মোহে রং দে মেরা বাসন্তী চোলা

‘কালাপানি আন্দামান’— ৩৪
আগের পর্বে

৮ এপ্রিল, ১৯২৯ সাল। লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলিতে সেদিন ঘোষিত হবে ‘পাবলিক সেফটি বিল’। যে আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা যাবে সন্দেহভাজন যে কাউকেই। সেদিন দর্শকদের ভিড়ে মিশে ছিলেন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত। স্যার জর্জ শ্যুস্টারকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়লেন তাঁরা। তারপর স্বেচ্ছা ধরা দিলেন পুলিশের কাছে। বিচারে দু’জনেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। জেলে গিয়ে রাজবন্দির মর্যাদার দাবিতে অনশন শুরু করলেন দু’জনেই। সঙ্গে যোগ দিলেন যতীন দাস-সহ অন্যান্য বিপ্লবীরাও। সেই আন্দোলন ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলল দেশজুড়ে। তবে যতীন্দ্রনাথ মারা গেলেন ৬৩ দিন অনশনের মাথায়। অন্যদিকে পুনরায় শুরু হল ভগৎ সিং-এর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর সেই মামলার রায় প্রকাশ হল। ভগৎ সিং, সুকদেব এবং রাজগুরুর ফাঁসির রায় দিল আদালত। তারপর…

ভগৎ সিং, সুকদেব এবং রাজগুরুর ফাঁসির আদেশে সারা দেশের মানুষ বিশেষত যুবসমাজ উত্তাল হল। লাহোরের রাস্তায় দুই লক্ষ লোকের বিক্ষোভ মিছিল হল এই রায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে। লাহোর সহ বিভিন্ন শহরে হরতাল পালিত হল।  ‘ভগৎ সিং, সুকদেব, রাজগুরু জিন্দাবাদ’ শ্লোগানে উত্তাল হল সারা দেশ।  

লাহোর সেন্ট্রাল জেলের বাইরে থাকা ভগৎ সিংয়ের কমরেডরাও চুপচাপ বসে ছিলেন না। তাঁরা তখন ছক কষছেন কীভাবে জেলের দেয়াল ভেঙে ভগৎ সিং, সুকদেব ও রাজগুরুকে উদ্ধার করা যায়। বিশ্বনাথ বৈশম্পায়ন, সুখ দেশরাজ এবং ভগবতীচরণ ভোরা এই বড়ো ঘটনাটি ঘটানোর দায়িত্বে আছেন। কিন্তু এই ছক আর দিনের আলো দেখতে পেল না। রবি নদীর তিরে বোমার পরীক্ষা করতে গিয়ে একটি বোমা ফেটে গেল এবং সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে ভগবতীচরণ ভোরার মৃত্যু ঘটল।

সবার চোখ তখন গান্ধীজির দিকে। গান্ধীজি যদি তাঁদের বাঁচাতে পারেন। সামনেই গান্ধীজির সঙ্গে ভাইসরয় আরউইন’এর চুক্তি সই হবার কথা। এই সু্যোগে সবাই আশা করল যে গান্ধীজি যদি আরউইনকে অনুরোধ করেন তাহলে হয়তো মাত্র ২৩ বছর বয়সে ভগৎ সিং এবং তাঁর কাছাকাছি বয়সের অন্যান্য তরুণদের, বীর বিপ্লবী সুকদেব এবং রাজগুরুর প্রাণরক্ষা হতে পারে। গান্ধীজির সঙ্গে ভগৎ সিংদের ফাঁসি কার্যকরী হবার চারদিন আগে ১৯ মার্চ, ১৯৩১-এ যেদিন গান্ধী-আরউইন চুক্তি নিয়ে আলোচনা হল সেদিন সম্পর্কে আরউইন বললেন,

“তিনি (গান্ধীজি) তাঁদের ফাঁসির আদেশ ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারে কোনো সওয়াল করেননি। তিনি শুধু কিছুদিনের জন্য ফাঁসি বিলম্ব করতে বলেছিলেন। তিনি শুধু বলেছিলেন যে, যে দিনটিতে তাঁদের ফাঁসি হবার কথা সেইদিন করাচিতে (কংগ্রেসের) নতুন সভাপতির আসার কথা। কিন্তু সবাই যদি সেদিন ভগৎ সিংদের নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে…… আমি তাঁকে বলি আমি অধীর আগ্রহে এই মামলার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করেছি কিন্তু এমন কিছু পাইনি যাতে আমার বিবেক তাঁদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে সাড়া দিতে পারে।…… তিনি আমার এই যুক্তির জোরকে প্রশংসা করে আর (এই সম্পর্কে) কিছু না বলে ফিরে গেলেন।”

