জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড – রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি

‘কালাপানি’ আন্দামান — ২৮
আগের পর্বে

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষ ব্রিটেনকে অর্থ ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিল। বদলে মিত্রশক্তি কথা দিয়েছিল যুদ্ধের পর উপনিবেশগুলিকে স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দেবে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে দেখা গেল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই নেই। অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দারিদ্র যেন আরও তীব্র হয়ে উঠল ভারতে। ১৯১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারকে দু’ভাগে ভাগ করে দেওয়া হল— প্রশাসনিক ও আইনসভা। নামমাত্র ক্ষমতা পেলেন ভারতীয়রা। পাশাপাশি ১৯১৯ সালের মার্চ মাস থেকে লাগু হল রাওলাট আইন। যার মাধ্যমে সন্দেহজনক কোনো ব্যক্তিকে বিনাবিচারেই চালান করা সম্ভব দ্বীপান্তরে। এরপরই গান্ধীজী দেশজুড়ে সর্বাত্মক বিরোধিতার ডাক দিলেন। আর সেই আন্দোলন চেহারা নিল গণ-আন্দোলনের। তারপর…

সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হবার কথা ছিল ৬ এপ্রিল, ১৯১৯। ইতিমধ্যে নানা ধরনের শোষণের ফলে সারা দেশের সাধারণ মানুষ এতটাই ক্ষেপে উঠেছিল যে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রচার, ব্রিটিশবিরোধী বিক্ষোভ কলকাতা, দিল্লি, বোম্বে, আহমেদাবাদ এবং বিশেষ করে পাঞ্জাবে হিংসাত্মক রূপ নিল। সত্যি কথা বলতে, ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পর এত বড়ো অভ্যুত্থানের চেহারা ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি।

১১ নভেম্বর ১৯১৮। শেষ হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ভারতবাসী গান্ধীজির নেতৃত্বে ভাবছে এবার বুঝি ব্রিটিশরা ভারতীয়দের হাতে সামান্য হলেও প্রাদেশিক শাসনের কিছুটা ছাড়বে। ১৯১৯-এর প্রথম ভাগে মন্টেগু-চেমসফোর্ডের রিপোর্টে সীমাবদ্ধভাবে ভারতীয়দের হাতে স্থানীয় প্রশাসনের ভার তুলে দেবার কথা বলা হলেও জারি হল রাওলাট আইন। এই আইন মোতাবেক যুদ্ধকালীন যেসব দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেগুলিকে আরো জোরদার করা হল। এর বিরুদ্ধে সারা দেশ, বিশেষত পাঞ্জাব গর্জে উঠল। গান্ধীজি এপ্রিলের প্রথম দিকে দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিলেন। অমৃতসরে খবর ছড়াল যে বিশিষ্ট নেতাদের হয় পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে নয়তো শহর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আগুনে যেন ঘি পড়ল। ১০ এপ্রিল সারা অমৃতসর শহর যেন নেমে এল রাস্তায়। সৈনিকরা সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাল। মানুষও ক্ষেপে উঠল। দিকে দিকে মানুষ নিজেরা মিলিত হতে লাগল, মিটিং, মিছিল থেকে ব্রিটিশবিরোধী ক্ষোভ ঠিকরে বেরোচ্ছিল। ১৩ এপ্রিল প্রায় ১০,০০০ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগে এক বদ্ধ জায়গায়। সেখানে ঢোকা বেরনোর জন্য একটাই মাত্র রাস্তা। দিনটা ১৩ এপ্রিল, হিন্দু বছরের নতুন দিনের সূচনা, বৈশাখী পূর্ণিমার দিন; ওইদিন বৈশাখী উৎসবে যোগ দিতে পুরুষ, মহিলা, বৃদ্ধ এবং শিশুরা উৎসবের আনন্দে মাততে সেখানে জমায়েত হয়েছিল।  ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিন্যাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ারের নেতৃত্বে সৈনিকরা একটিমাত্র বেরনোর রাস্তাটিকে আটকে দিয়ে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাল। সমস্ত জালিয়ানওয়ালাবাগ চত্বরটি রক্তের বন্যায় ভেসে গেল। কত মানুষ যে সেদিন নিহত হয়েছিলেন তার হিসেব পাওয়া যায়নি কোনো আর্কাইভাল ডকুমেন্টে। আহত-নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও সরকারি হিসেব মতে বলে – নিহত – ৩৭৯, আহত – প্রায় ১,১০০। এই ঘটনার পরে কংগ্রেসের এক প্রতিনিধি দল ওই অকুস্থলে যায়। তাদের বেসরকারি তদন্তের রিপোর্ট অনু্যায়ী হিসেবটা এরকম – নিহত – প্রায় ১,০০০, আহতের সংখ্যা – প্রায় ১,৫০০। আহত-নিহতের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য না পাওয়া গেলেও এটুকু জানা গেছে যে ওইদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে মোট ১,৬৫০ রাউন্ড গুলি চলেছিল। এই নারকীয় ঘটনার পরেই পাঞ্জাবে চালু হল মার্শাল ল। এই আইনবলে এখন যে কারও নামে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিনা বিচারে আটক করার অধিকার থেকে শুরু করে   ভারতীয়দের সঙ্গে রাস্তার কুকুরের মতো ব্যবহার করার ক্ষমতা পেল প্রশাসন। জনসমক্ষে চাবুক মারা, রাস্তায় কনুই ও হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়ানো, চড়-থাপ্পড় মারা – দাস যুগ যেন ফিরে এল পাঞ্জাবে।

