এবারের অনশন ধর্মঘট সারা ভারতে সাধারণ মানুষের মধ্যে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করল। আন্দামান থেকে রাজবন্দিদের মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে আনার দাবিতে ভারতের নানা জায়গায় বড়ো বড়ো মিছিল ও সমাবেশ সংগঠিত হচ্ছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক অনশনভঙ্গ করার অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম করছেন। এই সংগ্রামে যোগ দিতে শুরু করলেন ভারতের বিভিন্ন জেলে আটক রাজবন্দিরা। আলিপুর, বহরমপুর, দেওলি এবং ভারতের অন্যান্য জেলগুলিতে ১০ই আগস্ট ১৫৩ জন অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন। তাঁরা ‘কালাপানি’তে আটক রাজবন্দিদের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দেশে ফেরানোর দাবি তুললেন। দু’দিনের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন জেলে অনশনকারীদের সংখ্যা ২০০-তে পৌঁছে গেল।
১২ই আগস্ট, ১৯৩৭-এ ভারত সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানালেন যে তাঁরা আন্দামান থেকে সমস্ত রাজবন্দিকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা তখনই ভাববেন যখন তাঁরা তাঁদের অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেবেন। এই খবরে আশান্বিত হয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতারা আন্দামানে সেলুলার জেলের অনশনকারীদের হরতাল প্রত্যাহার করার আবেদন জানালেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির পক্ষ থেকে জওহরলাল নেহেরু অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠালেন। সুভাষচন্দ্র ও শরৎচন্দ্র বসু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরকারের কাছে অনুরোধ জানালেন যে কেঊ ওখানে মারা যাবার আগেই যেন তাঁদের দাবি মেনে এই দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। অনশন প্রত্যাহারের আবেদন রাখলেন কমিউনিস্ট নেতা, মুজফফর আহমেদ, নীহারেন্দু দত্ত, বঙ্কিম মুখার্জী প্রমুখ। সংসদে মুলতুবি প্রস্তাব আনলেন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এস. সত্যমূর্তি। সংসদে ভুলাভাই দেশাই সরকারকে এই বলে হুঁশিয়ারি দিলেন যে অনশনকারীদের মধ্যে একজনেরও যদি মৃত্যু হয় তাহলে সরকার নিজের কবর নিজেরাই খুঁড়বে। মুসলিম লিগের নেতা, মহম্মদ আলি জিন্নাহ বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে দেখার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানালেন।
অনশন চলাকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে অনশন প্রত্যাহার করার আবেদন জানিয়ে টেলিগ্রাম এল। সেই টেলিগ্রামে আবেগপূর্ণ ভাষায় লেখা ছিল –
Your motherland will never forget her full-blown flowers.
বিপ্লবী নলিনী দাসের লেখাতেও পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের কথা,
‘বাংলাদেশ বাঙলার ফুলগুলোকে শুকিয়ে যেতে দিতে পারে না। অনুরোধ তোমরা অনশন ভঙ্গ কর।’
গণেশ ঘোষ এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ নিবন্ধে লিখছেন,
আরও পড়ুন
সেলুলার জেলে প্রথম দুর্গাপুজো
‘স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হয়ে ওঠেন এবং ধর্মঘট স্থগিত রাখবার অনুরোধ জানিয়ে আন্দামানে নির্বাসিত রাজবন্দীদের কাছে একখানি তারবার্তায় তাঁদের সুনিশ্চিত আশ্বাস দেন যে তোমাদের দেশমাতা তাঁর পূর্ণ প্রস্ফুটিত কুসুমরাজিকে কখনই বিস্মৃত হবেন না।’
আরও পড়ুন
সেলুলার জেলে শেষের সুদিন
রবীন্দ্রনাথের বার্তা সংগ্রামী বিপ্লবীদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল কিন্তু তাঁরা তাঁদের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে রাজি হলেন না। এই টেলিগ্রামের একটি উত্তর লেখা হল কিন্তু এটা তাঁরা জানলেন না যে সেই পত্রটি রবীন্দ্রনাথের কাছে আদৌ পৌঁছেছিল কিনা। হরতাল চলতে থাকল।
আরও পড়ুন
আবারও দুর্দশা, আবারও হরতাল
