ক্রান্তিকাল

‘কালাপানি’ আন্দামান - ৪২
আগের পর্বে

মাদ্রাজ থেকে কয়েকদিন আগেই আন্দামানের সেলুলার জেলে বদলি হয়ে এসেছিলেন ভগৎ সিং-এর সহযোদ্ধা মহাবীর সিং। অনশনের কারণে শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে চিকিৎসক জোর করে তাঁকে দুধ খাওয়ানোর নিদান দেন। সেই কথা মতোই নাকে নল দিয়ে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা চলে মহাবীরকে। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে যায় বিপত্তি। ভুলবশত, খাদ্যনালীতে না গিয়ে শ্বাসনালীতে সেই নল প্রবেশ করান চিকিৎসক। যার পরিণতি হয় মৃত্যু। সেদিন সেলুলার জেলের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল রাজবন্দিদের 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' কণ্ঠস্বর। তবে দায় এড়াতে আসল ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দেয় জেল কর্তৃপক্ষ। তারপর...

পরপর তিনটি অস্বাভাবিক মৃত্যু যে শুধুমাত্র তাঁদের সহবন্দিদের নাড়িয়ে দিয়ে গেল তাই নয়, এবার তা জেল কর্তৃপক্ষকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করল। একটা মাস চলে গেল তিন কমরেডের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর, অথচ তাঁদের দাবি মানার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের আচরণে কিছুটা বদল ঘটেছে। তারা বুঝতে পারছেন যে জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে, এবার একটা সমঝোতায় আসা দরকার। এই খবরও এল যে ভারত সরকার এই তিনটি মৃত্যু সম্পর্কে আন্দামানের চিফ কমিশনারের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে।

তিন বিপ্লবীর শহীদ হবার খবর ভারতের মূল ভূখণ্ডে এসে পৌঁছালে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন তোলে। সরকারের জবাবদিহি আর মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। সংবাদপত্রগুলিতেও এই নিয়ে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়ে ব্রিটিশ প্রশাসন। সংসদেও প্রশ্ন উঠে যায়। ‘আন্দামান  প্রিজনার্স রিলিফ লিগ’ গঠিত হয়। তিনজন অনশনকারীর মৃত্যুতে ৩০-এ মে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক নাগরিক সম্মেলন আয়োজিত হয় তৎকালীন কলকাতা পুরসভার মেয়র, সন্তোষ কুমার বসু’র সভাপতিত্বে। সেই সভা থেকে সেলুলার জেলের ৩৯-জন অনশনকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং মহাবীর সিং, মানকৃষ্ণ নমোদাস এবং মোহিত মোহন মৈত্রর মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি উত্থাপন করা হয়। সেইসঙ্গে পুনরায় আন্দামান জেল খোলার বিরূপ সমালোচনা করা হয়। ১৩ জুন, ১৯৩৩-এ সংসদ সদস্যরা স্বরাষ্ট্র সচিবকে সেলুলার জেলের পরিস্থিতি তদন্ত করে দেখার দাবিতে ডেপুটেশন দেয়। ভারত জোড়া ধিক্কার ও বিক্ষোভের ফলে সরকার আপোস মীমাংসার জন্য এগিয়ে এল এবং বাধ্য হল অনশনকারীদের প্রায় সমস্ত দাবি মেনে নিতে।  

সরকারের পক্ষে সেলুলার জেলের ওই আন্দোলন এবং তিনজন বিপ্লবীর মৃত্যু যথেষ্ট বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। ইতিমধ্যে ৫-ই জুন সেলুলারে অনশনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫-এ এসে দাঁড়ায়। এঁদের মধ্যে একজনেরই শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর পাওয়া যায়। তবে অনেক অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছায় নাকের নলের মাধ্যমে দুধ প্রেরণের ঝক্কি মেনে নিচ্ছিলেন, প্রতিরোধের জোর কমে গিয়েছিল। কিন্তু অন্যদিকে প্রতিদিন অনশনে যোগ দেওয়া ধর্মঘটিদের সংখ্যা বাড়ছিল। এই প্রেক্ষিতে চিফ কমিশনার একজন অতিরিক্ত চিকিৎসক পাঠানোর আবেদন জানালেন। শেষ পর্যন্ত সরকার ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিস’এর কর্নেল বার্কার, যিনি ওই সময়ে পাঞ্জাবের ইন্সপেক্টর-জেনারেল অফ প্রিজনস ছিলেন তাঁকে তদন্ত করে দেখার জন্য আন্দামানে পাঠায়।

