এক নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড

‘কালাপানি’ আন্দামান – ৫

আগের পর্বে

ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারের লোলুপতায় বার বার পড়েছেন আন্দামানের আদি জনঘোষ্ঠীরা। যুদ্ধে যেমন প্রাণ হারিয়েছেন জনগোষ্ঠীর বহু মানুষ। তেমনই ধর্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মহিলারা। ওঙ্গিদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল সিফিলিসের প্রকোপ। জারোয়াদের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে সখ্য থাকলেও জারোয়া বসতি অঞ্চলে নির্মাণের জন্য ধীরে ধীরে বিরোধ বাড়ে ব্রিটিশদের। একের পর এক সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে প্রাণ হারান বহু জারোয়া। হতাহতের সংখ্যা কম ছিল না ব্রিটিশ সৈন্য এবং বন্দিদের মধ্যেও। তবে দুধনাথ তিওয়ারি নামের এক বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক বন্দিকে আহত করেও প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন জারোয়ারা। জারোয়া সম্প্রদায়ের একজন উঠেছিলেন তিনি। তবে শেষ অবধি ব্রিটিশ-জারোয়া অ্যাবারডিনের যুদ্ধে প্রাচীন এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন দুধনাথ। তার জন্য দ্বীপান্তর থেকে তাঁকে মুক্তির বরাত দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। তারপর...


ভারতের বড়োলাট তখন জাতিতে আইরিশ রিচার্ড সাউথওয়েল বার্ক, মেয়োর ষষ্ঠ আর্ল যাঁকে সবাই চেনে লর্ড মেয়ো নামে।  ১৮৭২-এ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, জেনারেল স্টুয়ার্ট, ভারতের বড়োলাট লর্ড মেয়োকে আমন্ত্রণ জানালেন আন্দামান সফরে। ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২-এ সকালবেলা এইচ. এম. এস. ফ্রিগেট ‘গ্লাসগো’তে লর্ড মেয়ো এসে পৌঁছালেন আন্দামান। রাত কাটাবেন তিনি রস আইল্যান্ডে। তখন রস ছিল ব্রিটিশ আন্দামানের রাজধানী। বড়োলাটের নিরাপত্তার ব্যবস্থা বারবার ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভাইপার এবং রস দ্বীপে কয়েদিরা তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত থাকলেও তাদের ওপর কড়া নজরদারি। তাদের হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। কোথাও বা মাটির সঙ্গে লম্বা একটা লোহার রড পুঁতে তার এক-দেড় ফুট দূরত্বে লাগানো এক-একটা হাতকড়িতে আটক থেকে উবু হয়ে বসে কাজ করছেন কয়েদিরা।

সেইদিনই রস আইল্যান্ডে দ্বীপের আধিকারিকদের সঙ্গে বন্দি-নিবাস সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন লর্ড মেয়ো। তাঁর একান্ত ইচ্ছে কয়েদিদের সংশোধন করে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে আন্দামানে তাদের দিয়ে চাষ-আবাদ করিয়ে একটা ‘স্বাবলম্বন গ্রাম’ স্থাপন করা হোক। দুপুরে লাঞ্চের পর লর্ড মেয়ো নৌকো করে সমুদ্র পার হয়ে পোর্ট ব্লেয়ারে গেলেন। সেখানে মাউন্ট হ্যারিয়েটে কয়েদিদের জন্য একটা যক্ষ্ণা হাসপাতালের জমি দেখলেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আন্দামানে বঙ্গোপসাগরের ওপর পশ্চিমের সূ্র্য তখন অস্তাচলে। নীল সাগরের ঢেউয়ে কমলা রঙের খেলা। সেই দৃশ্যে লর্ড মেয়ো পাগলপারা। মুগ্ধ লর্ড মেয়ো পুরো সূর্যাস্তের রূপ উপভোগ না করে ওই জায়গা ছেড়ে নড়তে চাইলেন না।

-    “আহা, কি সুন্দর! এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি। আমার মনে হয় এমন সৌন্দর্যের সামনে জীবনে এই প্রথম এসে দাঁড়ালাম।”

লর্ড মেয়োর সমস্ত মন সূর্যাস্তের সৌন্দর্যে তখন আপ্লুত। কে আর তখন ভেবেছে যে সেটাই বড়োলাটের জীবনের শেষ সূর্যাস্ত!

