জালালাবাদের যুদ্ধ

‘কালাপানি আন্দামান— ৩৬
আগের পর্বে

১৯৩০ সাল। মাস্টারদাকে সভাপতি করে গড়ে উঠল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টোগ্রাম শাখা। অনুশীলন এবং যুগান্তরের পাশাপাশি মাস্টারদা স্বতন্ত্র চিন্তাধারা নিয়ে শুরু করলেন নতুন সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন। করলডাঙা পাহাড়ে শুরু হল অস্ত্রচালনার অনুশীলন। যুদ্ধের দিন হিসাবে বেছে নেওয়া হল ১৮ এপ্রিলকে। কেন না, গুড ফ্রাইডে হওয়ায় পাহারা শিথিল থাকবে সেদিন। আর সেই ফাঁকেই হবে চট্টোগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। হলও তেমনটা। বিপ্লবীদের হাতে প্রাণ দিলেন ৬ ব্রিটিশ কর্তা। শেষে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল চট্টোগ্রামের অস্ত্রাগারে। অন্যদিকে তখন পুড়ে ছাই টেলিফোন ভবন। তারপর...

মাস্টারদারা ধীরে ধীরে শহর ছেড়ে পাহাড়ের দিকে যাত্রা করলেন। তাঁদের সবারই হাতে অজস্র অস্ত্রশস্ত্র অথচ খাবার নেই এক কণা। পাহাড়ের আমগাছের কচি আম, তেঁতুল পাতা, চাষির ক্ষেতের তরমুজ দিয়ে কোনমতে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে সারারাত হেঁটে ও দিনে কোনো এক পাহাড়ে চড়ে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে তাঁরা লুকিয়ে থাকছেন। ২১-শে এপ্রিল অমরেন্দ্র নন্দী, যে চট্টগ্রাম শহরকে হাতের তালুর মতো চেনে তাকে পাঠানো হল যাতে সেখানে কী ঘটছে তার খবর সে সংগ্রহ করে আনতে পারে। কিন্তু অমরেন্দ্র আর ফিরল না। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগেই আত্মহত্যা করে বসল। ওইদিন পাহাড়ে গাছের আড়ালে যখন পুরো দল লুকিয়ে আছে তখন দেখা মিলল দু’টি সন্দেহজনক লোকের। তাদের ধরা হলে নিজেদের তারা রাখাল বলে পরিচয় দিল। সবাই একমত হল যে এরা রাখাল হতেই পারে না, এরা আসলে পুলিশের চর, কারণ প্রথমত, এদিকে কোনো গোরু-ছাগল ওই মূহূর্তে চড়ছে না এবং দ্বিতীয়ত, এই লোকগুলোর যা বয়স তাতে এদের রাখাল বলে মেনে নেওয়া যায় না যেহেতু রাখালরা সাধারণত বালকই হয়ে থাকে। তবু মাস্টারদার নির্দেশে তাদের ছেড়ে দেওয়া হল। পরে আদালতে বিচার চলার সময় তাদের যখন সাক্ষী হিসাবে হাজির করা হয়, তারা কিন্তু এদের কাউকে পাহাড়ে দেখেছে বলে স্বীকার করেনি। আবার, বিচার চলাকালীন হাজির করা হয়েছিল দু’জন ট্যক্সি ড্রাইভারকে, যাদের ট্যাক্সি ওই চট্টগ্রাম  লুণ্ঠনের কাজে যাবার সময় ভাড়া করা হয়েছিল; সেই ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ওই ঘটনার পরেপরেই পুলিশের দেখানো ছবি থেকে অনেককে শনাক্ত করলেও আদালতে দাঁড়িয়ে কাউকে চিনিয়ে দেয়নি। আবার যে মুসলমান ছেলেটি শহরে কোনো  একটি শারীরিক-সাংস্কৃতিক ক্লাবের সামনে রেস্তোঁরা চালাত এবং যে রেস্তোঁরাটিতে দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সংঘঠিত হয়েছে, সেই ছেলেটি সবাইকে চিনলেও আদালতে দাঁড়িয়ে কাউকে শনাক্ত করতে অস্বীকার করে। সেই ১৮-ই এপ্রিল রাত্রে অক্সিলিয়ারি ফোর্স আর্মারিতে লুন্ঠনের সময় বাধা দিতে আসা মেজর ফোরেলকে যখন লোকনাথ বল’এর নির্দেশে গুলি করে মারা হল তখন মেজরের যে মুসলমান বেয়ারা ছিল, সে পুরো ঘটনার সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও আদালতে দাঁড়িয়ে লোকনাথ বল-কে শনাক্ত করেনি। এসবই বিপ্লবীদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থেকে হয়েছিল। 