১৭ জুন, ১৯৩৩-এ বার্কার পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছালেন। তিনি আন্দামানে এসে নিরপেক্ষ তদন্ত করা তো দূরের কথা উল্টে সেলুলার জেলে অনশনরত বন্দিদের ওপর কড়া পদক্ষেপ করলেন। এরপর ক’দিন ওই বন্দি উপনিবেশে কাটিয়ে সিমলায় ফিরে গিয়ে সরকারের কাছে তাঁর রিপোর্ট দাখিল করলেন। ইতিমধ্যে আরও পাঁচজন অনশনরত বিপ্লবী বন্দির শারীরিক অবস্থার অবনতি হল। অনশনরত বন্দিদের শারীরিক অবস্থা জানিয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে প্রতিদিন টেলিগ্রাম পাঠাতে হত সরকারের কাছে সিমলাতে। এরপর একদিন হঠাৎ এক বরিষ্ঠ মেডিকেল অফিসার এবং আরও কয়েকজন উচ্চ-পদাধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে ডেপুটি কমিশনার এসে হাজির হলেন সেলুলার জেলে। হরতালে অংশ নেওয়া বন্দিদের নিয়ে আসা হল সেন্ট্রাল টাওয়ারে। অনেককেই নিয়ে আসা হল স্ট্রেচারে করে। যাঁদের একদম শারীরিক ভাবে কোনো ধরনের ধকল সহ্য করার ক্ষমতা নেই শুধুমাত্র তাঁদের বাদ দেওয়া হল। কর্তৃপক্ষ তাঁদের কথা দিলেন যে তাঁদের সমস্ত অভিযোগ শোনা হবে এবং তাঁরা তাঁদের দাবিমতো সমস্ত ধরনের খেলাধুলা, পড়াশুনা ও সাংস্কৃতিক সুযোগ সুবিধা পাবেন। তবে এসবই দেওয়া হবে তখনই যখন তাঁরা তাঁদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেবেন। এবার হরতালে অংশগ্রহণকারী বন্দিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিলেন। ৫৫ দিন ধরে ধর্মঘট চলার পরে অবশেষে জয়ী হলেন রাজবন্দিরা। অবশ্য রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর বই Penal Settlements in Andamans-এ বলছেন যে এই ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হয় ৪৬ দিন পরে ২৬ জুন, ১৯৩৩-এ।

আরও পড়ুন
ভুখা হরতাল – মহাবীর সিং, মোহন কিশোর নমোদাস ও মোহিত মোহন মৈত্র

সেলুলার জেলের সেন্ট্রাল টাওয়ারের দেয়ালে রাজবন্দিদের নামের তালিকা

 

আরও পড়ুন
হরতালই হাতিয়ার

এরপর জেল কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু দাবি মেনে নিলেন। ‘সি’ ক্লাস বন্দিদের জন্য বরাদ্দ হল তক্তপোশ, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার সহ বালিশ, মশারি এবং তোয়ালে। খাবারের পরিমাণ এবং মানেও পরিবর্তন এল। ভাতের চাল এখন উন্নত মানের। সবজি এখন নানারকমের, ডালের বাটিতে ডালের সঠিক উপস্থিতি এবং একদিন ছাড়া ছাড়া পাতে মাছ এল। খাওয়া-দাওয়া ও রান্নাঘরের দায়িত্ব পেলেন বন্দিরাই। ইনডোর এবং আউটডোর গেমস’এর ব্যবস্থা হল। শরীর চর্চার জন্য হরাইজন্টাল ও প্যারালাল বার লাগানো হল। সমস্ত ধরনের শাস্তিপ্রদান বন্ধ করে দেওয়া হল। নিজেদের মধ্যে  কথাবার্তা বলা ও মেলামেশার ওপর আর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকল না। তাঁদের সহজতর কাজে এখন নিযুক্ত করা হল  এবং কাজের কোনো কোটা বেঁধে দেওয়া হল না। এতদিন পরে ধর্মঘটের সাফল্য বন্দিদের কাছে খোলা হাওয়া এনে দিল। দেশ, পরিবার থেকে দূরে বিচ্ছিন্নতার জ্বালা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেলেন রাজবন্দিরা। সেলুলার জেলে ‘সন্ত্রাসবাদী’ রাজনৈতিক বন্দিদের নির্যাতন করে তাঁদের শিরদাঁড়া নমনীয় করে দেবার যে প্রচেষ্টা প্রথম দিন থেকে শুরু হয়েছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হল।