১৮৬০-এর দশকে উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্টিয়ারের আফ্রিদি পাঠান শের আলি ছিলেন পাঞ্জাব পুলিশের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর একজন। তিনি আম্বালা রেজিমেন্টের একজন ঘোড়সওয়ার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করে সিপাই বিদ্রোহের সময়ে ব্রিটিশ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্সি আর্মিতে রোহিলখণ্ড এবং অযোধ্যায় কাজ করেন। পরে তিনি পেশোয়ারে মেজর হাফ জেমস-এর অধীনে ঘোড়সওয়ার বাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর পেশাদারিত্বের জন্য তিনি বেঙ্গল আর্মির একজন মেজর জেনারেল, রেনেল জর্জ টেলরের ঘোড়সওয়ার-আর্দালি হিসাবে নিযুক্ত হন। শের আলির কর্মদক্ষতায় খুশি হয়ে জেনারেল টেলর তাঁকে একটি ঘোড়া, একটি পিস্তল ও একটি সার্টিফিকেটও দেন। এমনকি টেলর সাহেবের বিশ্বস্ততা অর্জন করে শের আলি টেলরের সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করেন। এরপর পারিবারিক এক বিবাদে জড়িয়ে পেশোয়ারে প্রকাশ্য দিবালোকে এক আত্মীয়, হায়দারকে রাগের মাথায় খুন করে বসেন। ২রা এপ্রিল, ১৮৬৭-তে তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়। পরে আবেদন করলে জজসাহেব কর্নেল পোলোক তাঁকে আন্দামানে নির্বাসিত করেন।

আরও পড়ুন
জারোয়াদের কথা, দুধনাথ তিওয়ারি এবং অ্যাবারডিনের যুদ্ধ

শের আলির ধারণা যে তাঁর আন্দামানে দ্বীপান্তরের শাস্তি অমূলক এবং তিনি সুযোগ পেলেই কোনো বড়ো ব্রিটিশ আধিকারিককে খুন করে এর প্রতিশোধ নেবেন। আন্দামানে এসে তিনি ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর ঘৃণা আরো বৃদ্ধি পেল। ইতিমধ্যে আন্দামানে তাঁর সভ্য-ভদ্র আচরণে তাঁর মুক্তির সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছিল। তাঁকে বিশ্বাস করে দ্বীপের মধ্যে শিকল থেকে মুক্ত রাখা হয়েছিল এবং তাঁকে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেখানে নাপিতের কাজও করছিলেন। কিন্তু তার ফল যে এরকম হবে কে ভেবেছিল? তিনি নিজেও কি ভেবেছিলেন যে যেকোনো একজন ইংরেজকে মারলেই যে প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যেত সেখানে কিনা স্বয়ং বড়োলাট এসে পড়বেন তাঁর ফাঁদে! বড়োলাট আসবেন শুনে তাঁর অনেকবার মনে হয়েছিল যেভাবে হোক যদি রস আইল্যান্ডে পৌঁছানো যেত, কিন্তু তা তো হবার নয়। আর সেই বড়োলাট কিনা স্বয়ং এসে হাজির পোর্ট ব্লেয়ারে তাঁর মুঠোর মধ্যে, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে!