এরপর ২২শে এপ্রিল ভোরবেলা মাস্টারদা পুরো দলবলসহ এসে পৌঁছলেন জালালাবাদ পাহাড়ের নিচে। সিদ্ধান্ত হল পাহাড়ে চড়ার। ওইদিন সবাই যখন মাস্টারদার নেতৃত্বে পাহাড়ে চড়েছেন সেইদিন বিকেল চারটের সময় চট্টগ্রাম নাজিরহাট শাখা রেল লাইনের ‘ঝরঝরিয়া বটতলা’ মসজিদের পাশে এসে থামল একটি ট্রেন। রেলগাড়ি থেকে নেমে এল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস ও সুর্মা ভ্যালি লাইট ইনফ্যান্ট্রির সশস্ত্র সেনাবাহিনীর দল। তারা রওনা হল জালালাবাদ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের দুদিকে অন্য দুটো উঁচু পাহাড়ের মাথায় বসানো হল মেশিনগান।

ইতিমধ্যে লোকনাথ বলের নির্দেশে আটভাগে বিপ্লবীদের বাহিনীকে পাহাড়ের সবপাশে সাজানো হল। এইদিকে পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে ব্রিটিশ সেনার দল। তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে ভাবছে ওই তো ভারি বাঙালির দল, শখের বিপ্লবী, অপেশাদার হাতে তারা চালাবে গুলি! ঠিক সেদিন যেমন ঘটেছিল অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার লুঠের সময়। অকুতোভয় মেজর ফোরেলকে একবার সাবধান করা হয়েছিল তবু তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “What, you Bengali dogs – will you shoot?” এই বোকামির জন্যই তো তাকে সেদিন প্রাণ হারাতে হয়েছিল।  ঠিক একইভাবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভর করে একটু একটু করে বন্দুকের পাল্লার মধ্যে উঠে আসছে ব্রিটিশ সেনাদল। নিশ্বাস চেপে তরুণ বিপ্লবী দল অপেক্ষা করছে নেতৃত্বের নির্দেশের – “volley fire”.

চট্টগ্রামে জালালাবাদ পাহাড়

 

আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ

শুরু হল যুদ্ধ। ওপর থেকে গাছের আড়ালে থেকে লড়াইয়ের যে সুবিধা আছে তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করল ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মি’র তরুণ যোদ্ধারা। পাহাড়ের কোলে একে একে লুটিয়ে পড়ল ব্রিটিশ সেনা। প্রথমে ওরা এদের কল্পনাতীত সাহস দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হল কিন্তু পরে নিজেদের প্রাণরক্ষার তাগিদে গুলি চালাতে লাগল। প্রথমেই সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারালেন লোকনাথ বলের অনুজ হরিগোপাল বল ওরফে টেগরা। দলের এক কনিষ্ঠতম সদস্য চলে গেলেন।  এদিকে গুলি চালাতে চালাতে রাইফেল অকেজো হয়ে পড়ছে। সেইগুলি পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিলেন নির্মল সেন ও মাস্টারদা। অকেজো রাইফেলগুলি সারাই হয়ে আবার ফিরে আসছে যোদ্ধাদের কাছে।

আরও পড়ুন
মোহে রং দে মেরা বাসন্তী চোলা

ওদিকে তখন দুদিকের পাহাড় থেকে বৃষ্টিধারার মতো মেশিনগানের গুলি ছুটে আসছে। একে একে শহিদের মৃত্যুবরণ করলেন নির্মল লালা, নরেশ রায়, বিধু ভট্টাচার্য, জিতেন দাশগুপ্ত, ত্রিপুরা সেন, পুলিন ঘোষ, শশাঙ্ক দত্ত, মধু দত্ত, মতি কানুনগো।  সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। সবাইকে অবাক করে যুদ্ধে বিরতি দিয়ে ট্রেনে করে ইংরেজ সেনাবাহিনী বিদায় নিল। একে একে একজায়গায় জড়ো করা হল শহিদদের মৃতদেহগুলি। একটা একটা করে দেহ আসে আর মাস্টারদা বুকের ওপর কান রেখে বসে থাকেন কিছুক্ষণ, যদি হৃদপিন্ডের স্পন্দন শোনা যায়! যদি প্রাণ থাকে, যদি বাঁচানো যায়। পরম মমতায় বারবার হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন মৃত সাথীদের চোখে মুখে মাথায়। নির্মল লালার মুখে যেন তখনও হাসি লেগে আছে। নিজের অজান্তেই নির্মলের দেহের পাশে বসে পড়েন তিনি। ওর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকেন সর্বকনিষ্ঠ এই শহিদের মুখের দিকে। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা খেলা করে যায় চোখেমুখে। গভীর আবেগে একটা স্নেহচুম্বন এঁকে দেন ওর কপালে। তারপর নির্মলের মাথাটা অতি যত্নে মাটিতে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পরম প্রিয় সন্তানতুল্য সাথীদের দেহগুলোর দিকে আরেকবার তাকিয়ে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, চলো এবার সবাই। আর পেছনে ফিরে তাকালেন না মাস্টারদা।  সিদ্ধান্ত হল ওই রাতেই এই পাহাড় ছাড়তে হবে।