হরতালে অংশ নেওয়া রাজবন্দিরা বুঝতে পারছেন যে তাঁদের জন্য কতটা ব্যথিত দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, কবি, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাঁরা তো শুধু নিজেদের মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার দাবিতে এই ভুখা হরতাল শুরু করেননি, তাঁদের লক্ষ্য যে আরো বড়ো, সারা ভারতের সমস্ত রাজবন্দিদের জন্য মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা আদায় করার জন্য তাঁদের এই লড়াই। তাই যতক্ষণ না তাঁদের সব দাবি পূরণ হচ্ছে, তাঁরা তো আর পিছিয়ে যেতে পারেন না। সবারই টেলিগ্রাম আসছে তাঁদের মূল ভূখণ্ডের জেলগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে। ভুখা হরতালে অংশগ্রহণকারীরা আলোচনা করছেন কীভাবে তাঁরা দেশের মানুষকে বোঝাবেন যে তাঁদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র নিজেদের জন্য নয়, সমগ্র রাজবন্দিদের স্বার্থে। সেই সময়েই ২৮ আগস্ট, ১৯৩৭-এ তাঁদের হাতে এসে পৌঁছাল গান্ধীজির একটি টেলিগ্রাম। তাতে মহাত্মা গান্ধী লিখছেন,
আরও পড়ুন
আবারও সেলুলার জেল
‘I venture to add my advice to Gurudev Tagore’s and working committees to abandon strike relying upon us all trying best to secure relief for you. It would be graceful on your part to yield to the nationwide request. You will help me personally if I could get assurance that those who have believed in terrorist methods no longer believed in them and that they have come to believe in non-violence as the best method. I ask this because some leaders say detenus have abjured terrorism but opinions to contrary have also been expressed.’
গান্ধীজির টেলিগ্রাম পেয়ে আবার আলোচনায় বসলেন অনশনরত রাজবন্দিরা। অবশেষে তাঁরা যা চাইছিলেন, গান্ধীজি হস্তক্ষেপ করুন, সেটা হল বটে কিন্তু তাঁদের দাবি পূরণের কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল না। অনেকেরই অভিমত, তবু তো গান্ধীজি যে জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই চাইছেন রাজবন্দিরা যাতে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু সত্যিই কি শুধুমাত্র এইটুকু চাওয়ার ওপর ভিত্তি করে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হবে? এই প্রশ্নে আলোচনা চলল প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। তর্ক-বিতর্ক অনেক হল। দেশের মানুষ তো চায় না যে রাজবন্দিরা ভুখা থেকে তাঁদের প্রাণ বিসর্জন দিক। তাঁরা সবাই চায় রাজবন্দিরা তাঁদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিক। আর কিছু করার নেই অনেকের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলেও অবশেষে ঠিক হল যে জাতির আবেদনের প্রতি মর্যাদা দিয়ে অনশন ধর্মঘট তাঁরা প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন।
সেদিনই অর্থাৎ ২৮ আগস্ট, ১৯৩৭-এ গান্ধীজির প্রতি একটি চিঠি তৈরি করা হল যাতে সই করলেন ২২৫জন ধর্মঘটকারী এবং তা রাত ১১টার সময় জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট এবং সিনিয়র মেডিকেল অফিসারের হাতে তুলে দেওয়া হল। সেই চিঠিতে লেখা ছিল –
‘Touched by nation-wide appeal and your message, we suspend the hunger strike on the assurance that the whole country has taken up our demands and the cause. We are confidently hoping that within a reasonable period of time, you all will succeed in all the demands fulfilled. We are glad that you have given an opportunity to express our firm opinion on terrorism. We feel honoured to inform you and through you the nation that those of us who ever believed in terrorism, do not do it anymore, and are convinced of its futility as apolitical weapon or creed. We declare that it definitely retards rather than advances the cause of our country.’
