মুক্তি এল অবশেষে

‘কালাপানি’ আন্দামান— ২৩
আগের পর্বে

সেলুলার জেলে বিক্ষোভ, হরতাল আগেও হয়েছে। তবে ব্রিটিশ শাসকের গায়ে হাত? তেমনটাই করে দেখালেন পরমানন্দ ঝাঁসি। চোখা চোখা গালির প্রত্যুত্তরে ব্যারী সাহেবকে সটান লাথি মেরে ছিটকে দিলেন তিনি। ওয়ার্ডাররা মাথা থেঁতলে দিলেন তাঁর। বরাদ্দ হল কড়া শাস্তি। কিছুদিন পরেই মাস্টার ছত্তর সিং চড় মারলেন জেলের সুপারিটেন্ডেটকে। চাবুকের পর চাবুক মেরেও নত করা গেল না তাঁকে। অন্যদিকে তখন শুরু হয়ে গেছে বাকি রাজবন্দিদের ধর্মঘট। সেখানে কেউ কারোর নেতা নয়। হাজার শাস্তি প্রয়োগ করেও শিখ গদর বিপ্লবীদের দমাতে ব্যর্থ হল ব্রিটিশ প্রশাসন। তারপর…

ভান সিংকে সেদিন এমনভাবে মারা হয়েছিল যে তাঁর শরীর আর তা নিতে পারেনি। প্রায় মাসখানেক ভুগে চিরতরে চলে গেলেন বাবা ভান সিং। বাবা সোহন সিং ভাকনা ভুখা হরতাল শুরু করলেন। বাবা পৃথ্বী সিং আজাদও তাঁর সঙ্গে অনশনে যোগ দিলেন। কিছুদিন এভাবে চলার পর জেল কর্তৃপক্ষ তাঁদের দাবি মেনে নেবার আশ্বাস দিলে সোহন সিং অনশন ভাঙলেন কিন্তু পৃথ্বী সিং অনশন চালিয়ে গেলেন। খাবার তো নয়ই, জল পর্যন্ত গ্রহণ করলেন না পৃথ্বী, সমস্ত জামাকাপড় ছেড়ে উলঙ্গ হয়ে দিনযাপন করতে থাকলেন, সমস্ত চাদর, কম্বল ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। ওয়ার্ডাররা কুৎসিত গালাগালি করলেও কোনো উত্তর দিতেন না তিনি। এভাবে চার মাস পার হয়ে গেল, সহবন্দিরা তাঁর শরীর নিয়ে উদ্বিগ্ন। নানা আবেদন নিবেদন কিন্তু কিছুতেই তাঁকে মানানো যাচ্ছে না। তাঁকে ইতিমধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পৃথ্বী সিংয়ের স্মৃতি কথায় পাওয়া যায়, এক শিখ রাজবন্দি, শের সিং, তাঁর সঙ্গে যাতে হাসপাতালে দেখা করে অনশন রদের আবেদন করা যায় তার জন্য জলের সাথে কাঁচের টুকরো গিলে ফেললেন।  এর ফলে তাঁর রক্তবমি আর রক্তপায়খানা শুরু হলে তাঁকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তাঁর কাছ থেকে পৃথ্বী জানতে পারেন যে শুধুমাত্র তাঁর কাছে এসে তাঁকে অনশন ধর্মঘট তুলে নেবার অনুরোধ জানাবার জন্য এই মারাত্মক কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন। পৃথ্বীর হৃদয় এতে বিগলিত হলেও তিনি তাঁর সঙ্কল্পে স্থির থাকলেন। এরপর অনেকে মিলে তাঁদের রক্ত দিয়ে পৃথ্বীকে অনশন ভাঙার আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখলেন। এবার পৃথ্বী সিং আজাদ নাড়া খেলেন। তিনি মনে করলেন এভাবে যেন অন্য সহবন্দিদের কাছে তিনি করুণার পাত্র হয়ে উঠছেন এবং সত্যিই যদি তাঁর কিছু ঘটে যায় তাহলে তার জনে তাঁকেই সবাই দায়ী করবে।  এবার তিনি অনশন ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলেন। ইতিমধ্যে তাঁর ওজন অনেকটাই কমে মাত্র ৯০ পাউন্ডে (৪০.৮২৩ কেজি) এসে দাঁড়িয়েছে।

