চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ

'কালাপানি' আন্দামান - ৩৫
আগের পর্বে

ভগৎ সিং, সুকদেব এবং রাজগুরুর ফাঁসির আদেশে দেশের বিভিন্ন শহরে পালিত হল হরতাল। জেলের দেওয়াল ভেঙে ভগৎ সিং-কে বের করে আনার পরিকল্পনা করলেও, ব্যর্থ হন ভগবতীচরণ ভোরা। বোমা পরীক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। অন্যদিকে ফাঁসি বন্ধের জন্য আরউইনের কাছে কোনোরকম আবেদনই করেননি গান্ধীজি। পরবর্তীকালে এই ঘটনার জন্য কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই চর্চিত হলেন তিনি। তবে দিল্লিতে এক জনসভায় প্রতিবাদে সরব হন সুভাষচন্দ্র। কিন্তু এতকিছুর পরেও লাভ হল না কোনো। ১৯৩১ সালের, ২৩ মার্চ। নির্ধারিত দিনের আগেই ফাঁসি হয়ে গেল ভগৎ সিং-দের। তারপর...

পরিকল্পনা হল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের। তার জন্য গড়ে তোলা চাই এক শক্তিশালী সংগঠন। ১৯৩০ সালে মাস্টারদাকে সভাপতি ও অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন, অনন্ত সিংহ  ও গণেশ ঘোষকে সদস্য করে গঠন করা হল ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি – চট্টগ্রাম শাখা’। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির অনুসরণে এই নামকরণ হল। মাস্টারদার স্বপ্ন ছিল একদিন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে তাঁর রিপাবলিকান আর্মি, বিভিন্ন প্রদেশে সংগঠনের শাখা খুলতে হবে, তাই তিনি চট্টগ্রাম শাখা হিসাবে আপাতত প্রতিষ্ঠা করলেন এই সংগঠন। বাংলায় তখন বিপ্লবী দল বলতে অনুশীলন এবং যুগান্তর। মাস্টারদা স্বতন্ত্র চিন্তাধারা নিয়ে গড়ে তুললেন এই নতুন বিপ্লবী সংগঠন, যার মূল লক্ষ্য হল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশদের উৎখাত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা স্থাপন করা। এর জন্য চাই সশস্ত্র বাহিনী, যে বাহিনী প্রশিক্ষিত হবে গেরিলা যুদ্ধে এবং আধুনিক যুদ্ধে প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে পারবে।  

এবার লড়াই হবে মরণপণ। প্রয়োজনে ব্রিটিশ মিলিটারির সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামতে হতে পারে। শুধুমাত্র সুদৃঢ় সংগঠনই নয়, অস্ত্রচালনা শিক্ষার পাশাপাশি শিখে নিতে হবে গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল। কাজে নেমে পড়লেন জুলু সেন, নির্মল সেন, অনুরূপ সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, চারুবিকাশ দত্ত প্রমুখ বিপ্লবীরা। মাস্টারদার নেতৃত্বে শুরু হল নতুন অভিযান। কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক তখন মাস্টারদা। ১৯২৮ সাল থেকেই নজর রাখা শুরু হয়েছিল কংগ্রেস ভলেন্টিয়ার ও বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যদের ওপর। ততদিনে অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল এবং অন্যান্যরা ভবিষ্যতে ইংরেজদের  বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন এবং সেই উদ্দেশ্যে এই সমস্ত জায়গা থেকে বাছাই করা ছেলেদের তুলে আনছিলেন। বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন ছেলে রিক্রুট করা চলছিল। এরপর গভীর রাতে কোনো এক নির্জন জায়গায়, যেমন শ্মশানে আসতে বলা হত অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য।

চট্টগ্রামের বুকে অনেক ছোটো বড়ো পাহাড়ের সমাবেশ। করলডাঙা পাহাড়ের ওপরে মেধস মুনির আশ্রম। অরণ্যে ঘেরা নির্জন জায়গা। ঠিক হল এইখানেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম শহরে দুটি অস্ত্রাগার – পুলিশ অস্ত্রাগার এবং অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার। তাছাড়া শহরের টিলার মাথায় টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ কেন্দ্র। আর যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে রেললাইন। ঠিক হল – ১। পুলিশ অস্ত্রাগার দখল করা হবে, ২। অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার দখল করা হবে, ৩। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ভবন ধ্বংস করা হবে, ৪। ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হবে, ৫। চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং ৬। বিদ্রোহের খবর প্রচার করতে হবে। দিন ঠিক হল এপ্রিল ১৮, ১৯৩০। এই দিনটিকে বেছে নেবার কারণ ছিল ওইদিন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। সেবারের বিপ্লব ব্যর্থ হলেও পরে ইমন ডি. ভ্যালেরার নেতৃত্বে আয়ারল্যান্ড ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে সফল হয়। সেই দিনটাও ছিল গুড ফ্রাইডের দিন। এবারেও ১৮ তারিখ গুড ফ্রাইডে। সেদিন সমস্ত ইউরোপীয়রা ব্যস্ত থাকবে সেই দিবস  উদযাপনে, স্বাভাবিক ভাবেই পাহা্রা সেদিন শিথিল থাকবে। ফলে ধরেই নেওয়া হল যে সেই দিনটিতে জয় হবে অনিবার্য।

