'কালাপানি' আন্দামান – ৩৯
আগের পর্বে
চট্টোগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর থেকেই গোটা দেশজুড়ে নামল বৈপ্লবিক আন্দোলনের ঢল। একদিকে আইন অমান্য আন্দোলন, অন্যদিকে সশস্ত্র বিপ্লব। অল্পদিনের মধ্যেই ভরে উঠল মূল ভূখণ্ডের জেলগুলি। বিচার ব্যবস্থা সামাল দিতে স্পেশাল ট্রাইবুনাল চালু করল ব্রিটিশ সরকার। রাজবন্দিদের সাধারণ বন্দিদের থেকে পৃথক করতে দেশজুড়ে গড়ে উঠল চারটি ডিটেনশন ক্যাম্প। সেখানে সন্দেহভাজনকে বন্দি করা হল। আর বিচারে যাদের সাজা হল, তাঁদের ঠিকানা হয়ে উঠল আন্দামান। ১৯১৯ সালে জেলস কমিটির রিপোর্টকে অগ্রাহ্য করেই পুনরায় ১৯৩২ সালে খোলা হল সেলুলারের দরজা। বিভিন্ন নথি অনুযায়ী ১৯৩২-৩৮ সালের মধ্যে সেখানে রাজবন্দিদের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিনশোরও বেশি। তারপর...
ক্ষুধার্ত সেলুলার জেল যেন বসে ছিল নবাগত রাজবন্দিদের গিলে খাবার জন্য। জেলার ব্যারীসাহেব বিদায় নিয়েছেন বটে, কিন্তু অত্যাচারের ধারা তখনও বহমান। ৭-ই অক্টোবর, ১৯৩০-এর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম বিপ্লবী বিজয় কুমার সিংহ সেলুলার জেলে এলেন জুন, ১৯৩৩-এ এবং তিনি সেখানে ছিলেন ২২-শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭ পর্যন্ত। তিনি এখানকার যন্ত্রণার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর In Andamans the Indian Bastille (১৯৩৯) বইয়ে। তাছাড়াও এই সময়ে সেলুলার জেলের কয়েকজন কারাবন্দি বিপ্লবীর কলমে উঠে এসেছে ওই সময়ের যন্ত্রণার কথা।
প্রথমদিকে প্রায় ১০০-জন রাজবন্দি ছিলেন ওই জেলে। মাত্র চব্বিশ বছরে সেলুলার জেলের বিশাল ভবনে যেন বয়সের ছাপ পড়েছে। এরই মধ্যে দেয়ালে ফাটল, সমস্ত ব্লকগুলোর ছাদ ফেটে বৃষ্টির সময়ে জল পড়ে সেলগুলিতে। আর সেলগুলির অবস্থা আরও করুণ। অদ্ধকার, নোংরা সেলগুলির মেঝে থেকে সিমেন্টের চাবড়া উঠে এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে, দেয়ালগুলি নোনা ধরা। সবথেকে খারাপ অবস্থা একতলার সেলগুলির। এই বিচ্ছিরি অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরগুলিতে কিছুদিন কাটাবার পরে বেশিরভাগ বন্দিরাই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। চারদিকে আবর্জনার গা ঘিনঘিনে পরিবেশে মশার উৎপাতে রাতে ঘুমানোটাও দুরূহ হয়ে পড়ে। সেলগুলির ভেতরে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। মশার ওপরে আরেক উপদ্রব হল বিছা ও আরো নানা ধরনের পোকামাকড়। রাত্রে এসব উপদ্রব থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। ওয়ার্ডারদের কাছে একটা লণ্ঠন থাকে বটে। কিন্তু বিপদে অনেক ডাকাডাকি করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায় না। তারা হয়তো তখন লম্বা করিডোরের কোনো একটা কোণে বসে ঝিমোচ্ছে। সেলের ভেতর থেকে আতঙ্কিত কোনো কয়েদির চিৎকার শুনতে তাদের ভারি বয়েই গেছে। সেই সময় এক প্রৌঢ় ছিলেন চিফ ওয়ার্ডার। তিনি রাজবন্দিদের ওপর নৃশংস অত্যাচার করে সুখ্যতি বাড়িয়ে নিজের জন্য ’রায়সাহেব’ উপাধি আদায় করে নিয়েছিলেন।
