আবারও সেলুলার জেল

১৯৩০-এর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক আক্রমণের ঢল নামল। এই সময়েই গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনের পাশাপাশি জোয়ার এল বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে। একের পর এক ধরা পড়ছেন বিপ্লবীরা। বাংলার সরকারের তখন সসেমিরা অবস্থা। কোথায় রাখবেন এঁদের? মূল ভূখণ্ডের জেলগুলিতে রাখলে এঁরা বাইরের বিপ্লবীদের সঙ্গে যে কোনোভাবে যোগাযোগ করে নিচ্ছেন। ব্যাপারটা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে খুব বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বেশির ভাগেরই বিচার করা যাচ্ছে না, বিনা বিচারে আটক রাখার পথ নিল ব্রিটিশ সরকার। জরুরি ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করে তিনজন বিচারপতি (একজন হিন্দু, একজন মুসলিম এবং একজন ব্রিটিশ বিচারপতি) নিয়ে গঠিত হল স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনাল। এরা বদ্ধ আদালতে পুলিশের ধরে আনা আটকদের বিভিন্ন জায়গায় আটক রাখার প্রস্তাব দেবেন। নতুন আইন অনুযায়ী জেলগুলিতে এখন শুধু সাধারণ আইনভঙ্গকারী কয়েদিদের রাখা হবে আর যারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে হিংস্র অপরাধমূলক কাজে অভিযুক্ত তাদের পাঠানো হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে।  

সাধারণ বন্দিদের থেকে দুরে সরিয়ে রাখার জন্য তড়িঘড়ি চারটে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করা হল – কলকাতার  সবথেকে কাছাকাছি ডিটেনশন ক্যাম্প খোলা হল বহরমপুর এবং খড়গপুরের কাছে হিজলীতে (বর্তমানে আইআইটি খড়গপুরের অন্তর্গত)। বহরমপুর ছিল কাউকে অন্য কোনো ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর আগে ওয়েটিং স্টেশন। যে সমস্ত বিপ্লবীদের বিনা বিচারে আটক করা হল তাঁদের তিনটি ভাগে ভাগ করে হয়েছিল। যাঁরা ব্রিটিশদের চোখে কম ক্ষতিকর তাঁদের পাঠানো হত কলকাতার কাছে হিজলী ডিটেনশন ক্যাম্পে, যাঁরা একটু বেশি ক্ষতিকর তাঁদের জন্য বরাদ্দ হল ভুটান সীমান্তের কাছে ডুয়ার্সে সমুদ্র থেকে ২০০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের মাথায় বক্সা ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে যেতে হলে বন্দিদের রাস্তা থেকে অনেকটা পথ হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হত, যার শেষ পর্যায়ে ছিল মাইলখানেক খাড়া পাহাড়ে চড়া। আর সব থেকে যাঁরা ব্রিটিশ প্রশাসনের চোখে ছিলেন মারাত্মক অপরাধী তাঁদের নিয়ে যাওয়া হত বাংলা থেকে অনেকটা দূরে রাজস্থানে মরুভূমির বুকে দেওলি ক্যাম্পে। কলকাতা থেকে দুটো রাত ট্রেনে কাটিয়ে, অর্ধেক দিন বাসে চড়ে, নৌকোতে নদী ডিঙিয়ে তারপর আরেকটি বাসে চড়ে মরুপথে যাত্রা করে পৌঁছাতে হত দেওলি ক্যাম্পে।

এ তো গেল বিনা বিচারে আটক সন্দেহজনক বন্দিদের কথা। কিন্তু বিচারে যাঁদের সাজা হয়েছে, তাঁদের রাখা হবে কোথায়? বাংলা থেকে ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানানো হল এই সমস্ত রাজবন্দিদের আন্দামানে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হোক। ভারত সরকার এই আবেদনে প্রাথমিক ভাবে সাড়া দিয়ে স্যার জন অ্যান্ডারসনকে পাঠালেন আন্দামানে সেখানকার অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করে আসতে। তিনি রিপোর্ট দিলেন যে ভারতীয় জেলগুলিতে ঢিলাঢালা শৃঙ্খলার কারণে রাজবন্দিদের আন্দামানে পাঠানো যেতে পারে। ভারত সরকারকে ১৯১৯-২০-এর ইন্ডিয়ান জেলস কমিটি (কারডিউ কমিটি) যে সুপারিশ করেছিল এবং সেই সুপারিশ অনুযায়ী ১১ মার্চ, ১৯২১-এ ভারতের সংসদে স্বরাষ্ট্র সচিব স্যার উইলিয়াম ভিনসেন্ট আন্দামানে রাজবন্দিদের দ্বীপান্তরিত স্থগিত রাখার যে ঘোষণা করেছিলেন তা অমান্য করে ১২ জুলাই, ১৯৩২-এ  সচিব স্যার স্যামুয়েল হোয়ার ভারতীয় সংসদে ঘোষণা করলেন যে পুনরায় আন্দামান সেলুলার জেলে রাজবন্দিদের পাঠানো হবে। ১৯১৯-এর জেলস কমিটির রিপোর্টকে অগ্রাহ্য করে আবারও আগস্ট, ১৯৩২-এ  খুলে দেওয়া হল আন্দামান সেলুলার জেলের দৈত্যাকার ফটক। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের আবার গিলে খাবার জন্য সেলুলার জেল অপেক্ষায় থাকল।

