আলিপুর বোমা মামলা এবং এক বেইমানের শাস্তি

'কালাপানি' আন্দামান - ৮
আগের পর্বে

অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন ঘোষ শুরু করেছিলেন যুগান্তর পত্রিকা। পত্রিকায় দেশাত্মবোধ, মুক্তিবিষয়ক লেখাই অপরাধের কারণ হয়ে ওঠে ইংরেজদের কাছে। শুধু যুগান্তরই নয়, একাধিক বাংলা দেশাত্মবোধক পত্রিকার মালিক, সম্পাদক এবং লেখকদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিরোধের পথ রুদ্ধ হওয়ার পর সশস্ত্র বিদ্রোহের কথা ভাবেন বারীন ঘোষ। মানিকতলার বাগানবাড়িতে শুরু হয় বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। একে একে সেখানে জড়ো হয় তরুণ বিপ্লবীরা। সেখানে বোমা বানাতেন ফ্রান্স থেকে বোমা বানানোর কৌশল শিখে আসা হেমচন্দ্র। আর সেই বোমা দিয়েই হত্যার চেষ্টা হয় কিংসফোর্ডকে। সেই ঘটনার পর একদিন মধ্যরাতে বাগানবাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। গ্রেপ্তার হন বারীন-সহ ১৪ জন বিপ্লবী। শুরু হয় আলিপুর বোমা মামলা। তারপর...

মানিকতলা বাগানবাড়ি থেকে বারীনদের গ্রেপ্তারের পর শুরু হল ব্যাপক ধরপাকড়। অভিযান চলল সারা কলকাতা জুড়ে। বাজেয়াপ্ত হল প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র-বোমা-কার্তুজ, জাতীয়তাবাদী পুস্তিকা প্রভৃতি। গ্রেপ্তার হলেন হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো) এবং অরবিন্দ ঘোষ। পরে সম্পর্কে আরবিন্দ-বারীনের মামা, মেদিনীপুরের বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে গ্রেপ্তার করে এই মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হল। আর শ্রীরামপুরের জমিদারবাড়ির ছেলে বারীনের গুপ্ত সমিতির অন্যতম সদস্য নরেন গোস্বামীও পুলিশ হেফাজতে এলেন মে মাসেই।

আলিপুর বোমা মামলা শুরু হতে প্রথম পর্বে চলছে জবানবন্দি নথিবদ্ধ করার পালা। চব্বিশ পরগণার জেলাশাসকের কাছে নরেন গোস্বামীর বয়ান নথিভুক্ত হতেই আলিপুর জেলে খবর ছড়িয়ে গেল যে নরেন অরবিন্দসহ সুবোধচন্দ্র মল্লিক, চারুচন্দ্র দত্ত এবং আরো অনেককে জড়িয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন এবং রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়েছেন। এর বিনিময়ে তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। আপাতত তাঁর নিরাপত্তার জন্য তাঁকে অন্যান্যদের থেকে সরিয়ে রাখা হবে হাসপাতালের ইউরোপীয়দের জন্য বরাদ্দ ওয়ার্ডে এবং সর্বক্ষণের পাহারায় রাখা হবে হিগেনস নামে এক ইউরোপীয় রক্ষীকে।

নরেন ছিলেন জমিদারবাড়ির ছেলে। আদরে-বিলাসিতায় মানুষ। অনেক বিপ্লবী বড়োলোকের ঘরের সন্তান হয়ে কৃচ্ছসাধন করেছেন তার উদাহরণ থাকলেও জেলের ভেতরে পুলিশের অত্যাচার এবং হাজতবাসের কষ্ট সহ্য করার মানসিকতা নরেনের ছিল না। তাঁর বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়াটা অনেকটাই হুজুগ। মামলায় অভিযুক্তদের রাখা হয়েছিল জেলের ৪৪ ডিগ্রি ওয়ার্ডে। এখানে সার দিয়ে সাত হাত লম্বা আর পাঁচ হাত চওড়া ৪৪-টি কুঠুরিতে দু-তিনজনকে রাখার ব্যবস্থা। আলো-বাতাস এখানে প্রায় ঢোকেই না। তাছাড়া কুঠুরির ভেতরেই এককোণে দুটি গামলা রাখা থাকে পেচ্ছাব আর পায়খানা করার জন্য। এর ওপর খাবার কষ্ট তো আছেই।

