‘কালাপানি’ আন্দামান — ২৯
আগের পর্বে
কথা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয়দের হাতে প্রশাসনিক ক্ষমতা তুলে দেবে ব্রিটিশরাজ। তবে হল তার ঠিক উল্টোটা। লাগু হল রাওলাট আইন। যুদ্ধকালীন দমননীতি কড়া হল আরও। এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠল পাঞ্জাব-সহ গোটা ভারত। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন অসংখ্য নিরস্ত্র মানুষ। চালু হয় মার্শাল ল। রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এই ঘটনার প্রতিবাদের আহ্বান জানালেও চুপ করে থাকলেন সকলে। শেষে একাই হাঁটলেন রবীন্দ্রনাথ। ত্যাগ করলেন ব্রিটিশদের দেওয়া নাইট উপাধি। অন্যদিকে এর কিছুদিন পর ‘হিমালয়ান ব্লান্ডার’-এর কারণে অহিংস আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন গান্ধীজি। তবে শান্ত হল না পাঞ্জাব। আন্দোলনকারীরা অনেকে মারা গেলেন পুলিশের গুলিতে। গ্রেপ্তার ৪০০। কেউ কেউ দ্বীপান্তরিতও হলেন। তারপর…
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে একটা সম্প্রীতির আবহাওয়া তৈরি হল। এর ভিত্তিগুলি ছিল – (১) ১৯১৬ লক্ষ্ণৌ চুক্তি – কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে এই চুক্তির ফলে বিভিন্ন রাজ্যভিত্তিক আইনসভাগুলিতে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করে নেওয়া হল; (২) রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হিন্দু এবং মুসলিমদের এক জায়গায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিল; এবং (৩) মহম্মদ আলী জিন্নাহ, আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান এবং হাসান ইমামের মতো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী মুসলিম যুব নেতাদের হাতে মুসলিম লীগের দখল আসাতে তাঁরা অনেক বেশি পরিমাণে জাতীয় আন্দোলনগুলিতে অংশ নিতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে টার্কির সুলতান, যাঁকে সারা মুসলিম বিশ্ব আধ্যাত্মিক নেতা ‘খলিফা’ বলে সম্মান করত, তাঁকে ব্রিটিশরা গদিচ্যুত করল। এর ফলে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় ব্রিটিশদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হল। তাঁরাও বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে একই সুরে দাবি জানাল যে - (১) মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র স্থানগুলির ওপর থেকে খলিফার অধিকার আগেকার মতোই সুনিশ্চিত রাখতে হবে এবং (২) ব্রিটিশ কর্তৃক টার্কির দখলীকৃত জমির কিছুটা অংশ খলিফাকে দিতে হবে। এই দাবিগুলিকে সামনে রেখে মুসলিমরা সারা দেশ জুড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গড়ে তুললেন ‘খিলাফত আন্দোলন’। প্রথম দিকে মিটিং, পিটিশন, বিক্ষোভের মধ্যে আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকলেও নভেম্বর ১৯১৯-এ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সারা ভারত খিলাফত কনফারেন্সে ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কটের ডাক দেওয়া হল। গান্ধীজী তখন খিলাফত কমিটির সর্বভারতীয় সভাপতি। তিনি অনুধাবন করলেন এই সুযোগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার কর্মসুচি শুরু করা যেতে পারে।
গান্ধীজি খিলাফত আন্দোলনকে খুঁটি করে তাঁর সত্যাগ্রহ এবং অসহযোগ আন্দোলনের পরীক্ষা করতে চাইলেও কংগ্রেসে কিন্তু এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন সর্বসম্মত হয়নি। বাল গঙ্গাধর তিলক মুসলিমদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এরকম একটা ধর্মীয় কারণে আন্দোলনে যেতে বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করেছিলেন এবং রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ‘সত্যাগ্রহ’ সম্পর্কে সংশয় পোষণ করেছিলেন। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর কংগ্রেস খিলাফত প্রশ্নে অসহযোগ আন্দোলনের পথে যাবার প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই আন্দোলনের ফলে হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে যেমন ঐক্য ও সম্প্রীতি দৃঢ় হল আবার জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমিক, কৃষক, কারিগর, যুবক, মহিলা এক ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মঞ্চে এক হতে পারল। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের একটা অংশ সাংবিধানিক পথে থেকে লড়াইয়ের ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছিল এবং এটাও বোঝা যাচ্ছিল যে জনতা এখন তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য একটা জায়গা খুঁজছে।
সেপ্টেম্বর, ১৯২০। কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হল – লেজিস্লেটিভ কাউন্সিল ছাড়াও সমস্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত, বয়কট করা হবে, বিলাতি বস্ত্র বর্জন করা হবে এবং তার বদলে হাতে চরকায় বোনা খাদিবস্ত্র ব্যবহার করা হবে এবং সমস্ত ধরনের সরকারি খেতাব-পুরস্কার-সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এর পর প্রয়োজনে আন্দোলনকে আরো সুসংবদ্ধ করে গণ আইন অমান্য আন্দোলনের পথে যাওয়া হবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যকে যারা সরকারি চাকরি করেন তারা চাকরি ছেড়ে দেবেন এবং যারা কর প্রদান করে তারা আর কর দেবে না।
আরও পড়ুন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড – রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি
আলী ভাইদের সঙ্গে গান্ধীজি সারা ভারতবর্ষে আন্দোলন সংগঠিত করতে বেরোলেন। হাজারে হাজারে ছাত্র সরকারি স্কুল-কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে এল। এইসময় প্রায় ৮০০ জাতীয় স্কুল-কলেজ স্থাপিত হল। জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে এলেন আচার্য নরেন্দ্র দেব, চিত্তরঞ্জন দাশ, লালা লাজপত রাই, জাকির হোসেন, সুভাষচন্দ্র বসু। এই সময়ে আলিগড়ে জামিয়া মিলিয়া, কাশী বিদ্যাপীঠ, গুজরাট বিদ্যাপীঠ এবং বিহার বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয়। মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাশ, সি. রাজাগোপালাচারী, সৈফুদ্দীন কিচলু, বল্লভভাই প্যাটেল, আসফ আলী, টি. প্রকাশম এবং রাজেন্দ্রপ্রসাদ আদালত বর্জন করে তাঁদের ওকালতি পেশা থেকে অব্যাহতি নেন। বিলাতি বস্ত্র বর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে নানা জায়গায় বিলাতি বস্ত্র গাদা করে জনসমক্ষে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এসবের ফলে বিলাতি বস্ত্রের আমদানি প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এসবের পাশাপাশি বিলাতি মদের দোকানে পিকেটিং চলতে থাকে। ইতিমধ্যে খিলাফত আন্দোলনের শুরুর মুখে তিলক দেহ রেখেছেন। এবার তাঁর নামে ‘তিলক স্বরাজ ফান্ড’ গড়ে এই আন্দোলনের সমর্থনে প্রায় এক কোটি টাকা সাহায্য পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ পুলিশের সমান্তরাল বাহিনী হিসাবে কংগ্রেস ভলেন্টিয়ার কোর গঠন করা হয়েছে। জুলাই, ১৯২১। আলী ভাইরা সেনাবাহিনীতে কর্মরত মুসলিমদের সেনাবাহিনী ছেড়ে বেরিয়ে আসার ডাক দিলেন। কংগ্রেস এবার আইন অমান্য কর্মসূচির ঘোষণা করল। ইতিমধ্যে মেদিনীপুর এবং অন্ধ্রের গুন্টুর জেলায় ইউনিয়ন বোর্ডের কর না দেবার আন্দোলন কর্মসূচি চলছে। আসামে চা-বাগান, স্টিমার সার্ভিস এবং আসাম-বাংলা রেলওয়েতে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের নেতৃত্বে ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এসবের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে শুরু হয়েছে যুক্তপ্রদেশে আওয়াধ কিষাণ আন্দোলন এবং একা আন্দোলন, মালাবার উপকুলে মুসলিম মোপলারা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গোদাবরী ও বিশাখাপত্তনম এলাকার রূম্পা সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষকরা স্থানীয় জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং পাঞ্জাবে গুরুদ্বারে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ইংরেজদের তল্পিবাহক ‘মোহান্ত’দের বিতারণের দাবিতে চলছে আকালিদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন। এর পাশাপাশি বর্মাতেও শুরু হয়েছে কৃষক আন্দোলন।