আরও পড়ুন
সার্ফরোসি কি তামান্না আব হামারে দিল মে হ্যায়

৭ মার্চ, ১৯৩১-এ দিল্লীতে গান্ধীজি এক জনসভা করতে এলে সেখানে তাঁকে ভগৎ সিংদের ফাঁসির জন্য দায়ী করে লিফলেট বিলি করা হয়। ২০ মার্চ, ১৯৩১। দিল্লীর আজাদ ময়দানে এক জনসভায় সুভাষচন্দ্র বসু ভগৎ সিংদের ফাঁসির আদেশ রদ করার দাবি তোলেন। পরবর্তীতে কংগ্রেসের ভেতরেই ব্যাপকভাবে সমালোচিত হলেন গান্ধীজি। ২৩ মার্চ, ১৯৩১। অভাবনীয়ভাবে নির্ধারিত দিনের ছয়দিন আগেই ভগৎ সিংদের ফাঁসি হয়ে গেল। যে দিনটি আসলে নির্ধারিত ছিল সেই ২৯ মার্চ, ১৯৩১ করাচিতে কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি বল্লভভাই প্যাটেলকে নিয়ে এক শোক মিছিল করা হল। সুভাষচন্দ্র বসু খেয়াল করলেন যে কংগ্রেসে উপস্থিত তরুণ-যুবকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। তাঁরা প্রত্যেকে হাতে কালো রঙের রিস্টব্যান্ড পরেছে এবং তাঁদের স্থির বিশ্বাস যে গান্ধীজি ভগৎ সিংদের বাঁচাবার জন্য যথেষ্ট সচেষ্ট হননি। তিনি যদি চুক্তি থেকে পিছিয়ে আসতেন তাহলে আরউইন বাধ্য হতেন ভগৎ সিংদের ফাঁসির আদেশ রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে। কংগ্রেস সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এবং কংগ্রেস কর্মীদের বিরূপ ধারণা পালটাতে কংগ্রেস থেকে নানারকম চেষ্টা করা হল কিন্তু সাধারণ মানুষের ধারণা যে খুব একটা বদলালো সেকথা বলা যায় না।

আরও পড়ুন
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

২৩ মার্চ, ১৯৩১। বিকেল তখন প্রায় চারটে। এইসময় বন্দিরা সাধারণত সেলের বাইরেই থাকে, সন্ধ্যা নামলে পরে তাঁরা যে যার কুঠুরিতে ফিরে যায়। ওয়ার্ডেন ছারাত সিং হুকুম দিলেন, সবাই যে যাঁর সেলে ফিরে যাও। বন্দিরা অবাক। কিন্তু ছারাত একবগগা। বললেন, “ওপরওয়ালার হুকুম”। সবাই যে যার কুঠুরিতে বন্দি হল।  জেলের নাপিত বরকত প্রত্যেক কুঠুরিতে গিয়ে ফিসফিস করে খবর দিল যে আজ রাতেই ভগৎ সিং, সুকদেব আর রাজগুরুর ফাঁসি হবে। বন্দিরা সবাই জানতেন যে ওঁদের মৃত্যু অবধারিত কিন্তু তা যে এমন আচমকা ঘটতে চলেছে তা কেউই ভাবতে পারেননি। হেড ওয়ার্ডেন ছারাত সিং এই ১৪ নম্বর সেলের ‘ফাঁসিকা কোঠি’তে থাকা ভগৎ সিংকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ছয়মাস আগে ভগৎ সিংদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। ভগৎ সিং একা সেলে দিন গোণেন আর পড়াশুনা করেন। তাঁর কাছে লুকিয়েচুরিয়ে অনেক বই আসে। ছারাত সিং দেখেও না দেখার ভান করেন। দ্বারকা দাস লাইব্রেরি থেকে তাঁকে বই এনে দেন তাঁর ভাই কুলবীর। তাঁর পড়ার নেশার সঙ্গে তাল রাখতে পারে না লাইব্রেরি। কী মারাত্মক খিদে তাঁর বই পড়ার! তিনি তাঁর নির্জন কুঠুরিতে বসে পড়ে ফেলেছেন, Karl Liebknecht-এর Militarism, লেনিনের Left-Wing Communism, বার্ট্রান্ড রাসেলের Why Men Fight এবং সিনক্লেয়ারের The Spy.  ভগৎ সিংয়ের উকিল, প্রাণনাথ মেহতা ফাঁসি হবার ঘন্টা দুয়েক আগে কোনোভাবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা করার অনুমতি পেলেন। ভগৎ সিং তাঁকে দেখে  জিজ্ঞাসা করলেন যে বইটি আনার কথা বলা হয়েছিল, তা তিনি সঙ্গে করে এনেছেন কিনা। মেহতা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন The Revolutionary Lenin. বইটি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভগৎ সিং তা গোগ্রাসে গিলতে থাকলেন। মেহতা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর শেষ কী কথা বলার আছে? বই থেকে চোখ না সরিয়ে ভগৎ সিং বললেন, “শুধু  দুটি বার্তা – ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ এবং ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। মেহতা যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি এখন কীরকম অনুভব করছেন, ভগৎ সিং উত্তর দিলেন, “সবসময়ের মতোই খুশি”। শেষে যখন মেহতা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন  যে তাঁর কোনো শেষ ইচ্ছে আছে কিনা, ভগৎ সিং বললেন, “হ্যাঁ, আমি এই দেশেই আবার জন্ম নিতে চাই যাতে আমি  দেশের সেবা করতে পারি”। ভগতের সঙ্গে দেখা করে মেহতা সুকদেব ও রাজগুরুর সঙ্গেও দেখা করলেন। মেহতা তাঁদের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে যাবার ঠিক পরেই তাঁদের কাছে খবর এল যে আগামিকাল সকালে নয়, আজ সন্ধ্যা সাতটায় তাঁদের ফাঁসি হবে। ভগৎ সিং তখন মন দিয়ে সদ্য হাতে পাওয়া বইটি পড়ছিলেন। খবরটি শুনে আক্ষেপ করে শুধু বললেন, “তোমরা কি আমাকে বইটির একটা পরিচ্ছদও শেষ করতে দেবে না?”