আরও পড়ুন
সার্ফরোসি কি তামান্না আব হামারে দিল মে হ্যায়

পরদিন সকালে সেনাবাহিনী আবার এল। এবার তারা একনাগাড়ে গুলি করতে থাকল জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে। কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর এল না। এরপর ভারতীয় পুলিশবাহিনীকে সামনে রেখে সেনাবাহিনী উঠে এল পাহাড়ের মাথায়। কোথাও কেউ নেই। শুধু তাদের সামনে পড়ে আছে কিছু মৃতদেহ। এরপর মৃতদেহগুলিকে একজায়গায় জড়ো করে সেগুলিকে নিচে নামিয়ে আনা হল। একটা বড়ো গর্ত করে তাতে সবকটি দেহ ফেলা হল। এরপর সেনাবাহিনী সেই অনন্তযাত্রায় যাওয়া বিপ্লবীদের সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে সেখানে জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে আনা কাঠে পেট্রল ঢেলে তাঁদের সৎকারের ব্যবস্থা করল।

আরও পড়ুন
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

মাস্কেট্রি রাইফেল, যা নিয়ে বিপ্লবীরা প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন

 

আগের দিন বিকালে জালালাবাদ পাহাড় থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ফিরে যাবার কারণ জানা গিয়েছিল অনেক পরে। আসলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ধারণাই ছিল না যে মাস্টারদার দলের লোকবল কত। একে তো সারাদিনে তারা তাদের অনেক সেনাকে হারিয়েছে, জখমও হয়েছে অনেকে। তাদের আশঙ্কা ছিল রাতের অন্ধকারে অন্য পাহাড়গুলি থেকে যদি আরও বিপ্লবীরা আক্রমণ চালায় তবে তারা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

সেইরাত্রে যখন জালালাবাদের পাহাড় ছেড়ে বিপ্লবীদের দল নেমে অন্ধকারের মধ্যে ছুটে  অন্যত্র আশ্রয়ের খোঁজে চলেছেন, তখন তাঁদের ইংরেজ সেনাবাহিনীর অনেক সেনার মৃতদেহে হোঁচট খেতে খেতে পালাতে হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার কোনোদিনই স্বীকার করেনি ঠিক কতজন সেনা এই জালালাবাদের যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। তবে পরে গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল এবং আনন্দ গুপ্তের বিরুদ্ধে মামলা সাজাতে গিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁদের হাতে ৬৪ জন সেনা মারা গিয়েছিল। পরে এটাও শোনা গিয়েছিল যে মৃত সেনাদের দেহগুলি তাদের পরিবারের হাতে তুলে না দিয়ে একটা রেলের বগি ভর্তি করে তা নাকি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়।

২২-শে এপ্রিল রাত্রে জালালাবাদ পাহাড় থেকে নেমে আসার পরে আবার চলা শুরু হল। এদিকে ক্ষিদে-তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত তবু চলতেই হবে। কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। শত্রুপক্ষ জেনে গেছে বিপ্লবীদের আশ্রয়। জালালাবাদ  পাহাড় থেকে দূরে, আরও দূরে সরে যেতেই হবে। আবার দিনের আলোতে কোনো না কোনো পাহাড়ের আশ্রয়ে লুকিয়ে থেকে কাছের গ্রামগুলিতে একটু খাবারের সন্ধান করা। এই মুহূর্তে হাতে অস্ত্রশস্ত্র প্রচুর পরিমাণে থাকলেও জালালাবাদের যুদ্ধে অনেককে হারিয়ে লোকবল কমে গেছে। কিন্তু এভাবে তো আর পারা যায় না! মাস্টারদা আর নির্মলবাবু সবার কাছে জানতে চাইলেন যে কেউ কোনো আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারবে কি না। সাড়া দিল সুবোধ রায়। সবাইকে নিয়ে গিয়ে তুলল চট্টগ্রাম শহরের কাছে তার গ্রামের বাড়িতে। সেই রাতের মতো সবার জন্য পানীয় জল আর খাবারের ব্যবস্থা হল। পরদিন রাতে সুবোধকে চট্টগ্রাম শহরে তার বাড়িতে ফিরে যেতে বলে বাকিরা রওনা হল অন্যত্র গোপন আশ্রয়ের খোঁজে। সবাই চলে গেলে সুবোধ ফিরে এল চট্টগ্রাম শহরে তার বাড়িতে। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হল। প্রচুর অত্যাচারেও তার মুখ থেকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ সম্পর্কে একটা বাক্যও উচ্চারণ করানো গেল না। অবশেষে চট্টগ্রাম জেল, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, ঢাকা সেন্ট্রাল জেল  ঘুরে প্রশাসনিক নির্দেশে পুনরায় যখন সেলুলার জেল সশস্ত্র বিপ্লবীদের জন্য খুলে দেওয়া হল তখন অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁর আন্দামানে দ্বীপান্তর হল।

Powered by Froala Editor