‘কালাপানি’ আন্দামান -৩
আগের পর্বে
সেলুলার জেলের প্রাকপর্বে সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নেওয়া বন্দিদের জায়গা হয়েছিল আন্দামানের বিভিন্ন দ্বীপে। অকথ্য অত্যাচার, জঙ্গল পরিষ্কার বা নির্মাণের হাড়ভাঙা খাটুনি, বিষাক্ত বিছে-সাপের উপদ্রব আর জারোয়াদের আক্রমণে অনেকেই মারা যান আন্দামানে। একবার দ্বীপান্তরিত হলে দেশে ফেরার কোনো পথ থাকত না বন্দিদের। তবে কয়েদিদের মধ্যে ছিল শ্রেণীবিভাগ। কর্মদক্ষতা, আচরণ প্রমাণ করলে চতুর্থ থেকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকত পুরুষদের। কমত অত্যাচারের মাত্রা।মহিলাদের ক্ষেত্রে ছিল দু'টি শ্রেণী। দশ বছর পেরিয়ে গেলে মিলত আন্দামানের 'স্বাবলম্বন গ্রাম'-এ থাকার অনুমতি। বিবাহের প্রচলনও হয়েছিল কয়েদিদের মধ্যে।
অগাস্ট, ১৮৬৬। সমুদ্রে আবহাওয়া অত্যন্ত খারাপ হবার কারণে মালয়েশিয়ার পেনাঙ থেকে রেঙ্গুন যাবার পথে জাহাজ, ‘ফতে ইসলাম’ মধ্য নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নানকৌড়িতে পাড় থেকে সিকি মাইল দুরে নোঙর করতে বাধ্য হল। কিছুক্ষণের মধ্যে নারকেল, শাকসবজি এবং মাংস নিয়ে কতকগুলি ডোঙা জাতীয় নৌকোতে নিকোবরিরা এসে হাজির হল জাহাজে। তারা এই দ্রব্যসামগ্রীর বদলে তামাক, মদ, কাপড় এবং ছুরি চাইল। এই ধরনের বিনিময় প্রথা ওই বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলিতে অনেকদিন ধরেই চলছিল।
চারদিন কেটে গেছে। ওখানে আবহাওয়ার কারণে তখনও জাহাজটি দাঁড়িয়ে আছে। কতকগুলি ডোঙা নিয়ে জনা তিরিশেক নিকোবরি এগিয়ে এল জাহাজের দিকে। তাদের প্রধান জাহাজে উঠে গেল ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলতে। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে সে ডোঙায় অপেক্ষারত তার সঙ্গীদের কাছে মুখের পাইপ ধরাবার জন্য আগুন চাইল। একটা মোটা বাঁশের ডগায় করে তার জন্য আগুন এল। প্রধান সেই আগুন দিয়ে তার ঠোঁটে চেপে রাখা বাঁশের পাইপে তামাক ধরাল। এরপর হঠাৎই সেই বাঁশ দিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের মাথায় মারল এক বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে ডোঙাগুলি থেকে তার সঙ্গীরা জাহাজে উঠে এল এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিরের আঘাতে ও বর্শার ফলায় জাহাজের যে সমস্ত নাবিকদের সামনে পেল তাদের হত্যা করল। তারা যখন নিশ্চিন্ত হল যে এই জাহাজের সব ক’জন নাবিককে মেরে ফেলা হয়ে গেছে তখন তারা সমস্ত জাহাজ তছনছ করে লুঠপাঠ চালাল। এরপর জাহাজ ছেড়ে তারা ফিরে গেল তীরে।
জাহাজে হত্যালীলা চললেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিল তিনজন নাবিক। তারা জাহাজের নানা জায়গায় লুকিয়ে নিকোবরিদের চোখকে ফাঁকি দিতে পেরেছিল। এরপর তারা সেই রাতেই রওনা দিয়ে খুব কষ্ট করে পেনাঙ বন্দরে এসে পৌঁছাল। এই মর্মান্তিক খবর পেয়ে জুন, ১৮৬৭-তে একটি ব্রিটিশ জাহাজ ‘এইচএমএস ওয়াস্প’ এই বিষয়ে খোঁজখবর চালাতে নিকোবরে পৌঁছাল। নানকৌড়িতে পৌঁছে জাহাজের ক্যাপ্টেন বেডিংফিল্ড দেখলেন যে সেখানে আরো দুটি জাহাজ নিকোবরিদের সাথে বিনিময় বাণিজ্য করছে। সেই জাহাজগুলির একটির ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে বেডিংফিল্ড জানতে পারলেন যে ওই দ্বীপগুলিতে অনেক ইউরোপীয় মহিলাকে নিকোবরিরা বিভিন্ন জাহাজ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে।