আরও পড়ুন
যন্ত্রণাবিদ্ধ রাজবন্দিরা

রাজবন্দিদের পড়াশুনার জন্য নানাবিধ সুযোগ ও ব্যবস্থা তৈরি করা হল। সরকারি তালিকাভুক্ত দেশি এবং বিদেশি পত্র-পত্রিকার গ্রাহক হবার সুবিধা দেওয়া হল বন্দিদের। তাঁরা এখন দেশ থেকে আত্মীয় ও বন্ধুদের সাহায্যে তাঁদের পছন্দমতো বই আনিয়ে নিতে পারেন অথবা এখানে নিজেদের রোজগারের টাকা দিয়ে বইও কিনতে পারেন। গ্রন্থাগারে মারকনি, আইন্সটাইন, ডারউইনের পাশাপাশি জয়গা পেলেন জেমস জীন, হাক্সলে, কার্ল মার্কস।  গ্রন্থাগারে পড়াশুনার জন্য যথাযোগ্য আসবাবপত্রের ব্যবস্থা হল এবং সেলে পড়াশুনার জন্য রাত দশটা পর্যন্ত আলোর বন্দোবস্ত হল। কিছু সময় পরে রীতিমতো ’স্কুল অফ জার্নালিজম’ গড়ে উঠল। শুরু হল দেয়াল পত্রিকার প্রকাশ। নাম দেওয়া হল ‘CALL’. এই পত্রিকাটি পাক্ষিক ভাবে নিয়মিত বেরোতে শুরু করল। প্রথমে শুধুমাত্র বাংলায় এবং পরে হিন্দি ও বাংলায় তা প্রকাশিত হতে থাকল। এক সময় জেল কমপ্লেক্সের ভেতরে দুর্গাপুজোর অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন
আবারও সেলুলার জেল

১৯৩৪-এ একজন রাজবন্দিকে নতুন যাঁরা সেলুলার জেলে এলেন তাঁদের মধ্যে থাকা এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে দিলেন না জেলের কর্মচারীরা। তাঁকে এর জন্য গালাগালি এবং মারধোর করা হল। সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাঁকে ভারী শিকলে এবং সলিটারি সেলে আবদ্ধ করার  নির্দেশ দিলেন। এই স্পর্ধার প্রতিক্রিয়া জানালেন অন্যান্য রাজবন্দিরা। তাঁরা জেলে তাঁদের জন্য বরাদ্দ কাজ করতে অস্বীকার করলেন এবং জেলের নিয়ম-কানুন অমান্য করতে শুরু করলেন। এটা একটা খোলা প্রতিবাদ। জেল কর্তৃপক্ষ এই প্রতিবাদের ফলস্বরূপ সমস্ত রাজবন্দিদের ওপর শাস্তির খাঁড়া নামিয়ে আনলেন। যে সমস্ত রাজবন্দিরা ডিভিশন – ২-এর মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিলেন তাঁদের অবনমন ঘটিয়ে দিভিশন – ৩-এ নামিয়ে এনে অন্য ব্লকে বদলি করে দেওয়া হল। তাঁদের বেশিরভাগ সুযোগসুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হল। রাজবন্দিরাও তার প্রতিবাদে প্রতি সোমবার জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের সামনে যে জেল-প্যারেড হত সেখানে যোগ দিতে অস্বীকার করলেন। তাঁদের লাঠিপেটা করার ভয় দেখানো হল, কিন্তু কেউই ভয় পেলেন না। একবার বড়ো একটা আন্দোলন করে যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের এখন আর কোন অস্ত্রে ভয় দেখানো যায়? কিছুদিনের মধ্যেই জেল কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারলেন যে এভাবে  কাউকে বশে আনা যাবে না, তখন তারাই বাধ্য হয়ে সমস্ত বাধানিষেধ প্রত্যাহার করে নিলেন। আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেন রাজবন্দিরা।

Powered by Froala Editor