উড়িয়ে দেওয়া হল রেললাইন

 

আরও পড়ুন
মোহে রং দে মেরা বাসন্তী চোলা

১৮ তারিখ সকালে সবাইকে জেলা কংগ্রেস অফিসে সমবেত হতে বলা হল। সবার পরণে ধুতি আর হাফ স্লিভ শার্ট, তার নিচে খাঁকি হাফপ্যান্ট আর জামা – সেগুলিই হবে অ্যাকশনের সময়কার ইউনিফর্ম। কাউকেই অপারেশনের সময় এবং দায়িত্ব আগে থেকে বলা হয়নি। শুধু নেতৃত্ব জানতেন কাকে কী দায়িত্ব পালন করতে হবে আর তাঁদের দলে কে কে থাকবেন।

আরও পড়ুন
সার্ফরোসি কি তামান্না আব হামারে দিল মে হ্যায়

সিদ্ধান্ত হল, এই কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হবার পর শহরের সমস্ত বন্দুকের দোকান ও ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক দখল করা হবে। শহর দখল করে কাছাড়ি পাহাড়ে ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা’র পতাকা উত্তোলন, প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সেই সররকারের প্রধান হিসাবে মাস্টারদা সূর্য সেনের নাম ঘোষণ করা হবে। এর সাথে ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সহ সমস্ত সরকারি আধিকারিকদের গ্রেপ্তার করে তাদের গণবিচার হবে।

আরও পড়ুন
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

একদিকে যখন গোপনে বিল্পবের প্রস্তুতি চলছিল অন্যদিকে তখন প্রকাশ্যে কংগ্রেসের আহ্বানে লবণ আইন অমা্ন্য কর্মসূচীর প্রচার করে পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া হল।

আরও পড়ুন
হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন

১৮-ই এপ্রিল, ১৯৩০। দিনটা ছিল গুড ফ্রাইডে। সন্ধ্যার অন্ধকারে ধুম রেলস্টেশনে লাইনচ্যুত হল মালবাহী ট্রেন। বিপ্লবীরাই খুলে রেখেছিল লাইনের ফিসপ্লেট। চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে একটা টিলার ওপরে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস। অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে অফিসের যন্ত্রাংশে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। ধ্বংস হয়ে গেল একটি গুরুত্বপূর্ণ  যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর ওইদিকে পরিকল্পনামাফিক নাঙ্গলকোট রেলস্টেশনের কাছেও রেললাইনে উড়িয়ে দেওয়া হল।

রাত তখন দশটা।  গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ’এর দল হাজির হলেন পুলিশ লাইনে। তাঁদের পরণে খাঁকি ইউনিফর্ম, কাঁধে মিলিটারি ইনসিগনিয়া, হাতে অস্ত্র। তাঁদের দেখে সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদাধিকারী মনে করে গেটের সেন্ট্রি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের স্যালুট জানাল। গর্জে উঠল অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষের রিভলবার। নিহত হল গেটের সেন্ট্রি রমণী চক্রবর্তী। আরো দুজন সেন্ট্রি জয়করণ ও শীতল দুবে ‘ভাগ যাও, আভি গান্ধী রাজা হো গায়া’ বলে চিৎকার করতে করতে  পালাতে গিয়ে বিপ্লবীদের গুলিতে আহত হল। ওখানে পুলিশ ব্যারাকে তখন ৬০০-র মতো পুলিশের বাস। ’ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ ও ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি এবং সান্ত্রীদের চিৎকার শুনে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মনে হল যেন চারপাশ থেকে শত সহস্র কন্ঠ হুঙ্কার ছাড়ছে। সেই শ্লোগান শুনে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল, পুলিশের দল ব্যারাক ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে আশেপাশের পাহাড়ে-জঙ্গলে লুকালো। খুব সহজেই পুলিশ অস্ত্রাগার দখলে চলে এল। অস্ত্রাগার থেকে রাশি রাশি মাস্কেট্রি রাইফেল, রিভলবার, পিস্তল ও কার্তুজের দখল নেওয়া হল। ওখানেই রাইফেল চালাবার একপ্রস্থ মহড়া হয়ে গেল। এরপরেই পুলিশ লাইনের মাথা থেকে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলে সেখানে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি হিসাবে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন মাস্টারদা। এরপর শপথবাক্য পাঠ করে চট্টগ্রামকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করলেন মাস্টারদা। ওখানে উপস্থিত সবাই ভারতীয় পতাকাকে স্যালুট জানিয়ে সামরিক কায়দায় নিজ নিজ বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ল। 

