‘কালাপানি’ আন্দামান— ৪০
আগের পর্বে
জেলের পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং সুযোগ-সুবিধার জন্য ১৯৩৩ সালে অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন। পেশ করা হয় ১৫ দফা দাবি। প্রাথমিকভাবে জেল কর্তৃপক্ষ সেই দাবি মানার আশ্বাস দিল ৬ দিনের মাথায় ভাঙে ধর্মঘট। তবে আন্দোলনকারীদের জন্য বরাদ্দ হয় কঠোর সাজা। কিন্তু চার মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সেই দাবি মানা না হলে, আবার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সেলুলার জেলে। ততদিনে জেলে যোগ দিয়েছেন বটুকেশ্বর দত্ত এবং ভূপাল ঘোষ। ফের শুরু হল ধর্মঘট। অনেকে অনশনকারীদের সমর্থনে কাজ করাও বন্ধ করে দিলেন জেলে। সায়েস্তা করতে ভারি শেকল পরিয়ে রাখা হল বিপ্লবীদের। সেল থেকে জামাকাপড় ও কম্বল ছাড়া সরিয়ে নেওয়া হল সমস্ত কিছু। তারপর...
ভুখা হরতাল শুরু হলে তার পরিণাম ভেবে জেলের চিকিৎসকরা ঘাবড়ে গেলেও বরিষ্ঠ ইউরোপীয় চিকিৎসক এই ব্যাপারটিকে পাত্তা দিতে চাইলেন না। তিনি বলতে থাকলেন এই সমস্ত রাজদ্রোহীদের তিনি ভীষণরকম শিক্ষা দেবেন। ইতিমধ্যে লাহোর জেলে ৬৩ দিন অনশন ধর্মঘটে যতীন দাস দেহরক্ষা করলে ইন্সপেক্টর-জেনারেল অফ প্রিজন্স বিভিন্ন জেলে অনশনকারীদের জোর করে খাওয়ানো সম্পর্কিত এক নির্দেশিকা জারি করেন। অনশনরত বন্দিদের জোর করে খাওয়ানো সম্পর্কে স্পষ্ট ভাবে বাংলার জেল কোডে তা লিখিত হয় ১৯১০ সালে। ২৩ অক্টোবর, ১৯২২-এ ভারত সরকারের এই বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশিকা ছিল। খুব সম্ভবত আন্দামানে জেল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকরা সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
অনশনকারীদের মধ্যে ছিলেন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লবী ও ভগৎ সিংহের সহযোদ্ধা, মহাবীর সিং রাঠোর। মাদ্রাজ জেল থেকে সেলুলারে এসেছিলেন জানুয়ারি, ১৯৩৩-এ। সেদিন, ১৭-ই মে, ১৯৩৩। তার আগেরদিন পর্যন্ত মহাবীরের শারিরিক অবস্থা দুর্বলতা বোধ করা ছাড়া ভালোই ছিল। সেদিন বরিষ্ঠ চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে জোর করে খাওয়ানোর নিদান দেন। সেই মতো সকাল ১১-টার সময় মহাবীরের সেলে ঢুকে তাঁকে চেপে ধরে নাকের মধ্যে দিয়ে রবারের নল ঢুকিয়ে ডাক্তাররা জোর করে চিনি মেশানো ২৪ আউন্স দুধ খাওয়াতে গেলেন। মহাবীর সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন। জোর করে কেশে নলটাকে নাক থেকে বের করে দিতে চাইলেন। নলটি কন্ঠনালী থেকে শ্বাসনালীতে চলে গেল। সেই অবস্থায় নলে করে দুধ পাঠানো হলে তা খাদ্যনালিতে প্রবেশের পরিবর্তে ফুসফুসে চলে গেল। মহাবীরের ফুসফুস ভর্তি হয়ে গেল দুধে। তাঁর নাড়ির চলন দ্রুত হল, নিঃশ্বাস নেবার ক্ষমতা কমে এল, কপালে ঘাম দেখা দিল, বেলা ১-টা নাগাদ তাঁর শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। বিকেল ৪-টা নাগাদ তিনি কোনোমতে এইটুকু বলতে পারলেন যে তাঁর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এবং তাঁর বুক ভীষণ ভারী লাগছে। এরপরেই মারাত্মক যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালেন মহাবীর। ডাক্তাররা প্রথমে অবস্থার গুরুত্ব বুঝলেন না, আর যখন বুঝলেন তখন যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে মহাবীরকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। আশেপাশের