার সময় চুরাশী রকম আসনের অনেকগুলি এই ভাঁড়টির সাহায্যে অভ্যাস হইয়া যায়। এগুলি (সন্ধ্যায়) জেল বন্ধ হইবার কিছু আগে বৈকালে মেথর ঘরে দিয়া যায়, আর সকালে নিয়মিত সরাইয়া লয়।”
জেলের ভেতরে জলের ব্যবস্থাও খুব করুণ। প্রত্যেক ব্লকের সামনে খুব বড় উঠোন, সেগুলোর মাঝে একটা করে কারখানা, যেখানে দিনের বেলা তেল নিষ্কাষণ থেকে শুরু করে নানাধরনের কাজ চলে। এক পাশে জলের এক হাত চওড়া ও দশ হাত লম্বা চৌবাচ্চা আর টিনের সারি দিয়ে পায়খানা। জেলের বাইরে বাগানে সমুদ্রের ধারে একটা পাম্প আছে, তার কিছু দুরে বাগানের মাঝে প্রকাণ্ড চৌবাচ্চা। পাম্পে সমুদ্রের জল তুলে চৌবাচ্চা ভরা হয়, সেই জল নলযোগে সাতটি ব্লকের চৌবাচ্চায় যায়। এই জলে কয়েদিরা স্নান করে ও কাপড় কাচে। খাবার জলের কল গুমটির কাছে আছে, প্রত্যেক ব্লকের পানিওয়ালা সেই কলের ‘মিঠাপানি’ টিনে বা বালতিতে কয়েদিদের জন্যে ভরে রাখে। কিন্তু সেই জল অপর্যাপ্ত পরিমাণে পান করা চলে না। তেষ্টায় ছাতি ফাটলেও নির্দিষ্ট পরিমাণ জলের বাইরে কেউ জলপান করলে তার জন্যেও ছিল শাস্তির ব্যবস্থা।
এই সেলুলার জেলে দ্বীপান্তরিত বিপ্লবীরা অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত, ভদ্রঘরের সন্তান। তবু রাজবন্দির মর্যাদা এঁরা পেতেন না। তাঁদের বলা হত ‘রাজদ্রোহী’ বা ‘নৈরাজ্যবাদী’। এঁদের সঙ্গে নিকৃষ্ট অপরাধীদের মতো ব্যবহার করা হত। এঁদের বলা হত D-ক্লাস (Dangerous) বা PI (Permanently incarcerated) অর্থাৎ স্থায়ী বন্দি। এঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল বাস অযোগ্য মশা-মাছি-বিষাক্ত মাকড়সাযুক্ত সেল, হাড়ভাঙা খাটুনি, নিকৃষ্ট ও অপর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার এবং মারাত্মক শাস্তি। নোংরা গালাগাল, মারধোর, চাবুকের বাড়ি ছিল এঁদের নিত্যপ্রাপ্তি। সবসময় জারি ছিল কীভাবে এঁদের শিরদাঁড়া নমনীয় করে দেওয়া যায় সেই প্রচেষ্টা।
আরও পড়ুন
মানিকতলার আড্ডা
ব্রিটিশ আমলের সেলুলার জেল চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয় ১৯৩৭-এর ১৪-ই সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে শুরু হয় সেলুলার জেলে আটক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভারতের মূল ভূখণ্ডে ফেরানোর কাজ। এঁদের শেষ ব্যাচ দেশে ফেরত আসে ১৯৩৮-এর ১৮-ই জানুয়ারি।
Powered by Froala Editor