বুড়িবালামের যুদ্ধে বাঘা যতীনের সহযোগী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল। একদিন কুঠুরি বন্ধ অবস্থায় এক প্রহরী তাঁর সেলে যখন খাবার দিতে এল, জ্যোতিষ তাকে অনুরোধ করল যে তাঁর সেলের শৌচকর্মের জন্য যে মাটির পাত্রটি রাখা আছে সেটা যেন পরিষ্কার করে দেওয়া হয়, নয়তো এই ছোট আলোবাতাসহীন ঘরে দুর্গন্ধে তাঁর পক্ষে থাকা দূরুহ। ওয়ার্ডার তা করতে অসম্মত হল। জ্যোতিষ সমস্ত খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং অনশনে বসে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর রক্ত আমাশা দেখা দিল। তাঁর সহবন্দিরা অনেক তাঁকে বোঝালেন, কিন্তু তিনি অনশন ভাঙতে রাজি হলেন না। তাঁর কোনো চিকিৎসাও হল না। মাসখানেকের মধ্যে জ্যোতিষ পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গেলেন। পরে তাঁকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে ৪ ডিসেম্বর, ১৯২৪-এ বহরমপুর জেলে তিনি দেহত্যাগ করেন।

অন্যদিকে ধর্মঘটে যোগ দেওয়া রাজবন্দিরা ছয়মাসের বেশি ভারী হাতকড়া ও শিকলবন্দি হয়ে থাকায় তাঁদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকের মধ্যে টিবি রোগ বাসা বেঁধেছে, অনেকে পাগল হয়ে গেছেন, এবারে সাভারকর আসরে নামলেন। তিনি তাঁদের ধর্মঘট তুলে নিতে আনুরোধ করলেন, হাল্কা কাজে ফিরে যাবার উপদেশ দিলেন এবং জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মধ্যস্থতা করবেন বলে কথা দিলেন। কিন্তু ধর্মঘটিরা তাঁর আবেদনে কর্ণপাত করলেন না। এদিকে মৃত্যুর হার বেড়ে চলল, অনেকে উন্মাদ হয়ে গেলেন। আমেরিকার গদর পত্রিকার সম্পাদক জগতরামেরও দীর্ঘদিন নির্জন কুঠুরিতে আবদ্ধ থাকার ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে।

জেল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হল তাঁদের কিছু দাবি মেনে নিতে। কথা দেওয়া হল যে এবার থেকে তাঁদের স্নানের জন্য পরিশ্রুত জল, সাবান ও তেল সরবরাহ করা হবে, বাড়িতে লম্বা চিঠি লেখার সুবিধা দেওয়া হবে, উন্নতমানের ও পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার দেওয়া হবে এবং তাঁদের জন্য হাল্কা কাজ বরাদ্দ করা হবে। এবার তাঁরা ধর্মঘট তুলে নিলেন।

আরও পড়ুন
সাহসী প্রতিরোধ

ব্যারী সাহেবের অহং এবার ভেঙে চুরমার। পোর্ট ব্লেয়ারের ‘ভগবান’ এখন শুধু একটা ‘প্রস্তরখণ্ড’তে পর্যবসিত। ব্যারী সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং সেলুলার জেল থেকে বিদায় নিলেন ও পরবরতীকালে ভারতেই দেহরক্ষা করলেন। আরেকজন অত্যাচারী ওয়ার্ডার যে ‘ছোট ব্যারী’ নামে কুখ্যাত ছিল সেই মিরজা খান প্যারালিসিসে আক্রান্ত হয়ে মুক্তি পেল।