নরেন যতদিন এখানে ছিলেন তখন হঠাৎই যেন সে একটু বেশিরকমের কৌতুহলী হয়ে পড়ে নেতাদের কাছে বাংলা ছাড়া অন্য কোথাও বিপ্লবের কেন্দ্র আছে কিনা আর থাকলে সেখানকার নেতাদের নাম কী – এসব প্রশ্ন করতে লাগল। বোঝা গেল কোথাও একটা কিছু গোলমাল হয়েছে। হৃষিকেশ একদিন উপেনকে বললেন, “ গোটা দুই-তিন বেয়াড়া রকমের মাদ্রাজী বা বর্গী-টর্গীর নাম বানিয়ে দিতে পারিস?

- “কেন?”

আরও পড়ুন
মানিকতলার আড্ডা

- “নরেন বোধহয় পুলিশকে খবর দিচ্ছে। গোটা কতক উদ্ভট নাম বানিয়ে দিতে পারলে স্যাঙ্গাতরা দেশময় অশ্বডিম্ব খুঁজে বেড়াবে।”

খবর পাকা যে নরেন রাজসাক্ষী হচ্ছে। এইসময় কপাল খুলে গেল বোমা মামলার বিপ্লবীদের। তাঁদের ৪৪ ডিগ্রি থেকে নিয়ে এসে পাশাপাশি বড়ো তিনটি কুঠুরিতে রাখা হল। এরপর আরো কয়েকজন অজ্ঞাতকুলশীলকে আলিপুর মামলার আসামি করে ধরে নিয়ে এসে এঁদের সঙ্গে কুঠুরিতে ভরে দেওয়া হল। সে এক করুণ অবস্থা। নিজে শোবার জায়গা নেই শঙ্করাকে ডাকে। এরপর জেলের ডাক্তারের সুপারিশে প্রকৃত বিপ্লবীদের এনে একটি বড়ো হলঘরে ঠাঁই দেওয়া হল। এবার প্রকৃতপক্ষে নরক গুলজার। জেলের খাবার সম্পর্কে অভিযোগ করায় ইউরোপীয় ডাক্তারসাহেব বাইরে থেকে ফলমুল ও মিষ্টান্নের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আবার সুশীল সেনের বাবা প্রায়ই আম-কাঁঠাল পাঠাতেন। আম-কাঁঠাল এতোটাই বেশি পরিমাণে আসত যে খেয়ে শেষ করাই দুরূহ ছিল। তাছাড়া অনুশীলন সমিতির ছেলেরা মাঝে মাঝে ঘি, চাল, মশলা ও মাংস পাঠাত। হেমচন্দ্র ভালো রাঁধতে পারতেন। তিনি সেগুলি জেলের রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে চমৎকার পোলাও বানিয়ে আনতেন।