আরও পড়ুন
জাতীয়তাবাদের উত্থান
শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি আন্দোলনের প্রথম দিকে এই অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও গান্ধীজির সব ধরনের কর্মসূচি, যেমন সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়া, সমস্ত ধরনের সরকারি খেতাব ত্যাগ করা – এসব মেনে নিতে পারেননি। এর ফলে বোম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজে – যেখানে অভিজাত রাজনীতিবিদদের কেন্দ্রস্থল সেসব জায়গাগুলিতে এই আন্দোলনে বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি। অবশ্য বিহারে রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং গুজরাটে বল্লভভাই প্যাটেল সহিংস বিপ্লবের যে পথ তার পরিবর্ত হিসাবে গান্ধীজির অহিংস পথে আন্দোলনের পথটিকে সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিকল্প হিসাবে দেখতে শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন
বিরামকালে বিরামহীন সেলুলার জেল
ছোটো ব্যবসায়ীরা স্বদেশি আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে সমর্থন করেছিলেন। বিদেশি পণ্য বয়কটের ফলে তাদের দ্রব্য বিক্রি বেড়েছিল। আবার বড়ো শিল্পপতিরা এই আন্দোলন সম্পর্কে সংশয়ী ছিলেন, তাদের ভয় ছিল যে তাদের কলকারখানায় না এই সুযোগে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
বিরামকাল
কৃষকরাই ছিল মূলত এই স্বদেশি আন্দোলনের শক্তি। যদিও কংগ্রেস শ্রেণিযুদ্ধের বিরুদ্ধে (কারণ এই কংগ্রেস মূলত বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি) কিন্তু কৃষক আন্দোলন শুধুমাত্র ব্রিটিশদের পীড়নের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল ব্রিটিশদের প্রসাদভুক্ত স্থানীয় শোষক জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধেও।
শিক্ষিত যুবসমাজ অনেকাংশে স্বদেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদিকে যেমন সরকারি স্কুল-কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল অন্যদিকে শহরে বিলাতি পণ্য বয়কটের জন্য পিকেটিং ও অন্যান্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। বাড়ির মহিলারাও পর্দাপ্রথা ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল এবং এদের অনেকেই সাধ্যমতো গয়নাগাটি ‘তিলক ফান্ড’এ দান করেছিল। এরাও বড়ো সংখ্যায় বিলাতি বস্ত্র পোড়ানো এবং পিকেটিংয়ে অংশ নিয়েছিল।
খিলাফত আন্দোলনের সুফল হল বিশাল সংখ্যক মুসলিমদের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যস্থাপন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরাই এই স্বদেশি আন্দোলনে বেশি পরিমাণে গ্রেপ্তার বরণ করেছিল, নজিরবিহীনভাবে গান্ধীজি ও অন্যান্য নেতৃত্বকে মুসলিম সম্প্রদায় নেতা হিসাবে মেনে নিয়ে মসজিদ থেকে ভাষণ দেবার সু্যোগ দিয়েছিল এবং সবথেকে বড়ো কথা যে তারা গান্ধীজিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলাদের সামনে বক্তব্য রাখার অনুমতি দিয়েছিল।
ইতিমধ্যে মে, ১৯২১-এ ভাইসরয় রিডিং গান্ধীজির সঙ্গে এক আলোচনায় তাঁকে অনুরোধ জানালেন যাতে তিনি আলী ভাইদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের উত্তেজক সরকারবিরোধী ভাষণ থেকে বিরত থাকতে বলেন। গান্ধীজি বুঝলেন যে এই ফাঁদে ফেলে সরকার তাঁকে খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে দিতে চাইছে। তিনি আবেদনে সাড়া দিলেন না। ডিসেম্বরে সরকার দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করতে শুরু করল। কংগ্রেসের ভলেন্টিয়ার কোরকে বেআইনি ঘোষণা করা হল, জনসভা নিষিদ্ধ করা হল, প্রেসের কণ্ঠরোধ করা হল এবং গান্ধীজি ছাড়া বেশিরভাগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হল।