আরও পড়ুন
বীভৎস সেই বর্বরতা

জেল কর্তৃপক্ষের ব্যবহার সম্পূর্ণ ভাবে বদলে গেল। তারা আর রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গে কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চাইলেন না। এখন বই বাঁধাই ও প্রিন্টিং প্রেসে তাঁদের কাজ দেওয়া হল। ভাই পরমানন্দ, যেহেতু ধর্মঘটে যোগ দেননি তাই তাঁকে হাসপাতালে কম্পাউন্ডারের কাজ দেওয়া হল। তাঁরা যেটুকু কাজ করেন তাই যেন যথেষ্ট। তেলের ঘানি আর ঘোরে না। বন্দিরা এখন গ্রন্থাগারে পড়াশুনা করেন, খবরের কাগজ তাঁদের পড়তে দেওয়া হয় এবং তাঁরা এখন নিজেদের মধ্যে কথবার্তা ও আলোচনা করতে পারেন। এই সময়ে বাবা সোহন সিং ভাকনা প্রায় সাড়ে তিন বছরের ওপর ছোট্ট লোহার খাঁচায় বন্দি থাকা ছত্তর সিংয়ের মুক্তির জন্য ভুখা হরতাল শুরু করলেন। মেজর বার্কার ব্যারীর স্থলাভিষিক্ত হলেন। ভাকনা সিং তাকে ছত্তর সিংয়ের মুক্তির জন্য আবেদন জানালে তিনি কর্ণপাত করলেন না। দুমাস কেটে গেল। এরপর ভাই কেশর সিং এবং আরো কয়েকজন বার্কার সাহেবকে চরমপত্র দিলেন যে এই বিষয়টি যদি মীমাংসীত না হয় তবে তাঁরাও সোহন সিংয়ের সঙ্গে অনশন ধর্মঘটে যোগ দেবেন। শেষ পর্যন্ত মেজর বার্কার নরম হলেন, ছত্তর সিং দী্র্ঘদিনের পিঁজরাবন্দি থেকে মুক্ত হলেন, সোহন সিংও তাঁর অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেন।

আরও পড়ুন
আবারও ‘কালাপানি’

ব্যারীর উত্তরাধিকার এবার জেলে ‘ব্যারী ফর্মুলা’ প্রয়োগ করলেন এক সদ্য আসা রাজবন্দির ওপর; চাইলেন তাঁকে তেলকলে জোর করে হাত-পা বেঁধে জুতে দিয়ে অন্যদের দিয়ে ঘানি টানিয়ে তাঁকে ক্ষত বিক্ষত করতে, কিন্তু এই খবর আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। রাজবন্দিরা আবার অনশন ধর্মঘটের হুমকি দিল। নতুন জেলার সাহেব তাঁর অপরাধ অস্বীকার করলেন বটে কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের আর ঘাঁটাতে সাহস পেলেন না।

আরও পড়ুন
গদর বিপ্লবের সূচনা

জুন ১৯১৮। কলকাতার মডার্ন রিভিয়্যু কাগজে সেলুলার জেলে রাজবন্দিদের দুর্দশা নিয়ে একটা চিঠি প্রকাশিত হল। সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। পরপর বিভিন্ন সংবাদপত্র সেলুলার জেলের অবর্ণনীয় অবস্থা নিয়ে লেখালেখি শুরু করল। এদিকে ভাই পরমানন্দকে সন্দেহ করা হল ওই চিঠি লেখার জন্য তিনিই দায়ী। চিফ কমিশনার বিনা বিচারে পরমানন্দকে আবার সেলে বন্দি করলেন। পরমানন্দ বললেন, যে তাঁর চিঠি তো জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের হাত দিয়ে পাস হয়ে গিয়েছি, তাহলে অযথা তাঁকে দায়ী করা কেন? কিন্তু পরমানন্দ লাঞ্ছনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলেন না।