চট্টগ্রাম ইউরোপীয়ান ক্লাব

 

রাত দশটায় অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার আক্রমণ করা হল নির্মল সেন ও লোকনাথ বলের নেতৃত্বে। মেজর ফোরেল নিহত হলেন। মৃত্যু মুখে মেজর ফোরেল স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন “ডার্লিং রিং আপ দি পুলিশ স্টেশন”। কিন্তু কীভাবে যোগাযোগ করা যাবে পুলিশের সঙ্গে, টেলিফোন ভবন তো ততক্ষণে পুড়ে ছাই। এরপর দখল করা হল অস্ত্রাগার। এখানে শুধুমাত্র মাস্কেট্রি রাইফেল বা রিভলবারই নয় পাওয়া গেল অসংখ্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল যা থেকে পরপর দশটি গুলি ছোঁড়া যায় আর অত্যাধুনিক লুইস মেশিনগান কিন্তু পাওয়া গেল না একটিও কার্তুজ। এইসময়ে আবারও বাধা এল। সেখানে হাজির হল সার্জেন্ট ব্ল্যাকবার্ন সহ তিন ইংরেজ অফিসার। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রাণ দিতে হল বিপ্লবীদের হাতে। সেইদিন অক্সিলিয়ারি আর্মারির অপারেশনে ব্রিটিশ পক্ষের সর্বমোট ছয়জন প্রাণ হারান। শুধুমাত্র রাইফেল  লুঠ করা বেকার মনে করে সিদ্ধান্ত হল ওই অস্ত্রাগার পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। সেইমতো আগুন লাগাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হলেন হিমাংশু সেন আর তাঁকে বাঁচাতে গাড়ি নিয়ে শহরের দিকে রওনা দিলেন অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, জীবন ঘোষাল এবং আনন্দ গুপ্ত।

ইতিমধ্যে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধস্বরূপ ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সেখানে ইউরোপীয়দের হত্যা করার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেটা ব্যর্থ হল। জানা গেল সেদিন গুড ফ্রাইডে বলে ক্লাব বন্ধ। 

এরপর সবকটা দল এসে পরিকল্পনামাফিক জড়ো হল পুলিশ লাইনে। শুধু অনন্ত সিংহ’রা যথাসময়ে ফিরলেন না। ফলে বদলে ফেলতে হল অনেকগুলি কর্মসূচি। শহর আক্রমণ করা, ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক দখল করা, জেলখানা দখল করে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া – সব বাতিল করতে হল। সবাই এরপর মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবার শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁরা গেরিলা পদ্ধতি গ্রহণ করবেন, আশ্রয় নেবেন পাহাড়ের কোলে। সেই মতো তাঁরা পাহাড়শ্রেণির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

সেদিন রাত্রে ব্যরাক ছেড়ে যে সমস্ত পুলিশ পালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে পড়েছিল তিনদিন পরে বিভিন্ন ঝোপজঙ্গল আর পাহাড়ের কোল থেকে তাদের বের করে আনা হয়েছিল। তখনও পর্যন্ত সেইসব পুলিশ গোপন আশ্রয় ছেড়ে বেরোতে সাহস পায়নি। ক্ষুধা-তেষ্টা সব ভুলে তারা ভীত অবস্থায় তখনও লুকিয়ে ছিল। ওইদিকে তখন পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট, জেলাশাসক এবং অন্যান্য উচ্চ-পদাধীকারীরা বুঝতে পারছিলেন যে সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটেছে কিন্তু টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে যাবার কারণে কেউ কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। আবার বাইরেও কোনো খবর পাঠানো যাচ্ছিল না। অবশেষে জেলা শাসক হাতে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে সেখানে নোঙর করা জাহাজের টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাইরের উচ্চ-পদাধিকারীদের কাছে চট্টগ্রামের খবর পাঠাতে পেরেছিলেন।

Powered by Froala Editor