পুরো দেশ এই নারকীয় ঘটনায় হতবাক। সারা দেশে যেন নেমে এল শ্মশানের নিস্তব্ধতা। বিশিষ্ট নেতারাও ভয়ে চুপ। ২২ মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেন। তিনি আরো শুনলেন যে গুলিবর্ষণের সামনে পড়ে অসহায় মানুষগুলি সেদিন যাঁরা জালিয়ানওয়ালাবাগের উঁচু পাঁচিল টপকানোর চেষ্টা করছিলেন তাদেরও নৃশংসভাবে গুলি করে মারা হয়েছে। এরপর যাঁরা বেঁচেছিলেন, তাদের ওই অবস্থায় রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং পুরুষ- মহিলা নির্বিশেষে সবাইকে উলঙ্গ করে রাস্তায় প্যারেড করানো হয়েছিল। ইতিমধ্যে জাতীয় পত্র-পত্রিকাগুলি এই বিষয়ে নিশ্চুপ, তাদের ওপর আরোপিত হয়েছে অলিখিত সেন্সরশিপ। ফলে কেউ কিছু লিখতে পারছে না। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রা কাড়লেন না। রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ড আঘাত পেলেন এই ঘটনায়। একাই চেষ্টা করলেন, জনে জনে অনুরোধ করলেন এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে কিন্তু কেউ রাজি হলেন না। এমনকি তাঁর বন্ধু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকেও সঙ্গে পেলেন না। তিনি চার্লস এন্ড্রুজকে গান্ধীজির কাছে এই আবেদন নিয়ে পাঠালেন যাতে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ তিনি করেন। কিন্তু গান্ধীজি বলে পাঠালেন যে তিনি সরকারকে এই ঘটনা নিয়ে বিব্রত করতে চান না। রবীন্দ্রনাথ তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন, রাতে ঘুমোতে পারছেন না। শেষকালে এই নারকীয় হত্যার প্রতিবাদে ৩০ মে, ১৯১৯ তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে ব্রিটিশদের দেওয়া নাইট উপাধি তিনি পরিত্যাগ করবেন।

গান্ধীজিও কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন বুঝতে পারলেন না। এবার তিনি ভেবেচিন্তে দুটি কাজ করলেন – প্রথমত, এই মারাত্মক পৈশাচিক ঘটনায় তৎক্ষণাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে চুপচাপ থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করলেন। এরপর ১৮ এপ্রিল, ১৯১৯ তিনি অহিংসভাবে আন্দোলনের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করলেন। দ্বিতীয়ত, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রায় দেড় বছর পর ১৯২০-র ১-লা অগাস্ট খিলাফত আন্দোলনের সূচনায় সারা দেশ জুড়ে যেদিন হরতাল ডাকা  হয়েছিল, সেইদিন তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (বোয়ার যুদ্ধ) সময় ব্রিটিশদের সহায়তা করার জন্য তাদের কাছ থেকে যে কাইজার-ই-হিন্দ খেতাব এবং অন্যান্য সেবা মেডেল পেয়েছিলেন তা পরিত্যাগ করলেন। জালিয়ানওয়ালানবাগের এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যে তিনি তা পরিত্যাগ করলেন, তা কোথাও বলা নেই। তবে তাঁর অহিংস আন্দোলনের যে রূপরেখা তিনি তৈরি করছিলেন তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়াতে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন; ঘটনাটিকে ‘হিমালয়ান ব্লান্ডার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আজীবন তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘটনাটির জন্য ব্রিটিশদের বা ডায়ারকে দোষ দেওয়া তো দূরের কথা কখনো এই নারকীয় ঘটনায় যে সমস্ত মানুষ অকারণে প্রাণ হারালেন, কোনোদিন তার নিন্দা করলেন না। বরং বারেবারে ডায়ারের পাশে থেকেছেন, যা একটু পরে আমি আলোচনায় নিয়ে আসছি। শুধুমাত্র জালিয়ানওয়ালাবাগের নারকীয় হত্যাকাণ্ডই নয় এই সময়ে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন প্রত্যাহার রবীন্দ্রনাথকে ক্ষুব্ধ করেছিল।