এখানে রাজবন্দিরা প্রাঞ্জল ভাবে গান্ধীজিকে বলে দিলেন যে তাঁরা এখন আর সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নন, কিন্তু তাঁরা এটা স্বীকার করলেন না (যা গান্ধীজি চেয়েছিলেন) যে গান্ধীজির অহিংসার পথই হল শ্রেষ্ঠ পথ। এই চিঠি পেয়ে গান্ধীজি যখন স্বরাষ্ট্র সচিব স্যার হেনরি ক্রেকের সঙ্গে আন্দামান থেকে রাজবন্দিদের মুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে গেলেন তখন হাসতে হাসতে তিনি গান্ধীজিকে এই কথাটাই বলেছিলেন যে ওরা গান্ধীজির সঙ্গে চালাকি করেছে। ক্রেক বলেছিলেন, ওরা বলল যে সন্ত্রাসবাদের পথ যে ভুল তা বুঝছে কিন্তু এখানে কোথাও তো লেখা নেই যে ওরা হিংসার পথ থেকে সরে এসেছে। অবশ্যই গান্ধীজি এ কথাটা বুঝেছিলেন। আন্দামান থেকে বন্দিদের আলিপুর জেলে স্থানান্তরিত হবার পর গান্ধীজি যখন রাজবন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখনও হিংসা এবং অ-হিংসা নিয়ে বিপ্লবী বন্দিরা তাঁদের অভিমত পরিষ্কার করে দেন। তিনি স্পষ্টতই বুঝে নিলেন যে বিপ্লববাদী রাজবন্দিরা কী বলতে চাইছেন এবং কোনো ইতস্তত না করে তাঁদের মতবাদকে সম্মান জানিয়ে চলে গেলেন।
৩৬ দিন পর অনশন শেষ হল। সঙ্গে সঙ্গে জেল কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক অনশনকারীদের চিকিৎসা ও যত্নের ব্যবস্থা নিলেন। আন্দামানে ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হবার খবর মূল ভূখণ্ডে পৌঁছানোর পরে অন্যান্য জেলগুলিতেও ৩০ আগস্ট, ১৯৩৭-এ যাঁরা অনশনে বসেছিলেন তাঁরা তা প্রত্যাহার করে নিলেন।
এর ঠিক পরেপরেই ভারত সরকার আন্দামান থেকে রাজবন্দিদের দেশের জেলগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা শুরু করলেন। ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭-এ সরকার আদেশ জারি করে বললেন যে তারা প্রথম দফায় ৩৬ জন রাজবন্দিকে মাদ্রাজ, পাঞ্জাব, আসাম, দিল্লি এবং বিহারের জেলে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন, তবে তাঁরা যেন শারীরিক ভাবে সুস্থ হন এবং অনশন-ধর্মঘটে না থাকেন। ২২ সেপ্টেম্বর বাংলার ২৬ জন কয়েদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার নির্দেশ এল। সেপ্টেম্বরের শেষে আন্দামান থেকে ৭২ জন ফিরে গেলেন ভারতের বিভিন্ন জেলে। অবশেষে ১৮ জানুয়ারি, ১৯৩৮ আন্দামান থেকে রাজবন্দিদের নিয়ে শেষ জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাত্রা করল ভারতের মূল ভূখণ্ডের দিকে।
১৯০৯ থেকে যে ফটক খোলা হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে আত্মবলিদানরত বিপ্লবীদের গিলে খাবার জন্য সেই সেলুলার জেলের দরজা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। সেই সঙ্গে শেষ হল ২৮ বছরের নিষ্ঠুর ইতিহাসের সাক্ষী থাকা ‘কালাপানি’ পর্ব।
Powered by Froala Editor