সেলে যে সমস্ত সহবন্দিরা ছিলেন তাঁরা বুঝলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তাঁরা নিজেদের সেল থেকেই চিৎকার করে ডাক্তারদের কাছে মহাবীর সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ সেখান থেকে সরে পড়লেন। শুধু ওই সলিটারি সেলের ওয়ার্ডার জানাল, ”বাবু, আপ লোগকা ভাই বিমার হো গায়া হ্যায়।” সেটাই বোঝার পক্ষে যথেষ্ট। সবাই বুঝতে পারলেন যে মহাবীরের চিরতরে চলে যাওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮-ই মে রাত ১২.২৪-এ চলে গেলেন মহাবীর। জেল থেকে অবশ্য যে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাঠানো হল তাতে জেল কর্তৃপক্ষ নিজেদের ও চিকিৎসকদের দায় ঝেড়ে ফেলে লিখলেন যে মহাবীর শক পেয়ে মারা গেছেন।
প্রতিদিন সকাল আটটায় সেন্ট্রাল টাওয়ারে সময়ের ঘণ্টা পড়ে। যেই দিন মহাবীর চলে গেলেন সেই রাতে চোখের পাতা এক করতে পারলেন না কেউ। তাও প্রতিদিনের মতো সেইদিন সকালে যখন জেলে আটটার ঘণ্টা বেজে উঠল, তার অনেক আগে থেকেই মহাবীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যে যার সেলে উঠে দাঁড়িয়েছেন, এমনকি অনশনরতদের মধ্যে সবথেকে দুর্বল যিনি তিনিও সেলের গরাদ ধরে উঠে দাঁড়ালেন। চারদিক অদ্ভুত শান্ত। পাতা পড়লেও যেন শব্দ শোনা যায়। ঢং ঢং করে আটটার ঘণ্টা বাজছে আর সারা দিগন্ত কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। সেই আওয়াজের প্রতিধ্বনি মেলাতে না মেলাতেই আবার আকাশ বাতাস মুখরিত হল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শব্দে। দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল সেই ধ্বনি। সামনে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গ, ওই দূরে দেখা যায় আন্দামান দ্বীপের রাজভবন – চিফ কমিশনারের বাংলো। তৃতীয়বারের জন্যও ধ্বনিত হল সেই সুগভীর নিনাদ – ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। তারপর চারদিকে এক অদ্ভুত নীরবতা। সবার চোখে জল। তাঁরা জানেন বীর মহাবীরের মৃতদেহ অশ্রদ্ধার সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে ওই গভীর সমুদ্রে হাঙরদের খাবার জন্য তবু তাঁরা তো তাঁদের প্রিয় কমরেডকে একসঙ্গে এইভাবে শ্রদ্ধা জানাতে পারলেন!
এটা কারোর পক্ষে তখন জানা সম্ভব হয়নি যে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর কীভাবে মহাবীরের চিকিৎসা হয়েছিল, কখন চলে গেলেন মহাবীর। যখন হরতাল শেষ হল তখন এটুকুই জানা গিয়েছিল যে সেদিন শেষ রাতের অন্ধকারে মহাবীরের মৃতদেহ ভারী পাথর বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। চলে গেলেন একজন শহীদ, না দেওয়া হল তাঁকে একটা ফুলের মালা, না করা হল যথাযথ ভাবে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।
আরও পড়ুন
হরতালই হাতিয়ার
মহাবীর সিংয়ের মৃত্যুর খবর ভারত সরকারের কাছে এসে পৌঁছাল ১৮-ই মে, ১৯৩৩। তারা কোনো প্রেস বিবৃতি জারি করল না। কিন্তু খবরটি জানাজানি হয়ে গেল। এদিকে সেলুলারে প্রতিদিন অনশনকারীদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে অচিরেই ৫০ ছুঁয়ে ফেলল। যত দিন আন্দোলন প্রলম্বিত হতে থাকল তত জেল কর্তৃপক্ষের ঘুম কেড়ে নেবার মতো অবস্থা দাঁড়াল। এরপর তারা যেটা শুরু করলেন তা হল অনশনকারীদের বলপ্রয়োগ করে খাওয়ানো।
আরও পড়ুন
যন্ত্রণাবিদ্ধ রাজবন্দিরা
আরও পড়ুন
আবারও সেলুলার জেল
