‘কালাপানি’ আন্দামান — ৩০
আগের পর্বে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে গড়ে উঠল সম্প্রীতির আবহাওয়া। মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি তার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে খলিফার অধিকারের দাবিতে মুসলমানরা শুরু করলেন খিলাফত আন্দোলন। এই সুযোগে ১৯১৯ সালে গান্ধীজিও অসহযোগিতার কর্মসূচি নিলেন। ১৯২০ সালে বিলিতি পণ্য বয়কটের ডাক দিলেন তিনি। সঙ্গে শুরু হল আইন অমান্য আন্দোলন। মূলত কৃষকরাই ছিলেন এই আন্দোলনের মূল শক্তি। এরই মধ্যে ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গোরক্ষপুরের চৌরিচৌরায় ঘটে গেল একটি নৃশংস ঘটনা। ২২ জন ব্রিটিশ পুলিশকে জ্বলন্ত পুড়িয়ে মারা হলে গান্ধীজী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। জনপ্লাবনের ঢেউ খানিকটা স্তিমিত হতেই ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে তাঁকে। তারপর…
গান্ধীজি জেলে গেলেন। লেজিসলেটিভ কাউন্সিল বয়কট করার প্রশ্নে কংগ্রেসে বিভাজন তৈরি হল। কংগ্রেসের একটি অংশ যার নেতৃত্বে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু এবং আজমল খান, তাঁরা বলছেন প্রতিনিধিদের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ফিরে যাওয়া উচিত। তাঁদের যুক্তি ছিল লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দান হিসাবে ব্যবহার করে সেখানেই সরকারের মুখোশ খুলতে হবে। এঁরা পরিচিত হলেন পরিবর্তনকামী হিসাবে। অন্যদিকে সি. রাজাগোপালাচারি, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং এম. এ. আনসারি ছিলেন স্থিতিশীলতার পক্ষে। এঁদের মতে কাউন্সিল বর্জন করা চলুক, তার বদলে অসহযোগিতার মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করা হোক এবং যে আইন অমান্য আন্দোলনের প্রক্রিয়া বর্তমানে স্থগিত করা হয়েছে ভবিষ্যতে তা পুনরায় শুরু করার জন্য নীরবে প্রস্তুতি নেওয়া হোক। ডিসেম্বর, ১৯২২ – গয়া কংগ্রেসে পরিবর্তনকামীদের প্রস্তাব ভোটাভুটিতে পরাজিত হলে চিত্তরঞ্জন দাশ এবং মতিলাল নেহেরু যথাক্রমে কংগ্রেসের সভাপতি ও সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করে নতুন দল – ‘কংগ্রেস-খিলাফত স্বরাজ্য পার্টি’ গঠন করেন। নবগঠিত স্বরাজ্য পার্টির সভাপতি হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ এবং মতিলাল নেহেরু হলেন অন্যতম সম্পাদক।
ফেব্রুয়ারি, ১৯২৪। স্বাস্থ্যের কারণে গান্ধীজি জেল থেকে ছাড়া পেলেন। তিনি প্রথমে স্বরাজীদের সঙ্গে কাউন্সিলে অংশ নেবার বিষয়ে একমত না হলেও পরবর্তী সময়ে তা মেনে নিলেন। ইতিমধ্যে ১৯২৩-এ সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে স্বরাজ্য পার্টি লিবারেল এবং জিন্নাহ ও মালব্য’র মতো নির্দল সদস্য নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল। গান্ধীজি অনুধাবন করলেন যে স্বরাজীরা সরকারের সহগামিতা করছে না। এরপর ১৯২৪-এর শেষ লগ্নে সরকার স্বরাজী এবং বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনলে গান্ধীজি স্বরাজীদের সমর্থন জানালেন। এরপর দুপক্ষের মধ্যে একটা রফা হল যা বেলগাঁও কংগ্রেসে ডিসেম্বর ১৯২৪-এ গৃহীত হল। (এই কংগ্রেসেই একমাত্র একবারের জন্য গান্ধীজি সভাপতিত্ব করেন।) সিদ্ধান্ত হল সরকারি কাউন্সিলগুলিতে স্বরাজীরা কংগ্রেসের অংশ হিসাবে কাজ করবে।