সন্ধ্যার পর গানের আড্ডা বসত। হেমচন্দ্র, উল্লাসকর, দেবব্রত – এঁরা ভালো গাইতেন। ছোটো ছেলেরা অনেকেই ভালো স্বদেশী গান গাইতেন। শচীন সেন ছিলেন তাঁদের নেতা। যখন তাঁর পনেরো বছর বয়স তখন তিনি বাবা-মা’র কথা অমান্য করে কলকাতা ন্যাশনাল কলেজে এসে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পরে কলেজ ছেড়ে মানিকতলা বাগানে এসে বিপ্লবীদের দলে ভিড়েছিলেন। এক-একদিন রাত বারোটা বেজে গেলেও গানের আসর বন্ধ হত না। অরবিন্দ, দেবব্রত আর বারীন মাঝেমাঝে এঁদের হট্টগোলে যোগ দিতেন। রবিবারে অনেকের আত্মীয়স্বজন জেলে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। সেই দিনটা ছিল সবার কাছে এক আনন্দের দিন। শচীনের বাবা একদিন জেলে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসে  জিজ্ঞাসা করলেন যে জেলে কীরকম খাবার দেয়। তার উত্তরে শচীন বললেন ‘লপসি’। সেটা কী জিনিস তার বর্ণনায় শচীন তাঁর বাবাকে বললেন যে লপসি হল এক পুষ্টিকর খাদ্যের নাম। শচীনের বাবার চোখ জলে ভরে গেল। তিনি জেলার সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন, “বাড়িতে ছেলে আমার পোলাও-য়ের বাটি টান মেরে ফেলে দিত আর আজ লপসি তার কাছে পুষ্টিকর জিনিস।”

আরও পড়ুন
পেনাল সেটেলমেন্টে সাধারণ কয়েদিদের রোজনামচা

জেলের ভেতরে এইভাবে নিজেদের মধ্যে হইহল্লা করে কাটছে আর ওদিকে চলছে বিচারের পালা। সে যেন এক প্রকাণ্ড তামাশা। কত যে রকম-বেরকমের সাক্ষী এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে পুলিশের শেখানো বুলি আওড়ে যেত তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু মামলার ফলাফল নিয়ে যেন কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁরা প্রতিদিন প্রিজন ভ্যানে চড়ে হৈহৈ করতে করতে আদালতে যেতেন আর ফিরতেন।  ফিরে এসে উল্লাসকর বিচারক নর্টন সাহেবকে নিয়ে পড়তেন – সাহেবের পেন্টালুন কোথায় ছেঁড়া, কোথায় তাপ্পি লাগানো; কোর্ট ইন্সপেক্টরের গোঁফ ইদুরে না কি আরশোলায় খেয়েছে এইসব নিয়ে গভীর গবেষণার ফল প্রকাশ করত। আর সেইসব নিয়ে চলত হাসি-মশকরা। মাঝেমাঝে কার কী রকম শাস্তি হতে পারে সেই নিয়েও চলত গবেষণা। ছেলেরা কাউকে বা ফাঁসিতে চড়ায়, কাউকে বা খালাস দেয়। কানাইলাল একদিন বলেই বসলেন, “খালাসের কথা ভুলে যাও। বিশ বছরের কালাপানি। তবে দেশ মুক্ত হোক আর নাই হোক আমি মুক্ত হব।” এরপর কানাইলাল পেটে হাত দিয়ে শুয়ে পড়লেন, ভারি যন্ত্রণা। ডাক্তারবাবু এলেন। তিনি কানাইকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। মেদিনীপুরের সত্যেন, যাঁকে আগেই পুলিশ ধরে এনেছিল সে কাশরোগাগ্রস্ত ছিল বলে প্রথম থেকেই তাঁর ঠাঁই হয়েছিল হাসপাতালে। এবার সত্যেন গিয়ে মিললেন তাঁর সঙ্গে।

ওইদিকে যে নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হচ্ছেন! তা তো হতে দেওয়া যাবে না। অনেকের অলক্ষ্যেই জেলকর্মীদের ঘুষ খাইয়ে রিভলবার চলে এল জেলের ভেতরে। ২৩-এ অগাস্ট চন্দননগরের সুধাংশুজীবন রায়ের হাত দিয়ে প্রথম রিভলবার এল বারীনের কাছে। এর পরের রবিবার ৩০-এ অগাস্ট চন্দননগরেরই শ্রীশচন্দ্র ঘোষের হাত দিয়ে আর একটি রিভলবার হস্তগত হল বারীনের। একটা রিভলবার পেলেন কানাইলাল দত্ত। অন্যটি যথাসময়ে পৌঁছে গেল জেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সত্যেন বসুর কাছে।