বিধুভূষণ সেন ছিলেন অন্যতম অনশনকারী। তাঁকেও নাকে নল ঢুকিয়ে জোর করে দুধ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলে তিনিও সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাতে দুধ খাদ্যনালীর বদলে চলে গেল ফুসফুসে। তাঁর নাক দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করলে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।
আরও পড়ুন
মাস্টারদার গ্রেপ্তারি এবং ফাঁসির প্রহসন
পাবনার নতুন ভারেঙ্গা গ্রামের মোহিত মোহন মৈত্র ছিলেন যুগান্তর গোষ্ঠীর রঙপুর গ্রুপের সদস্য। ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২-এ কলকাতা থেকে অস্ত্র মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ময়মনসিংহের বাজিতপুর গ্রামের মোহন কিশোর নমোদাস ছিলেন কলকাতার অনুশীলন সমিতির সদস্য। তাঁকে নেত্রকোণা সোয়ারিকাণ্ড রাজনৈতিক মামলায় আন্দামানে ৭ বছরের দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। এঁরা দুজনেই ১৯৩৩-এর অনশন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মহাবীরের মতোই ঘটনা ঘটল এই দুজনের ক্ষেত্রে। বাংলার মোহন কিশোর নমোদাস এবং মোহিত মোহন মৈত্র – এই দুই যুবক ছিলেন অত্যন্ত আমুদে প্রকৃতির, হৈচৈ করে আসর জমিয়ে রাখতেন তাঁরা। মোহিত এবং মোহনকে জোর করে ধরে তাঁদের নাকে রবারের নল গুঁজে দেওয়া হল। দুজনেই তা প্রতিহত করার চেষ্টা করলেন এবং তার ফলে সেই নল দিয়ে যে দুধ পাঠানো হচ্ছিল তাঁদের খাদ্যনালীর উদ্দেশ্যে তা শ্বাসনালীতে ঢুকে গিয়ে ফুসফুসে চলে গেল। মৃত্যুকে তাঁরা আহ্বান করে নিয়ে এলেন মহাবীরের মতো। মহাবীর সিং চলে গিয়েছিলেন ১৮-ই মে, ১৯৩৩-এ। একই পথের পথিক হয়ে মোহন কিশোর নমোদাস ওরফে মানকৃষ্ণ নামদাস বিদায় নিলেন ২৬ মে, ১৯৩৩ এবং মোহিত মোহন মৈত্র চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন ২৮ মে, ১৯৩৩।
নমোদাস অনশনে যোগ দিয়েছিলেন ১৬-ই মে। তার পরদিনই অর্থাৎ ১৭-ই মে তাঁকে জোর করে নাকে নল ঢুকিয়ে জবরদস্তি দুধ গেলানোর চেষ্টা করা হয়। ১৯-এ মে তিনি আক্রান্ত হলেন নিউমোনিয়ায়। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। এরপর ডাক্তারি রিপোর্ট মতে তিনি নাকি খাওয়াদাওয়া করছিলেন অথচ ২৬-মে চিরবিদায় নিলেন নমোদাস। পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টে কারণ হিসাবে লেখা হল নিঊমোনিয়া। ভারত সরকার এই মৃত্যুটাকেও চেপে দেবার জন্য প্রথমদিকে কোনো বিবৃতি জারি না করলেও শেষ পর্যন্ত ২৮-এ মে, ১৯৩৩-এ প্রেস বিবৃতি জারি করতে বাধ্য হল, তাতে মহাবীর সিংয়ের মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হল ‘শক’ এবং নমোদাসের মৃত্যুর কারণ হিসাবে দেখানো হল ‘নিউমোনিয়ার ফলে স্বাভাবিক মৃত্যু’।
যেদিন ভারত সরকার দুজন শহীদ – মহাবীর সিং এবং মানকৃষ্ণ নমোদাস সম্পর্কে প্রেস বিবৃতি জারি করলেন, সেইদিন, ২৮-এ মে ফোর্স ফিডিংয়ে শহিদ হলেন মোহিত মোহন মৈত্র। তিনি ১২-ই মে অনশনে যোগ দিয়েছিলেন এবং তাঁকেও জোর করে নাকের মধ্য দিয়ে রবারের নল ঢুকিয়ে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়। একইভাবে তিনিও প্রতিরোধ করায় দুধ চলে যায় তাঁর ফুসফুসে এবং তিনিও লোবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ২৮-এ মে, ১৯৩৩-এ চিরঘুমের দেশে পাড়ি দেন। এবার সরকারি রিপোর্ট ও প্রেস বিবৃতিতে বলা হল যে নিউমোনিয়ার কারণে তাঁর প্রাণশক্তি নির্বাপিত হয়েছে।
Powered by Froala Editor