জেলের ভেতরের মারাত্মক অবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্দিদের অবস্থা আরো করুণ করে তোলে এখানকার আবহাওয়া। একে তো নয়মাস জুড়ে বৃষ্টি, তার ওপর চ্যাটচ্যাটে গরম। আবার যখন নোনা হাওয়া চলে তা যেন এই বিচ্ছিরি সেলগুলিতে আটক মনুষ্য জাতীয় প্রাণীদের কাছে অবর্ণনীয় দুর্দশার কারণ হয়ে ওঠে। ঝড় উঠলে সমুদ্রপাড়ের বালি হুড়মুড় করে উড়ে আসে সমুদ্রমুখী সেলগুলিতে। তার ওপর জলের কষ্ট। দুটো উঠোনে দুটোই মাত্র জলের কল, যা থেকে সারাদিনে মাত্র কয়েক ঘন্টা জল পাওয়া যায়। সেই অপর্যাপ্ত পরিমাণ জলে রান্না, খাবার জল, স্নান এবং ধোয়া-কাচা। তাই মাঝে মাঝেই স্নান করা হয়ে ওঠে না আর জলের অপর্যাপ্ততার কারণেই সবদিন সময়মতো খাবারও পাওয়া যায় না। এর থেকেই বন্দিরা আক্রান্ত হয় আমাশা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ক্রিমি সংক্রান্ত রোগে। আর এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাও তথৈবচ। একজন পাস করা ডাক্তার আছেন বটে, তিনি সবার কাছে ‘ঘোড়ার ডাক্তার’ নামেই সুবিদিত। কারণ যার যাই অসুখ হোক না কেন, সবার জন্য একই ওষুধ বরাদ্দ। একজন কয়েদি কম্পাউন্ডার আছে যার কাজ হল যে কোনো অসুস্থ বন্দিকে একটা ধাতুর কাপে একটা রঙিন মিকশ্চার (কার্মিটিভ মিকশ্চার) ঢেলে রুগিকে গিলে ফেলতে বলা। ডাক্তারকে অনেক গালাগালি করলেও তিনি নিজেকে জেল প্রশাসনের একজন মনে করে এর থেকে বেশি কোনো চিকিৎসা রাজবন্দিদের দিতে অস্বীকার করেন।
আর খাবারের দুর্দশাও সেই পুরনো আমলের মতোই। সকালবেলা ভাতের মাড়, তাকে ‘লপসি’ বা ‘কঞ্জি’ – যে নামেই ডাকো না কেন। লবণহীন এই প্রভাতী পানীয়তে ভেসে বেড়ায় নানা ধরনের পোকামাকড়ের মৃতদেহ। দুপুরে দুটো আটার রুটি, ভাত, ডাল ও সবজি মেলে বটে কিন্তু সেও মনুষ্যভোজের পক্ষে একেবারেই অনুপোযোগী। এখানে দ্বীপে কিছু আনাজের ফলন হয় কিন্তু তা এখানে ব্রিটিশ প্রশাসনের লোকজনকে খাওয়াতেই শেষ হয়ে যায়। কয়েদিদের জন্য অতএব পড়ে থাকে কিছু সবুজ রঙের ঘাস-পাতা, ডালপালা শোভিত কচু, ঘেচু জাতীয় সবজি। আর ডাল বলে যা দেওয়া হয় তার সঙ্গে ঘোলাটে কাদার একটা মিল পাওয়া যায় বটে কিন্তু তার মধ্যে ডাল জাতীয় কোনো পদার্থের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া অনর্থক পরিশ্রম। ভাত এবং রুটি হল সবথেকে জঘন্য প্রকৃতির। এখানে চাল, আটা, সবজি, ডাল, মশলাপাতি সব আসে মূল ভূখণ্ড থেকে। সেইসব জিনিসগুলির জোগান আসে অনেকদিন পরপর। তারপর সেগুলি গুদামজাত করা হয়। এরমধ্যে সেইসব খাদ্যদ্রব্যগুলিতে পোকা লেগে যায়। আর চাল, আটা এবং ডালের যে মান তা মানুষের খাদ্য কখনোই হতে পারে না এবং তা তখনই মানুষকে খেতে দেওয়া যায় শুধুমাত্র তার অসুখের সম্ভাবনা বৃদ্ধির কুমতলব নিয়ে। রুটির জন্য যে আটা ব্যবহার করা হয় তা পোকামাকড়ে ভর্তি থাকে এবং কোনো ঝাড়াইবাছাই না করে সেসব পোকামাকড় শুদ্ধু আটা মেখে রুটি বানানো হয়। ভাতের মধ্যে সুতোর মতো কৃমি ভাসতে থাকে, যা দেখলে বমি উঠে আসে, মাঝপথেই খাবার ছেড়ে উঠে যেতে হয়।