আরও পড়ুন
হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন

জেলের ঘড়িতে সন্ধ্যা ছ’টার ঘণ্টা বাজল। সমস্ত সেলের বন্দিরা কান খাড়া করে আছে। ভেসে এল ভারী বুটের আওয়াজ। প্রথমে তাঁদের কানে ভেসে এল সেই পরিচিত গান – “সার্ফরোশি কি তামান্না আব হামারা দিল মে হ্যায়...।।” এরপরেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে জোর আওয়াজ উঠল, ‘’ইনকিলাব জিন্দাবাদ’’ এবং “হিন্দুস্তান  আজাদ হো’’। সারা জেলের সমস্ত বন্দিরা সমবেত কন্ঠে গান ধরল, “মোহে রং দে মেরা বাসন্তী চোলা…”।

আরও পড়ুন
স্বরাজ ভাবনার পুনরুত্থান

তিনজন বীর বিপ্লবী হাতে হাতকড়া বাঁধা, পেছনে পাহারাদার নিয়ে চলেছেন ফাঁসি মঞ্চের দিকে। তাঁরা তিনজন একসঙ্গে গাইছেন,

কাভি উও দিন ভি আয়েগা
কে যাব আজাদ হাম হোঙ্গে
ইয়ে আপনি হি জমিন হোগি
ইয়ে আপনা আশমান হোগা
শহীদো কি চিতাও পর
লাগেঙ্গে হরবার মেলে
ওয়াতান পর মরনে ওয়ালো কা
ইয়েহি নাম-ও-নিশান হোগা।

ফাঁসির আগে তিনজনকে ওজন করা হল। দেখা গেল প্রত্যেকের ওজন বেড়েছে। তাঁদের শেষ স্নান সেরে ফেলতে বলা হল। স্নানের পর তাঁদের কালো রঙের পোশাক পরানো হল। তাঁদের মুখ খোলা। ছারাত সিং ভগতের কানে কানে ‘ওয়াহে গুরু’র নাম নিতে বললেন। ভগৎ সিং বললেন, “আমি জীবনে কোনোদিন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিনি। বরং বেশিরভাগ সময় আমি মানুষের গরিবির জন্য তাঁকে গালাগালি করেছি। এখন আমি যদি তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তিনি আমাকে বলবেন, এটা একটা কাপুরুষ যে তার শেষের সময় আগত বলে আমার কাছে ক্ষমা চাইছে।”