পোর্ট ব্লেয়ারে এসে লর্ড মেয়ো গেলেন মাউন্ট হ্যারিয়েটে। শের আলি একবার লুকিয়ে মাউন্ট হ্যারিয়েটে লর্ড মেয়ো’র কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। এবার উপায়? ঝট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। মেয়ো তো রস আইল্যান্ডে ফিরবেন। তাঁর জন্য জেটিতে অপেক্ষা করছে নৌকা।  শের আলি গিয়ে জেটিতে লুকোলেন।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন সাতটা। চারদিক অন্ধকার। নৌকাতে লেডি মেয়ো তাঁর স্বামীর জন্য ছটফট করছেন। অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে তিনি দেখলেন যে দূর থেকে অন্ধকারের মধ্যে বাতি জ্বেলে একদল সৈনিক বড়োলাটকে নিয়ে ফিরছেন। নিশ্চিন্ত হলেন লেডি মেয়ো। তিনি সোৎসাহে লর্ড মেয়োকে আভিবাদন জানাতে ব্যান্ডবাদকদের ‘রুল ব্রিটানিয়া’র সুর বাজাতে বললেন। লর্ড মেয়োর মন আনন্দে আজ ভরপুর। সূর্যাস্তের অসামান্য দৃশ্য তাঁর মন তখনও ছেয়ে রেখেছে। তিনি জেনারেল স্টুঁয়ার্টের কাছে খোঁজ নিচ্ছেন রস আইল্যান্ডে ফিরে গিয়ে সন্ধ্যায় কী ধরনের পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। তিনি নেমে এলেন জেটির সিঁড়ি বেয়ে, এবার রাজকীয় নৌকায় পা দিতে যাবেন…

আরও পড়ুন
পাইরেটস অফ আন্দামান – নিকোবর আইল্যান্ডের গল্প

এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার জন্য দীর্ঘদিন শের আলি অপেক্ষা করেছেন। বিদ্যুতের ঝলকের মতো লর্ড মেয়োর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন শের আলি। কেউ তাঁকে ধরে ফেলার আগেই উপর্যুপরি ছুরি দিয়ে লর্ড মেয়োর পিঠ ক্ষত-বিক্ষত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে শের আলির ওপর জনা বারো সৈনিক ঝাঁপিয়ে পড়ল, মেরেই ফেলত তারা শের আলিকে। একজন ইংরেজ অফিসার তাঁকে মারতে বারণ করলেন।

হাঁটু ডোবা জল থেকে কোনোমতে উঠলেন লর্ড মেয়ো। নিজেকে দেখানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি স্বাভাবিক আছেন। উঠে দাঁড়ালেন। মাথা থেকে হাত দিয়ে কোনমতে জল ঝাড়লেন। তাঁর ব্যক্তিগত সচিব তাঁর হাত ধরে তাঁকে জল থেকে ওঠাবার চেষ্টা করলেন। লর্ড মেয়ো কোনমতে তাঁর উদ্দেশ্যে ক্ষীণ স্বরে বললেন, “বায়ার্ন, আমাকে ওরা মেরেছে।” এরপর সবাইকে আশ্বস্ত করে বেশ জোরের সঙ্গেই বলে উঠলেন, “আমি ঠিক আছি। মনে হয় না খুব বেশি আহত হয়েছি আমি।”

মিনিট খানেকের মধ্যে জেটির পাশে একটা ঠেলাগাড়িতে শোয়ানো হল লর্ড মেয়োকে। তাঁর পিঠ থেকে তখন গলগল করে রক্ত ঝরছে। সবাই মিলে তাঁদের নিজ নিজ রুমাল তাঁর পিঠের ক্ষতস্থানে চেপে ধরে সেই রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি তাঁর মাথাটা একটু ওঠালেন। ঠেলাগাড়িতেই ধীরে ধীর উঠে বসলেন। তার পরমূহূর্তেই ধপ করে শুয়ে পড়লেন। কোনমতে উচ্চারণ করলেন, “আমার মাথাটা একটু তুলে ধরো।” তারপরেই সব শেষ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে রানি এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পর তৃতীয় ক্ষমতার অধিকারী ষষ্ঠ আর্ল অফ মেয়ো চিরবিদায় নিলেন।