আরও পড়ুন
আবারও সেলুলার জেল
ভারতের মূল ভূখণ্ডের জেলগুলিতে কয়েদিদের কোনো শক্ত কাজ দেওয়া হয় না, কিন্তু এখানে তাঁদের ধরেই আনা হয়েছে পরিশ্রম করিয়ে তাঁদের হাড়মাস আলাদা করে দেবার জন্য। কলুতে কাজ তখন বন্ধ থাকলেও নারকেলের ছোবড়া পেটানো ও তার বের করার মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজ চলতেই থাকত। আর কাজের কোটা শেষ করতে না পারলে কুৎসিত গালাগালি ও শাস্তি তো বরাদ্দ ছিলই।
আরও পড়ুন
মাস্টারদার গ্রেপ্তারি এবং ফাঁসির প্রহসন
শাস্তির মধ্যে সবথেকে মারাত্মক ছিল চাবুকের মার (ফ্লগিং)। শাস্তির একটা অজুহাত খুঁজে পেলেই হল। বন্দিকে উলঙ্গ করে ফ্লগিং স্ট্যান্ডে বেঁধে চাবুকের মার ছিল জেলার ও অন্যান্য প্রশাসনিক লোকজনদের কাছে মর্ষকামী আনন্দ উপভোগ করা। ১২-ই আগস্ট, ১৯৩৪, এক রাজবন্দি, চন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (পি আই নং ১৫৬) তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল যে তিনি এক ডাক্তারকে অপমান করেছেন। দ্রুততার সঙ্গে তাঁর বিচার হল, বিচারে রায় হল ২০ ঘা বেতের বাড়ি। কিন্তু বরিষ্ঠ চিকিৎসক তাঁকে চাবুকের মার সহ্য করতে পারার জন্য শারীরিক ভাবে অনুপযুক্ত ঘোষণা করলে তাঁর সাতদিনের জন্য ক্রশ-বার ফেটারস বা দাঁড়া-বেড়ির শাস্তি বরাদ্দ হল। ১২-ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪, আরেকজন বিপ্লবী, প্রবীর কুমার গোস্বামী (পি আই নং ১০ – ডিভিশন – ২) তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল যে তিনি জেলার জে. ডব্লিউ. এফ. বেইনস-কে লাঞ্ছনা করেছেন। সেইদিনই তড়িঘড়ি তাঁর একটা বিচারের প্রহসন করে ২০ ঘা চাবুকের আদেশ হল। তখনই তাঁর শারীরিক পরীক্ষা হল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শাস্তি প্রযুক্ত হল। এখানে যত সামান্য গাফিলতিই রাজবন্দিদের তরফ থেকে ঘটুক না কেন, তাঁকে শাস্তি দেবার জন্য যেন মুখিয়ে থাকে জেল প্রশাসন। সেইদিনই অভিযোগ, সেইদিনই বিচার, সেইদিনই স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সেইদিনই শাস্তি প্রয়োগ। এইভাবেই ১২-ই নভেম্বর সুধেন্দ্রচন্দ্র দামকে ৩০ ঘা বেতের বাড়ির শাস্তি পেতে হয়েছিল। এই চাবুকের শাস্তির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বেড়িধারণের শাস্তি তো যে কোনো অজুহাতে হতভাগা রাজবন্দিদের জন্য জলভাত ছিল।
আরও পড়ুন
জালালাবাদের যুদ্ধ
আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ
সেলগুলির ভেতরে ড্যাম্প, অপুষ্টিকর খাবার, চিকিৎসার অভাব এবং বাইরে তুমুল আর্দ্র জলবায়ুর কারণে অনেক রাজবন্দির শরীরই খারাপ হতে শুরু করল। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া, শরীরের ওজন কমে যাওয়ার পাশাপাশি ঘুসঘুসে জ্বর এবং অবশেষে এক্স-রে করে যখন টিবি ধরা পড়ল তখন তা নিরাময়ের বাইরে। মারাত্মক ভাবে টিবিতে আক্রান্ত হবার কারণে মেয়াদ শেষ না করে আন্দামান থেকে ফিরিয়ে নিতে হয়েছিল মুকুল সেন (পি আই ৭), প্রফুল্ল মজুমদার (পি আই ৩৮), বুধু সেন (পি আই ৮৭), জগত রায় (পি আই ৩৯), মোহিত অধিকারী (পি আই ১১০), নেপাল সরকার (পি আই ২৪৯), সুরেন সরখেল (পি আই ৩০৭) এবং নিখিল গুহরায়’কে (পি আই ৭২)’কে। টিবির প্রথম অবস্থাতেই ধরা পড়ে যাঁরা ফিরে গিয়েছিলেন তাঁরা হলেন কেশব সমাজদার (পি আই ৩৪১), কেশব প্রসাদ (পি আই ২০১), শশী ভট্টাচার্য (পি আই ১২৩), সরোজ গুহ (পি আই ১৪৬), সুনীল চ্যাটার্জী (পি আই ১১৯) এবং সুধাংশু সেন (পি আই ১৪৮)। এঁরা ছাড়াও অ্যাপেন্ডিসাইটিসের কারণে ১৯৩২-এ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বীরেন্দ্র রায়কে, ১৯৩৩-এ সত্য বসু (পি আই ৬৪) ফিরেছিলেন গল-ব্লাডার বর্ধিত হবার কারণে, কমল শ্রীমানি (পি আই ২৪১) কিডনিতে পাথর থাকার কারণে ফেরেন ১৯৩৬-এ এবং মহেশ বড়ুয়া (পি আই ২৮৫) ফেরেন হৃদরোগে আক্রান্ত হবার কারণে। তাছাড়া মারাত্মকভাবে হাঁপানি বেড়ে যাওয়াতে ফিরিয়ে নিতে হয় রামপ্রতাপ সিং (পি আই ১১১) এবং অজয় সিং (পি আই ২৫১)-কে।
যাঁরা পড়ে রইলেন তখনও সেলুলার জেলে তাঁদের সবার যে শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল তেমন মনে করার কোনো কারণ নেই। হৃদরোগে আক্রান্ত হন ধ্রুবেশ চ্যাটার্জী (পি আই ১১২), প্রশান্ত সেন (পি আই ২৩৪), রেবতী সাহা (পি আই ১৯৬) এবং সত্যেন মজুমদার (পি আই ৩৬৯)। তাছাড়াও মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন কালী ভট্টাচার্য (পি আই ১৩৩) এবং বিজয় চক্রবর্তী (পি আই ৩১৫)। বাতরোগে কাতর হন হেমেন্দ্র চক্রবর্তী (পি আই ৫১), রণধীর দাশগুপ্ত (পি আই ২২) এবং অমর সূত্রধর (পি আই ১৩৭)। অগ্নিমান্দ্য রোগ বা ডিস্পেপসিয়া, আমাশা, ম্যালেরিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। তাছাড়া চোখের সমস্যাতেও ভুগছিলেন অনেকে। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলাতে দণ্ডভোগ করতে আসা শেও বা শিব ভার্মা (পি আই ১১৫) মারাত্মক চোখের অসুখে ভুগেছেন। তার ওপর মানসিক ভারসাম্য হারানো এবং স্নায়ুবৈকল্য রোগের শিকার হয়েছিলেন অনেকেই।
মাঝেমধ্যে যে সমস্ত উচ্চ-আধিকারিকরা আন্দামানে সেলুলার জেল পরিদর্শনে আসতেন সাধারণত তাদের কাছেই রাজবন্দিরা তাঁদের অভিযোগ জানাতেন। ১৯৩৪-এ মাদ্রাজ থেকে জেল পরিদর্শনে এলেন নারায়ণস্বামী চেট্টি। রাজবন্দিরা তাঁর সঙ্গেও দেখা করে তাঁকে জেলের অসহনীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং একগুচ্ছ চাহিদার সনদপত্র জমা দেন। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ-ভক্ত। দেশে ফিরে তিনি আন্দামান প্রশাসন সম্পর্কে একগুচ্ছ প্রশংসা করেন এবং বলেন যে ওখানে বন্দিজীবন অত্যন্ত সুমধুর এবং বন্দিরা সবাই সেখানে আনন্দে আছেন।
[*পি আই – (P. I. – Permanently incarcerated) – স্থায়ী বা যাবজ্জীবন বন্দি]
Powered by Froala Editor