স্বরাজ্য পার্টি গঠন হলে যে সমস্ত রাজনৈতিক কর্মী গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনের পদ্ধতির সঙ্গে একমত না হতে পেরে সরে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা এই নতুন দলে যোগ দিলেন। সরকারি কাউন্সিল ও লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত সদস্যদের একটা অংশ সরকারকে নানা বিষয়ে বিব্রত করতে থাকল। ব্যারিস্টার হিসাবে চিত্তরঞ্জন দাশ, যিনি বিপ্লবীদের হয়ে আলিপুর বোমা মামলা এবং ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা লড়েছিলেন এবং অনেককে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে বিপ্লবীদের যোগাযোগ ছিল। ১৯২০-তে সেলুলার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দেশে ফিরেছেন অনেক বিপ্লবী, তাঁদের নিজস্ব নারায়ণ পত্রিকায় (বারীন এবং উপেন এই পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নিলেন) এবং অন্যান্য নানা জায়গায় কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন তিনি। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হিসাবে প্রথমে চিত্তরঞ্জন দাশ এবং তারপর সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশ কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া বিপ্লবীদের কর্পোরেশনের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত করছেন। আবার বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে, দুর্ভিক্ষের সময়ে স্থাপিত বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী বণ্টনের কেন্দ্রগুলিতে এঁদের নিযুক্ত করা হচ্ছে। কারাগারমুক্ত বিপ্লবীদের স্বাস্থ্য পরিষেবা, স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার সম্পর্কিত প্রচারকার্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যান্য বিপ্লবীরা বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের বিভিন্ন জেলা কমিটিগুলিতে প্রবেশ করে এবার নিজেদের বৈপ্লবিক কর্মসুচি প্রচারের সু্যোগ পেলেন। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দেশের নানা প্রান্তে কংগ্রেসি পরিচয়ে ঘুরে বিপ্লবীরা আবার নিজেরা সংগঠিত হতে লাগলেন। ফেব্রুয়ারি, ১৯২২-এ যখন অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হল তখন গোয়েন্দা শাখার রিপোর্ট অনু্যায়ী বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদীরা পুনরায় তাঁদের শক্তি ফিরে পাচ্ছে এবং ইতিমধ্যে স্থানীয়স্তরে যোগাযোগের সু্যোগ নিয়ে তাঁরা অনেক নতুন মুখকে তাঁদের দলে টানতে পেরেছেন।
এই সময়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যে বিপ্লবীরা পুনরায় সংগঠিত হচ্ছিল। বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে প্রচারের আড়ালে সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ব্রিটিশ শক্তিকে দেশ থেকে হঠাবার জন্য অকাতরে বিভিন্ন ধরনের প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে। এগুলির কোনোটাতে শহিদদের কথা, কোনোটাতে রয়েছে বিপ্লবের কথা। ১৯২৩ এবং ১৯২৪-এ বাংলার গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয় যে বাংলার শহিদদের গাথা প্রচারপত্রের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এরকমই একটি লিফলেটের শিরোনাম ছিল ‘বন্দে বলশেভিকমাতরম’।
আরও পড়ুন
অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলন
আরেকটি লিফলেটের শিরোনাম ছিল ‘লাল বাংলা’। এই প্রচারপত্রের মূল কথা ছিল বিদেশি নিপীড়নকারীদের ওপর আঘাত হানতে হবে। এখানে ‘লাল’ অর্থে নিজের রক্ত দিয়ে আত্মত্যাগের কথা বলা হলেও স্থানীয় সরকারি কর্মচারীরা লাল অর্থে কমিউনিস্ট জুজু দেখতে শুরু করলেন। এই লিফলেটটি কলকাতা এবং ঢাকাতে ভালোভাবে প্রচারিত হয়েছিল। আরেকটি লিফলেট সেই সময় মূলত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তরুণদের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল। এর নাম ছিল ‘উঠো, জাগো’ এই লিফলেটটিতে বলা হল সেইসব তরুণদের কথা যাঁরা ইতিমধ্যে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড – রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি
ইতিপূর্বে ১৯২০-তে আর্য্য পাবলিসিং হাউস গঠন করে বারীন ঘোষ প্রকাশ করেছেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাসিতের আত্মকথা, সেই বই থেকে বেশ কিছু অংশ উদ্ধৃত করে নিজ সাহিত্যগুণে মহিমান্বিত করে লিখে ফেলেছেন দ্বীপান্তরের কথা এবং তার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন উল্লাসকর দত্তের কারাজীবনী।
আরও পড়ুন
জাতীয়তাবাদের উত্থান
১৯২০ সাল থেকেই এই বিপ্লবীদের আত্মজীবনী বেরোতে শুরু করলে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে তা উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। বছর দুই-তিনেকের মধ্যে এগুলি নিষিদ্ধ করা হয়। ইতিমধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গবাণী’তে ধারাবাহিকভাবে উপন্যাস ‘পথের দাবী’ লিখতে শুরু করলেন। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সব্যসাচীকে গড়ে তুললেন সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী একজন বিপ্লবীর আদলে। এই উপন্যাসের দুই মহিলা চরিত্র – ভারতী মনে করেন যে ব্রিটিশদের থেকে খারাপ আর কিছু হয় না এবং আরেকজন, সুমিত্রা মধ্যবিত্ত মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশে মগ্ন থাকেন। তনিকা সরকারের মতে, এই উপন্যাসের মূল কথা হল ব্রিটিশদের এদেশ থেকে জোর করে তাড়াতে না পারলে ভারতের কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না। ১৯২৬-এর আগস্টে ‘পথের দাবী’ বই হয়ে বেরোলে মুহূর্তের মধ্যে পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। ওই বছরই নভেম্বর মাসে বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বইটি সে সময়ের তরুণদের মনে কতটা দোলা দিয়েছিল তা বোঝা যায় বিপ্লবী কমলা দাশগুপ্ত এবং বীণা দাশ, যাঁরা বেথুন কলেজে মহিলাদের নিয়ে দল গঠন করেছিলেন, পরবর্তীকালে বলেন যে ওই উপন্যাস তাঁদের চোখ খুলে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন
বিরামকালে বিরামহীন সেলুলার জেল
১৯২৩ থেকে শুরু করে ১৯২৪-এর প্রথমার্ধ জুড়ে নতুন করে শুরু হল বিপ্লবের প্রস্তুতি। হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে কোনাতে ডাকাতি এবং খুন হল দুজন; মে মাসে হুগলি নদীর ধারে একটি ডাকঘরে স্বদেশী ডাকাত পড়ল; বন্দুক দেখিয়ে আরো দুটি ডাকাতির ঘটনা ঘটল জুলাই মাসে; আগস্টে আরো একটি ডাকঘর লুঠ হল এবং সেই ডাকঘরের পোস্টমাস্টার খুন হল। পরপর আগ্নেয়াস্ত্রসহ ডাকাতির ঘটনায় মালুম হল যে বিপ্লবীরা আগামীদিনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর পরেই কলকাতার ২৬ মির্জাপুর স্ট্রিটে একটি দোকানে এক পুলিশ ইন্সপেক্টরকে লক্ষ করে বোমা ছোঁড়া হল। এই সুত্রে আবিষ্কৃত হল একটি বোমা তৈরির কারখানা। কলকাতার বাইরে চট্টগ্রামে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েতে ডাকাতি হল এবং ফরিদপুরে একজন বোমা বানাতে গিয়ে আহত হলেন। ইতিমধ্যে আন্দোলনের ঠেলায় রাওলাট আইন বাতিল হয়েছে বটে কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই বিপ্লবীদের দমন করতে ‘The Bengal Criminal Law Ordinance and the Amendment Act, 1924’ আনল এবং লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ভারতীয় সদস্যদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ১৯২৪-এর ২৫ অক্টোবর তা চালু করা হল। এই আইনকে হাতিয়ার করে শুরু হল ব্যাপক ধরপাকড়।
Powered by Froala Editor