আরও পড়ুন
জাতীয়তাবাদের উত্থান

আন্দোলন প্রত্যাহারের ফলে সেসময় বিভিন্ন স্তরের মানুষ – কৃষক, শ্রমিক, যুবসমাজ -  ব্রিটিশরাজের ওপর যেভাবে ক্ষেপে উঠেছিল, সেই সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে যদি সেদিন গণআন্দোলনের চেহারা দেওয়া যেত, তাহলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর যখন ব্রিটিশরাজ অর্থনৈতিক ভাবেও কিছুটা পর্যুদস্ত সেই ঔপনিবেশিক শক্তিকে সেই সময়েই ভারতবর্ষ থেকে সরিয়ে দেওয়া যেত। অথচ সেই পথ থেকে সরে এসে গান্ধীজি ব্রিটিশ শাসনকে আরো কিছু বছরের জন্য স্থায়িত্ব দিয়ে দিলেন। অবশ্য এটাও ঠিক যে তিনি ওই সময়ে দাঁড়িয়ে কখনোই স্বাধীন ভারতবর্ষের কল্পনাও করতে পারেননি। ব্রিটিশদের কাছে চিরকাল পরাধীন থেকে যতটা সুযোগ-সুবিধা আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে আদায় করে নেওয়া যায় – এই ভাবনা তাঁর মস্তিষ্ক অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তিনি তখন তাঁর নতুন আন্দোলনের পথ – অহিংস আন্দোলন – আইন অমান্য, জেল ভরো, প্রার্থনা, অরন্ধন, উপবাস – এই সমস্ত অস্ত্র প্রয়োগ করে সরকারের কাছ থেকে কীভাবে কতটা অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া যায় সেই তত্ত্ব বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগের স্বপ্নে বিভোর। তিনি তো তখন ভেবেই উঠতে পারছেন না যে একদিন ব্রিটিশরাজ ভারতবর্ষকে তার ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেবে।     

আরও পড়ুন
বিরামকালে বিরামহীন সেলুলার জেল

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস অবশ্য ডায়ারের এই নরহত্যার নিন্দা করে তাকে ‘অমানবিক’ বলে অভিহিত করেছিল এবং পাঞ্জাবে মার্শাল ল চালু করাকে ‘অন্যায্য’ এবং এটুকুই বলে দায় সেরেছিল। আবার ১৯১৯-এ অমৃতসরে কংগ্রেস অধিবেশনে ভাইসরয় কাউন্সিল থেকে স্যার চেত্তুর শঙ্করন নায়ারের পদত্যাগের প্রশংসা করা হলেও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড পরিত্যাগকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমনকি সীতারামাইয়ার The History of the Indian National Congress (১৯৩৫) বইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই নায়কোচিত এবং একক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের কোনো উল্লেখই করা হয়নি। 

আরও পড়ুন
বিরামকাল

জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘটনার ঠিক পরপরই ওই ঘটনার প্রতিবাদে ১৫ এপ্রিল ১৯১৯-তে পাঞ্জাবের চূহারকানা রেলস্টেশন আক্রমণ করল উত্তেজিত জনতা – রেলব্রিজ ভেঙে দিল, রেললাইন তুলে ফেলে দিল আর রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দিল। সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালাল। কিছুজন মারা গেলেন, কিছুজন আহত হলেন এবং ৪০০ জন মতো গ্রেপ্তার হলেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে তেজা সিং চুহারকানা এবং কর্তার সিং জব্বর সহ ত্রিশজন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হল। তেজা সিং এবং কর্তার সিংকে আন্দামানে পাঠানো হল। পাঞ্জাবে এইবার শুরু হল মার্শাল ল’য়ের প্রয়োগ। আঠারোজনের ওপর এই আইন প্রয়োগ হল। এই আইনে প্রায় জনাকুড়ি পাঞ্জাবিকে আন্দামানে চালান দেওয়া হল। 

আরও পড়ুন
মাফিনামা

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের একুশ বছর পর ১৩ মার্চ, ১৯৪০-এ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অন্যতম দায়ী পাঞ্জাবের তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর, মাইকেল ও’ডায়ারকে ইংল্যান্ডের ওয়েস্টমিনিস্টারে ক্যাক্সটন হলে গুলি করে মারলেন উধম সিং। ইংল্যান্ডে পুলিশ হেফাজতে থাকার সময় তিনি নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এক সর্বধর্মসমন্বয়কারী এবং মুক্তিকামী নাম, রাম মহম্মদ সিং আজাদ। ইংল্যান্ডের বার্নসবেরিতে ৩১ জুলাই, ১৯৪০-এ তাঁর ফাঁসির আদেশ রূপায়িত করা হয়।

Powered by Froala Editor