এবার গান্ধীজির ওপর অসম্ভব চাপ তৈরি হল। কংগ্রেসের নানা মহল থেকে তাঁকে বলা হল এবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করতে। ১৯২১-এ কংগ্রেসের আহমেদাবাদ সেশনে পৌরহিত্য করলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, এই কংগ্রেসে গান্ধীজির ওপর পরবর্তী কর্মসুচির দায়িত্ব দেওয়া হল। ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারিতে গান্ধীজি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিলেন যদি ইতিমধ্যে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি না দেওয়া হয় এবং প্রেসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তুলে নেওয়া হয়, তাহলে তিনি গণ আইন অমান্যের ডাক দিতে বাধ্য হবেন। স্থির হল এই গণআন্দোলন শুরু হবে গুজরাটের বরদোলি থেকে।
৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২। যুক্তপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার একটি ছোট গ্রাম চৌরিচৌরা। একদল স্বেচ্ছাসেবক বিদেশি মদ বিক্রি এবং সাধারণ দ্রব্যের মুল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে প্রচার করছিল, তখন আচমকা পুলিশ জনতার ওপর গুলি চালায়। একেই ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন দমনমূলক অত্যাচারে মানুষ অসন্তুষ্ট ছিল। কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়া এই গুলি চালনায় যেন আগুনে ঘৃতাহুতি হল। জনতা ক্ষেপে গিয়ে পুলিশকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় থানায় ঢুকিয়ে থানায় আগুন ধরিয়ে দিল। যে সমস্ত পুলিশকর্মী থানার ভেতরে আটকে পড়েছিল তাদের বেরোতে তো দিলই না এমনকি যে সব পুলিশকর্মী ওই অবস্থায় থানা থেকে বেরিয়ে পালাতে গেল, তাদের ধরে ওই জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এই হিংসাত্মক ঘটনায় বাইশজন পুলিশকর্মী অগ্নিদগ্ধ হয়ে জীবন্ত পুড়ে মারা গেল। গান্ধীজি এই ঘটনায় মর্মাহত হয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ঘোষিত আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন।
২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যবৃন্দ গান্ধীজির সঙ্গে বরদোলিতে দেখা করলেন। আলোচনায় স্থির হল এবার থেকে এমন কিছু করা হবে না যা আইনের পরিপন্থী। এর পরিবর্তে এখন থেকে কংগ্রেসের কাজ হবে খাদি বস্ত্র ও জাতীয় স্কুলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা, সরকারের ওপর থেকে জনগণের রাগ কমাতে প্রচার করা, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য জোরদার করা এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। গান্ধীজির আন্দোলন প্রত্যাহারে চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু এবং জওহরলাল নেহেরুর মতো জাতীয় নেতারা তাঁদের বিভ্রান্তির কথা প্রকাশ করলেন।
এতদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করলেও গান্ধীজিকে ছোঁবার সাহস পায়নি। ১০ মার্চ, ১৯২২ গান্ধীজি গ্রেপ্তার হলেন এবং তাঁর ছয় বছরের কারাদণ্ড হল। এই গ্রেপ্তারের কারণ অন্য কিছুই না শুধুমাত্র গান্ধীজির ডাকে যে বৃহৎ সংখ্যক জনতা সাড়া দিয়েছিল তা ব্রিটিশ সরকারের ভিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু জনপ্লাবনের ঢেউ যখন স্থিমিত তখনই প্রতিশোধ নিতে গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করা হল। যাইহোক এটাও ঘটনা যে গান্ধীজি যখন গ্রেপ্তার হলেন তখন দেশের কোনো প্রান্তেই এর বিরুদ্ধে এতটুকুও প্রতিবাদ ধ্বনিত হল না।
Powered by Froala Editor