দিনকয়েক আগেই নরেনের কাছে সত্যেন খবর পাঠিয়েছেন যে তিনি রাজসাক্ষী হতে চান তার বদলে চান মুক্তি। পয়লা সেপ্টেম্বর নরেনের আরেক দফার স্বীকারোক্তির দিন ঠিক হয়েছিল। সত্যেন আর কানাই সিদ্ধান্ত নিলেন আর দেরি করা চলে না, এবার নরেনের দফারফা করতে হবে। ৩০ তারিখ রাতেই খবর গেল নরেনের কাছে কানাইও রাজসাক্ষী হতে চান। তার জন্য পরদিন সকালে তাঁদের দেখা করাটা জরুরি।

আরও পড়ুন
এক নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড

৩১ অগাস্ট, ১৯০৮। আলিপুর জেল হাসপাতালে সকাল সাতটার একটু আগে। নরেন তাঁর দেহরক্ষী হিগেনসকে নিয়ে হাসপাতালে এল। সত্যেন এবং কানাই বেরিয়ে এলেন তিনতলার ওয়ার্ড থেকে। করিডরে মিনিটখানেক তিনজন আলোচনা করছেন। কাছেই দাঁড়িয়ে হিগেনস। হঠাৎই কোমরে গোঁজা রিভলবার বের করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে নরেনকে লক্ষ করে গুলি চালিয়ে দিলেন সত্যেন-কানাই। রক্তাক্ত নরেন ছুটতে শুরু করল। মুখে আর্তনাদ, “বাঁচাও, বাঁচাও। আমাকে ওরা আমাকে মেরে ফেলল।” নরেনের পিছু পিছু সত্যেন-কানাইও ছুটছেন। হিগেনস ধাওয়া করল। কানাই এবার হিগেনসকে লক্ষ করে গুলি চালালেন। গুলি লাগল হিগেনসের কবজিতে। আহত অবস্থায় নরেন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে ছুটছে জেল গেটের দিকে। রিভলবার হাতে পেছনে ছুটছেন সত্যেন-কানাই।

ওদিকে সেইসময়ে জেলার কয়েকজন রক্ষীসহ লিন্টন নামে এক ইউরোপীয় আসামিকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে আসছিলেন। তাদের চোখে পড়ল এই দৃশ্য। কেউই সাহস পেলেন না অস্ত্রধারী কানাই-সত্যেনকে প্রতিহত করতে। লিন্টন ছিল দশাসই চেহারার। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সত্যেনের হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কানাই লিন্টনকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়লেন কিন্তু যথাসময়ে মাথা সরিয়ে নিয়ে প্রাণ বাঁচাল লিন্টন। এবার সে ঝাঁপাল কানাইয়ের ওপর। তাঁকেও অস্ত্রচ্যূত করল। এবার সাহস পেয়ে জেলকর্মীরা এগিয়ে এসে সত্যেন-কানাইকে ধরে ফেলল। ততক্ষণে দেখা গেল জেলের রাস্তা সংলগ্ন নর্দমায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কীট নরেনের দেহ। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করলেন।

সেদিন সকালবেলা আলিপুর বোমা মামলার বন্দিরা সবাই ঘুম থেকে উঠে প্রাতকৃত্য সারছেন। এমন সময় হাসপাতালের দিক থেকে গুলিগোলার শব্দ ভেসে এল। দলের সবাই তো আর জানেন না ওখানে আজ কী নাটক অভিনীত হতে চলেছে। কেউ বলল, বাইরে থেকে এসে কেউ হাসপাতালে বোমা মেরেছে, কেউ বলল সিপাইরা গুলি চালিয়েছে। কেউই বুঝতে পারছে না ওদিকে কী এমন কাণ্ড ঘটল। দেখা গেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডার ছুটতে ছুটতে এসে জেল অফিসের কাছে শুয়ে পড়লেন। ভয়ে তার মুখ বিবর্ণ। প্রায় দশ-পনেরো মিনিট পর এক চোরের মুখ থেকে খবর পাওয়া গেল – “নরেন গোঁসাই ঠান্ডা হয়ে গেছে।”

- “ঠান্ডা হয়ে গেছে কী রে?”