সেলুলার জেলের ছাদ থেকে

 

আরও পড়ুন
মাস্টারদার গ্রেপ্তারি এবং ফাঁসির প্রহসন

১৫-ই আগস্ট, ১৯৩২। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মোট ২৫ জনের দল নিয়ে প্রথম বিপ্লবীরা রওনা হলেন আন্দামানের পথে। এরপর মে, ১৯৩৩ পর্যন্ত চারটি দলে ভারতের নানা জায়গা থেকে অন্যান্য বিপ্লবীদের দল কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেল হয়ে আন্দামানে আসতে থাকলেন। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বটুকেশ্বর দত্ত, মহাবীর সিং, কুন্দন লাল এবং ডাঃ গয়া প্রসাদ এলেন জানুয়ারি, ১৯৩৩-এ। জুন, ১৯৩৩-এ এলেন বিজয়কুমার সিংহ এবং শিব ভার্মা। এবার শুধুমাত্র যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত রাজবন্দিরাই নয়, সাধারণ কয়েক বছরের জন্যে দণ্ডিত সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক বন্দিদেরই আবাসস্থল হয়ে উঠতে থাকল সেলুলার জেল। মার্চ, ১৯৩৩-এর মধ্যে জেলে রাজবন্দিদের সংখ্যা ছুঁল একশোতে যা ভারত সরকার ২৫ মে, ১৯৩৩-এ নিশ্চিত করল। আন্দামানে যাঁদের পাঠানো হল তাঁদের বয়সের বিচার করা হয়নি। এই সময়ে যাঁরা এলেন তাঁদের মধ্যে আনন্দ প্রসাদ গুপ্ত, সহায়রাম দাস, ফকির চন্দ্র সেন, হরিপদ ভট্টাচার্যা, সুধেন্দু বিকাশ দস্তিদার এবং হীরা মোহন চ্যাটার্জীর বয়স ছিল ১৮-এর কম।  

আরও পড়ুন
জালালাবাদের যুদ্ধ

কলকাতার মেছুয়াবাজার বোমা মামলা, মৈমনসিংহে গাঁজা-মদ গুদামে হামলা করা বিপ্লবী, ঝাঁসি কমিশনারের ওপরে হামলা করা স্বদেশি, আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে স্বদেশি ডাকাতি করা রাজনৈতিক কর্মী, আথারাবাড়ি রাজনৈতিক ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত বিপ্লবী, আর্মস অ্যাক্টে ধৃত কর্মী ছাড়া শিয়ালদহ স্বদেশি ডাকাতি, আলিপুর স্বদেশি ডাকাতি, বরিশাল জেলা স্কুল স্বদেশি ডাকাতি, ফরিদপুর অস্ত্র ও বোমা ষড়যন্ত্র, ঢাকা কমিশনারের ওপর হামলা, বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা, ব্রাহ্মণবেড়িয়া স্বদেশি ডাকাতি, ঢাকা স্বদেশি ডাকাতি, চারমাগুড়িয়া ডাকঘর ডাকাতি, অরণ্যপ্রস্থ ষড়যন্ত্র মামলা, ঢলঘাট সংঘর্ষ, টাঙ্গাইল স্বদেশি ডাকাতি, কলকাতায় অস্ত্র রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত, কুলাসেনী স্বদেশি ডাকাতি, দামোদিয়া মিল ডাকাতি, স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদকের ওপর হামলায় ধৃত, আঙ্গারিয়া মেল ডাকাতি, হিলি রেলওয়ে স্টেশনের স্বদেশি ডাকাতি, মানিকগঞ্জ মেল ডাকাতি, ইটখোলা মেল ডাকাতি, মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা ষড়যন্ত্রের মামলা, নলডাঙ্গা স্বদেশি ডাকাতি, পুলিশের চরের ওপর প্রাণঘাতী হামলা, বাধুয়া স্বদেশি ডাকাতি, বাংলার গভর্নর হত্যার ষড়যন্ত্র, দিনাজপুর ষড়যন্ত্র, বীরভূম ষড়যন্ত্র, গৃহে অন্তরীণ থাকার নির্দেশের অবমাননা, আন্তঃরাজ্য ষড়যন্ত্র, গাইবান্ধা-রংপুর অস্ত্র মামলা, আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা এবং অন্যান্য ছোটোখাটো নানা রাজনৈতিক মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত সমস্ত রাজবন্দিদের মামলার গুরুত্ব নির্বিশেষে পাঠানো শুরু হল আন্দামানে।

আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ

বাংলা ছাড়াও ২৫ মে, ১৯৩৩ পর্যন্ত বিহার ও উড়িষ্যা থেকে ৬-জন এবং পাঞ্জাব ও দিল্লি থেকে ৮-জন রাজনৈতিক বন্দিকে আন্দামানে পাঠানো হল।

আরও পড়ুন
মোহে রং দে মেরা বাসন্তী চোলা

নতুন ভাবে যখন সেলুলার জেল খুলে দেওয়া হল তখন বলা হয়েছিল যে সর্বোচ্চ একশোজনকে সেখানে পাঠানো হবে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ১৯৩৪-এর শেষে গিয়ে হিসেবে দেখা গেল যে মোট রাজবন্দিদের সংখ্যা দুশোতে চলে গেছে। ১৪-ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৫-এ ভারতের সংসদে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিবের এক বিবৃতি থেকে জানা যায় যে ওই সময়ে আন্দামান সেলুলার জেলের মোট রাজনৈতিক কারণে বন্দিদের সংখ্যা হল ২৩৭ (রাজ্যভিত্তিকে পরিসংখ্যানে জানা যায় যে ওই সময়ে সেলুলার জেলে আটক ছিলেন বাংলা থেকে ২০৮ জন, বিহার এবং উড়িষ্যা থেকে ১৩ জন, ৭ জন পাঞ্জাবের, মাদ্রাজের ৬ জন এবং দিল্লির ৩ জন)। অক্টোবর, ১৯৩৬-এ সরকারের পক্ষ থেকে যে দুজন সাংসদ, রায়জাদা হংস রাজ এবং মহম্মদ ইয়ামিন খানকে প্রতিনিধি করে যখন পোর্ট ব্লেয়ারে পাঠানো হয় তখন সেখানে মোট রাজবন্দিদের সংখ্যা ছিল ৩১০। এমনকি ১৯৩৭-এর জুলাইয়ে কয়েকজন ছাড়া পাবার কারণে বা অসুস্থতার জন্য মূল ভূখণ্ডে ফিরে গেলে সংখ্যা কিছুটা কমে ৩০০-তে দাঁড়ায়। প্রাক্তন আন্দামান রাজনৈতিক বন্দি মৈত্রি সার্কেল কর্তৃক বানানো তালিকা থেকে ১৯৩২-৩৮ সময়ে যে রাজনৈতিক বন্দিদের তালিকা পাওয়া যায় তার থেকে দেখা যায় যে এই সময়ে মোট ৩৬৬-জন রাজবন্দি সেলুলার জেলে ছিলেন। এঁদের মধ্যে রাজ্যগত পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে এই সময়ে বাংলা থেকে ৩৩২-জন, বিহার থেকে ১৮-জন, উত্তরপ্রদেশ থেকে ৯-জন, পাঞ্জাব ও মাদ্রাজ থেকে ৩-জন করে এবং দিল্লি থেকে ১-জন সেলুলার জেলে ছিলেন। আবার আন্দামান ও নিকোবর প্রশাসন থেকে যে বুকলেট প্রকাশ করা হয় তা থেকে এই সময়ে সেলুলার জেলে আটক রাজবন্দিদের সংখ্যা পাওয়া যায় ৩৭৮। এর মধ্যে বাংলা থেকে ৩৩৭-জন, বিহার থেকে ১৯-জন, উত্তরপ্রদেশ  থেকে ১১-জন, আসাম থেকে ৫-জন, এবং পাঞ্জাব, দিল্লি ও মাদ্রাজ থেকে ২-জন করে রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন। আবার আন্দামান ও নিকোবর প্রশাসন থেকে প্রকাশিত Unsung Heroes of Freedom Struggle in Andamans – Who’s Who বইয়ে যে তালিকা দেওয়া আছে তার থেকে জানা যায় যে এই পর্বে সেলুলার জেলে মোট দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের সংখ্যা ছিল ৩৮৬জন। রাজ্যওয়ারি হিসাবে দেখা যায় এই সময়ে বাংলা থেকে মোট বন্দি ছিলেন ৩৩৮-জন, বিহার থেকে ১৯-জন, যুক্তপ্রদেশ থেকে ১৩ জন, মাদ্রাজ থেকে  ৭-জন, আসাম থেকে ৫-জন এবং পাঞ্জাব ও দিল্লি থেকে ২-জন করে।

Powered by Froala Editor