ফাঁসির মঞ্চে তিনজন আলাদা আলাদা কাঠের তক্তায় দাঁড়ালেন পাশাপাশি। ভগৎ সিং ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এবার তাঁর মায়ের শেষ ইচ্ছামতো জীবনের শেষ শ্লোগান তুললেন, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ।” ফাঁসুড়ে একে একে তিনজনের গলায় ফাঁসির দড়ি পরালো। এখন তাঁদের প্রত্যেকের হাত-পা বাঁধা। তাঁরা ফাঁসির দড়িকে চুম্বন করলেন। ফাঁসুড়ে তাঁদের  জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মধ্যে আগে কে যেতে চাও? সুকদেব বললেন যে তিনিই আগে যেতে চান। এরপর ফাঁসুড়ে একে একে তিনজনের গলার ফাঁসির দড়িতে টান দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পায়ের তলায় কাঠের পাটাতনটিকে লাথি মেরে সরিয়ে দিল। পরপর পাশাপাশি তিনজন শহিদ  বহুক্ষণ ধরে দড়িতে ঝুলতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত জেলের একজন ডাক্তার একে  একে তাঁদের দেহগুলিকে দড়ি খুলে নামিয়ে এনে মাটিতে শোয়ালেন। এরপর নিয়ম অনুযায়ী দেহ শনাক্তকরণের পালা। একজন জেল আধিকারিক এই তিনজনের বীরত্বে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে তিনি এঁদের শনাক্ত করতে অরাজি হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সাসপেন্ড হলেন। একজন জুনিয়ার অফিসার এঁদের শনাক্ত করলেন। এরপর দুজন ব্রিটিশ অফিসার, তাঁদের মধ্যে একজন জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, তাঁরা মৃতদের সার্টিফিকেটে সই করলেন।

এবার এই মৃতদেহগুলিকে নিয়ে কী করা হবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়লেন জেল কর্তৃপক্ষ। জেলের বাইরে তখন প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছে। জেলের ভেতরে এঁদের দাহ করা হলে সেই ধোঁয়া ওপরে উঠে সবার নজর টানবে। এরপর  যদি  বড়ো কোনো গোলামাল হয় তা সামলানো খুব মুশকিল হবে। অনেক ভেবে তাঁরা জেলের পেছনের দেয়ালে গর্ত করে একটা ট্রাকে মাল তোলার মতো মৃতদেহগুলিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলল তারপর সেনা পাহারায় অত্যন্ত গোপনে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রথমে রবি নদীর তীরে নিয়ে গেল, সেখানে নদীর জল অগভীর থাকায় মৃতদেহগুলি দাহ করার জন্য ফিরোজপুরে শতদ্রু নদীর তীরে নিয়ে গেল। লরি থেকে নামিয়ে দেহগুলিতে আগুন ধরিয়ে দিল। কাছেই গন্ধা সিংওয়ালা গ্রাম। সেখান থেকে মানুষজন দেখতে পেল যে নদীর তীরে আগুন জ্ব্লছে। তারা ছুটে গেল সেইখানে। তাদের দেখেই সেনারা দৌড়ে  নিজেদের গাড়িতে উঠে লাহোরের দিকে পালিয়ে গেল। এরপর গ্রামের লোকেরাই তাঁদের বীরদের মর্যাদার সঙ্গে শেষকৃত্য সম্পন্ন করল।

সারা লাহোর এবং পাঞ্জাবের অন্যান্য শহরে ভগৎ সিং’দের ফাঁসির খবর ছড়িয়ে পড়তে সারা শহর যেন রাস্তায়  নেমে এল। পরদিন বড়ো বড়ো মিছিল বেরোতে শুরু করল। সারা শহর জুড়ে হরতালের চেহারা। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। সমস্ত স্কুল কলেজ বন্ধ। দুপুরে সরকারিভাবে জানানো হল যে ভগৎ সিং, সুকদেব ও রাজগুরুকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে হিন্দু ও শিখ প্রথায় দাহ করা হয়েছে। নিলাগোম্বাদ থেকে এক বিশাল শোক মিছিল শুরু হল। হাজার হাজার হিন্দু, মুসলমান, শিখ – তিন মাইল লম্বা সেই মিছিলে যোগ দিল। পুরুষদের হাতে কালো ব্যান্ড বাঁধা, মহিলাদের পরণে কালো শাড়ি, মুহুর্মুহু শ্লোগানে কেঁপে উঠছে শহর – ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং ‘ভগৎ সিং জিন্দাবাদ’। এই বিশাল মিছিল আনারকলি বাজারে এসে থামল। সেখানে ভগৎ সিংয়ের পরিবার ফিরোজপুর থেকে তিন শহিদের পবিত্র ভস্ম সংগ্রহ করে এনেছেন। তিনঘন্টা পর তিনটি কফিন মালা দিয়ে সাজিয়ে আবার বিশাল মিছিল শুরু হল।

ওয়ার্ডেন ছারাত সিং কোনোমতে তাঁর বিদ্ধস্ত মন নিয়ে নিজের শরীরটাকে টানতে টানতে বাড়ি ফিরলেন। তাঁর কর্মজীবনের তিরিশ বছরে অনেককে ফাঁসিতে যেতে দেখেছেন, কিন্তু কখনই তাঁর এমন খারাপ লাগেনি। এই ক’দিনের মধ্যে তিনজনের প্রতি কি ভীষণ মায়া পড়ে গিয়েছিল! বাড়ি ফিরে এই প্রথম কান্নায় ভেঙে পড়লেন ছারাত সিং।

Powered by Froala Editor