নানকৌড়ি থেকে চুপচাপ ফিরে গেলেন বেডিংফিল্ড। এরপর ১৮৬৭-এর ২২-এ জুলাই ক্যাপ্টেন বেডিংফিল্ড এবং ক্যাপ্টেন এডি’র নেতৃত্বে দুটি জাহাজ ‘ওয়াস্প’ এবং ‘স্যাটেলাইট’ ওই নিকোবরি জলদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য নানকৌড়ি পৌঁছাল। এই জাহাজগুলি এসে দাঁড়াল ট্রিনকেট আইল্যান্ডে এবং জাহাজগুলি থেকে অনেক নৌসেনা নেমে এল তীরে। এদের অস্ত্রশস্ত্র শোভিত হয়ে জাহাজগুলি থেকে নামতে দেখে নিকোবরিরা পালিয়ে গেল গভীর জঙ্গলে।
নিকোবরিদের ছেড়ে যাওয়া ছোটো ছোটো গ্রামগুলিতে গিয়ে সৈন্যরা পেল বহুদিন ধরে লুঠ করা জাহাজের বিভিন্ন জিনিসপত্র, যেমন সিন্দুক, সোফা, কুশন, জাহাজের যন্ত্রপাতির বাক্স, জাহাজ চালনার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি লাগে সেসব এবং জাহাজের নাবিকদের ব্যবহার করা কিছু অস্ত্রশস্ত্র, যা কিনা এরা চালাতেই জানে না। সামগ্রীগুলির বেশিরভাগই এই লুঠেরাদের কাছে কোনো কাজের জিনিসই নয়। সৈন্যরা এই গ্রামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। এবার তারা এগোল নানকৌড়ির দিকে। যাবার পথে তীরে রাখা নিকোবরিদের ডোঙাগুলোতেও আগুন ধরানো হল। স্যাটেলাইট জাহাজে করে মাদ্রাজ সেনাবাহিনীর যে পদাতিক সৈন্যরা এসেছিল তারা নিকোবরিদের বড়ো একটা গ্রাম খুঁজে পেয়ে সেখানে গিয়েও দেখল যে সেই গ্রামে কোনো মানুষ নেই, শুধু জাহাজ থেকে লুঠ করে আনা নানা আবর্জনায় ভর্তি। সৈন্যরা সেই গ্রামেও আগুন ধরিয়ে দিল। সেখানেই একজন সেনা একটি বই পেল – The Struggles and Adventures of Christopher Tadpole. বইটির প্রথম ফ্লাইলিফে একটি মেয়েলি হাতে লেখা – ‘When shall we meet again? Perhaps never!” সৈন্যদের হাতে এবার ধরা পড়ল কিছু নিকোবরি। তাদের কাছ থেকে জানা গেল যে একটি ছোটো মেয়ে ছাড়া সমস্ত বিদেশি মহিলাদের মেরে ফেলা হয়েছে। ওই বাচ্চা মেয়ে ও তার মা’কে একটা ফরাসি জাহাজ থেকে লুঠ করে আনা হয়েছিল। সেই মেয়েটির মাকেও মেরে ফেলা হয়েছে। বাচ্চা মেয়েটি আছে নানকৌড়ি দ্বীপের প্রধান, আছিয়াপ’এর কাছে।
বেডিংফিল্ড এবং এডি ঠিক করলেন যে ওই মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে। ধৃত নিকোবরিদের মধ্যে দু’জনকে পাঠানো হল আছিয়াপের কাছে। তাদের মাধ্যমে হুঁশিয়ারি দেওয়া হল যে কালকের মধ্যে যদি মেয়েটিকে না ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে বাকি গ্রামগুলিকেও জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। আছিয়াপ রাজি হল না। এবার তো তাহলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতেই হয়! নানকৌড়ির তীরে যে সমস্ত নিকোবরিদের ডোঙাগুলি ছিল সেগুলিতে এক এক করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। তারপর তিনটি গ্রাম বাদ দিয়ে সবকটা গ্রামে আগুন দেওয়া হল। ইচ্ছে করে আছিয়াপের গ্রামটাকে ছাড় দেওয়া হল। ২৬শে জুলাই আবার দুজন নিকোবরিকে পাঠানো হল আছিয়াপের কাছে। এবার আছিয়াপ মেয়েটিকে ফেরত দিতে বাধ্য হল।