আরও পড়ুন
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে দ্বিতীয় বন্দি-উপনিবেশ ও কয়েদিদের জীবন

কিছুক্ষণ পরে শের আলিকে ধরে নিয়ে আসা হল লর্ড মেয়োর মৃতদেহের সামনে। বিদেশ সচিব, ক্যাপ্টেন অ্যাটিচসন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন সে বড়োলাটকে হত্যা করল। কোনো দ্বিধা না রেখে শের আলি উত্তর দিলেন, “খুদা নে হুকুম দিয়া।” আবার প্রশ্ন ভেসে এল, আর কে ছিল তাঁর সঙ্গে। উত্তরে তিনি বললেন, “মেরা শরিক কই আদমি নেহি, মেরা শরিক খুদা হ্যায়।” পরদিন সকালে যখন তাঁকে স্বীকারোক্তি করতে বলা হল, তিনি বললেন, “হাঁ, ম্যায় নে কিয়া।” এরপর তিনি নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে ফটোগ্রাফির জন্য পোজ দিলেন।

ব্রিটিশরা অনেক চেষ্টা করে এই মেয়ো হত্যায় শের আলির সঙ্গে আরো কয়েকজন ওয়াহাবি নেতৃত্বকে জড়াতে। ওয়াহাবি নেতা, মৌলানা মহম্মদ জাফর আলি থানেসভরি, তিনি সেই সময়ে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত ছিলেন, মুক্ত হবার  পরে ঊর্দুতে একটি আত্মজীবনী লেখেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে বহু বছর যাবৎ শের আলি উচ্চ পদাধিকারী কোনো ইংরেজকে মারতে চেয়েছিল এবং সেইদিন সে সুযোগটা পেয়ে যায়। সে হয়তো সেদিন বড়োলাট ছাড়াও আরেকজনকে খুন করতে চেয়েছিল, তিনি হলেন ওখানকার সুপারিন্টেন্ডেন্ট, জেনারেল স্টুয়ার্ট। সেইদিন সারাদিন ধরে শের আলি সাগরপাড়ি দিয়ে রসদ্বীপে যাবার চেষ্টা করে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রসদ্বীপেই লর্ড মেয়োকে হত্যা করা। কিন্তু সেখানে যাবার অনুমতি সে কিছুতেই পায়নি। লর্ড মেয়ো যখন মাউন্ট হ্যারিয়েটে যান তখনও শের আলি তাঁকে ধাওয়া করে বিফল হয়। নিরাশ হয়ে মাউন্ট হ্যারিয়েট থেকে নামার পথে তার মাথায় আসে যে লর্ড মেয়োকে তো অ্যাবারডিন জেটি থেকে নৌকোয় চেপে রস দ্বীপে ফিরতে হবে, তখনই সে জেটিতে গিয়ে লুকোয়। এর আগে শের আলি নাপিতের কাজ করছিল। সেই নাপিতের ক্ষুরটিকেই সে বেছে রেখেছিল অস্ত্র হিসাবে। 

লর্ড মেয়োর মৃতদেহ পরে আয়ারল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৈতৃক বাড়ি কিলডেয়ার কাউন্টির জনসটাউনে পামারস টাউন হাউসের কাছে একটি মধ্যযুগের ভগ্নপ্রায় চার্চে তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়।

আরও পড়ুন
জাহাজডুবিই ব্রিটিশদের ফিরিয়ে আনল ‘পরিত্যক্ত’ আন্দামানে

পোর্ট ব্লেয়ারের চিফ কমিশনার বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শের আলির ফাঁসির হুকুমানামা সই করলেন।  কলকাতার উচ্চ আদালত সেই ফাঁসির হুকুমনামা কার্যকর করতে নির্দেশ দিলে ১১-ই মার্চ, ১৮৭২-এ ভাইপার দ্বীপে শের আলির ফাঁসি হয়ে গেল।

Powered by Froala Editor