- “আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু, কানাইবাবু তাকে পিস্তল দিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছে।”

মিনিট পনেরো পরে জেলের পাগলা-ঘন্টি বেজে উঠল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল জেলের প্রহরীরা কানাই আর সত্যেনকে টানতে টানতে ৪৪ ডিগ্রি সেলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

১০ নভেম্বর, ১৯০৮-এ সকালবেলা কানাইলালের ফাঁসি হয়ে গেল। কানাইলালের মরদেহ নিয়ে রাজপথে শোভাযাত্রার অনুমতি দিল না প্রশাসন। টালিনালার পাশের গলিঘুঁজি দিয়ে কানাইলালের মৃতদেহ যখন কেওড়াতলায় এসে পৌঁছাল, তখন শহীদকে বরণ করতে সমস্ত কলকাতা যেন ভেঙে পড়েছে। রাস্তায়, আশেপাশের বাড়ির বারান্দায় কোথাও তিলধারণের জায়গা নেই। চারদিক থেকে অঝোরে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। মহিলারা দাঁড়িয়ে আছেন হাতে মালা-ঘি-চন্দন নিয়ে, বয়স্ক পুরুষদের হাতে গীতা। তরুণদের কণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি আকাশ-বাতাস চূর্ণ-বিচূর্ণ করছে। ক্রোধ-শোক-ক্ষোভ আবেগের প্রকাশ আর যেন কোনো বাধা মানছে না। রাস্তায় যানবাহন চলাচল স্তব্ধ হয়ে গেছে।

সত্যেনের ফাঁসি হল ২১-এ নভেম্বর। কানাইলালের শেষকৃত্য থেকে শিক্ষা নিয়ে ছাব্বিশ বছরের সত্যেনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হল জেলের ভেতরেই।

এরপর আরো কিছুদিন মামলা গড়াল। মামলার রায় বেরলো ডিসেম্বরে। অভিযুক্তদের প্রধান আইনজীবী হিসাবে সওয়াল-জবাবে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ব্যারীস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯০৯, ডিসেম্বরের প্রথমে কলকাতা হাইকোর্টে চিত্তরঞ্জন দাশের প্রচেষ্টায় বারীন আর উল্লাসকরের ফাঁসি রদ হল। তার বদলে এঁদের হল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি। বারীন আর উল্লাসকর ছাড়াও আর যাঁদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হল তাঁরা হলেন হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো), উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিভূতিভূষণ সরকার, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, বীরেন্দ্র সেন, সুধীরকুমার সরকার, ইন্দ্রনাথ নন্দী, অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু এবং ইন্দুভূষণ রায় – মোট বারোজনের। এঁরা ছাড়া পরেশচন্দ্র মৌলিক, শিশিরকুমার ঘোষ এবং নিরাপদ রায় – এই তিনজনকে দশ বছরের জন্য আন্দামানে পাঠানোর নির্দেশ হল। অশোকচন্দ্র নন্দী এবং বালকৃষ্ণ হরি কানের ৭ বছরের দ্বীপান্তর হল। কৃষ্ণজীবন সান্যালের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল এবং বাকিরা মুক্তি পেলেন। মৃত্যুর আগে নরেন গোঁসাইয়ের একদিনের স্বীকারোক্তি গ্রাহ্য হল না। কিন্তু এই মৃত্যু বাঁচিয়ে দিয়ে গেল অনেককে, বিশেষত অরবিন্দ ঘোষকে। অনেক চেষ্টা করেও ব্রিটিশদের মূল টার্গেট, চরমপন্থী নেতা, অরবিন্দ ঘোষকে ছুঁতে পারল না ব্রিটিশ সরকার। কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন অরবিন্দ।

Powered by Froala Editor