ব্রিটিশরা এবার আছিয়াপকে নানাভাবে তুষ্ট করে জাহাজে আনাল। তার কাছ থেকে কথা চাওয়া হল যে এই পথে জাহাজগুলির ওপর তারা আর হানা দেবে না। আছিয়াপ তখনকার মতো কথা দিল বটে কিন্তু পরে বোঝা গিয়েছিল সবটাই ভাঁওতা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আন্দামানি এই জলদস্যুদের মোডাস অপেরা ছিল – জাহাজ আক্রমণ, সমস্ত নাবিকদের মেরে ফেলা, জাহাজের সব মহিলাদের লুঠ করে নিয়ে আসা, জাহাজ তছনছ করে হাতের সামনে যা পাওয়া যায়, প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তা লুঠ করা এবং শেষে জাহাজ ফুটো করে তা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া।
এরপর নিকোবর ছাড়ার আগে ব্রিটিশ সৈনিকরা নিকোবরিদের শিক্ষা দেবার জন্য ট্রিনকেট এবং কামোর্তার গ্রামগুলি সব জ্বালিয়ে দিল। আর যে সমস্ত নিকোবরিদের তারা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছিল তাদের নানা ধরনের শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দিল।
আন্দামানের এই জলদস্যুরা যে সবসময় নিজেদের ইচ্ছায় জাহাজগুলিতে লুঠপাঠ চালাত তা নয়, এর জন্যে অনেকাংশে দায়ী ছিল নানকৌড়িতে আসা বিদেশি জাহাজের নাবিকেরা। স্বভাবগতভাবে নিকোবরি মহিলারা তাদের দেহের ঊর্দ্ধাংশ আনাবৃত রাখত। জাহাজিরা নিকোবরি মহিলাদের ওইভাবে দেখে তাদের প্রতি যৌন ইঙ্গিত করত এবং হাতের কাছে পেলে তাদের দিয়ে নিজেদের যৌন ক্ষুধা মেটাবার চেষ্টা করত। এই সব সমাজ মূলত চালিত হত মহিলাদের দ্বারা। ফলে মহিলাদের অপমান সহ্য করতে না পেরে নিকোবরিরা বিদেশিদের ঘৃণা করতে শিখেছিল এবং তারই পরিণতিতে জাহাজ লুঠপাঠ। আবার এর জন্যে অনেকসময় দায়ী ছিল মালয়ের অধিবাসীরা। এরা শুকনো সময়ে এই দ্বীপগুলোতে চলে আসত। নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিকোবরিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাত তারপর এদের বিদেশিদের ওপর রাগ উস্কে দিয়ে লেলিয়ে দিত জাহাজ লুঠপাঠের কাজে।
১৮৩৭ থেকে ১৮৬৯ – এই সময়ে নিকোবরি জলদস্যুদের আক্রমণের কবলে পড়ে ২৬টি জাহাজ যার অধিকাংশই ছিল ব্রিটিশ। কিন্তু সেসব কিছুর মধ্যে ‘ফতে ইসলাম’ জাহাজের ওপর জলদস্যুদের আক্রমণ ব্রিটিশ সরকারের টনক নাড়িয়ে দেয় এবং সিদ্ধান্ত হয় নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকেও ব্রিটিশ শাসনের আওতধীনে আনা হবে। সেই সময় দিনেমারদের অধিকারে ছিল নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ১৮৬৮-তে তারা তা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়। এরপর ব্রিটিশরা নিকোবরি সমাজের গ্রাম্য প্রধান এবং গুণিন (মেনলুয়ানা) – তাদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করতে সফল হয়। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলে ১৮৬৯ থেকে ১৮৮৮-এর মধ্যে ওই অঞ্চলে আর কোনো জলদস্যুদের উৎপাত ঘটেনি আর তারপর তা ঘটলেও তাতে নিকোবরিরা আর নিজেদের জড়ায়নি। ইতিমধ্যে তারা মালয় এবং অন্যান্য বিদেশিদের আক্রমণ থেকে ব্রিটিশ সুরক্ষা পেয়ে দস্যুতা ছেড়ে বাণিজ্যে মন দিল এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সফল হল। এখন দেখা গেল যে এদের মতো সৎ, দয়াশীল, উদার হৃদয়সম্পন্ন এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ আর হয় না।
Powered by Froala Editor