এবার সরকার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হল। ২৫ জুলাই। স্যার আলেকজান্ডার কারডিঊয়ের নেতৃত্বে ‘Indian Jails Committee (1919-20)’ এল আন্দামানে সেলুলার জেল পরিদর্শন করতে। এই কমিটির কাছে রাজবন্দিরা তাঁদের ক্ষোভের কথা বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করে স্মারকলিপি দিল।

কমিটি তদন্ত করে ফিরে গেল। এবার ভাই পরমানন্দ চিঠি পাঠানোর দায়ে তাঁকে অযথা শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনশনে বসলেন। সাতদিন কেটে গেল, তিনি সেলেই বিনা খাবারে পড়ে রইলেন। এরপর জেলের ডাক্তার তাঁর হাত-পা বেঁধে জোর করে দুধ খাওয়ানো শুরু করলেও, পরমানন্দ প্রায় দু’মাস কোনো খাবার মুখে তুললেন না। নতুন সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাঁকা নানাভাবে বোঝালেন কিন্তু সেই চেষ্টাও বিফল হল। এর কিছুদিনের মধ্যে সেলুলারে মার্শাল ল মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি এবং শচীন্দ্রনাথ সান্যালসহ চারজন বাঙালির মুক্তির আদেশ এসে পৌঁছাল। সুপারিন্টেন্ডেন্ট পরমানন্দকে আশ্বস্ত করলেন যে শিগগিরি তাঁরও কালাপানি থেকে মুক্তির আদেশ আসবে। এই বার পরমানন্দ তাঁর অনশন ধর্মঘট তুলে নিলেন।

ওইদিকে ভারতবর্ষের নানা জায়গায় রাজবন্দিদের আন্দামান থেকে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরদার হল। ইতিমধ্যে রাওলাট অ্যাক্ট প্রত্যাহৃত হবার ঠিক পরপরই ডিসেম্বর ১৯১৯-এ আন্দামানে সেলুলার জেল বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিল সরকার। ইংল্যান্ডের রাজা মন্টেগুর সাহায্য নিয়ে ‘রাজকীয় ক্ষমা’ (Royal Amnesty)-র কথা ঘোষণা করা হল। তৎকালীন ভাইসরয়, চেমসফোর্ডের আপত্তি সত্ত্বেও মন্টেগুর ব্যবস্থাপিত বাজবন্দিদের এই কারামুক্তির বিষয়টা ভারত সরকারকে মেনে নিতেই হল। ভারতের বিভিন্ন জেল থেকেও এই সময়ে রাজনৈতিক বন্দিরা মুক্তি পেলেন। সরকারি নির্দেশ এসে পৌঁছাল সেলুলার জেলে। প্রথমেই মুক্তি দেওয়া হল পাঞ্জাব ও গুজরাট থেকে মার্শাল ল মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত রাজবন্দিরা। এরপর একে একে মানিকতলা, লাহোর এবং বারাণসী ষড়যন্ত্র মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আটক রাজবন্দিরা। বারীন ঘোষ, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, ভাই পরমানন্দ সহ প্রায় ১৫ জন মুক্তি পেলেন সেলুলার জেলের অন্ধকারাচ্ছন্ন কারাবাসের হাত থেকে। অবশ্য সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এখানে যতজন নির্বাসিত হয়ে এসেছিলেন, তাঁদের সবাই ফিরতে পারলেন না। অনেকেই তো ইতিমধ্যে এখানে বর্বরতার শিকার হয়ে দেহ রেখেছেন যা কিনা বস্তায় পুরে পাথরে বেঁধে সমুদ্রে আবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেকেই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন।

বেশিরভাগ রাজবন্দিরা মুক্তি পেলেও সাভারকর ভাইরা সহ প্রায় জনা তিরিশেক রাজবন্দি মুক্তি পেলেন না। পরে ১১ মার্চ ১৯২১ ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব কেন্দ্রীয় আইনসভায় এক বিবৃতিতে জানালেন যে, আন্দামানে পেনাল সেটেলমেন্ট বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এবং ভবিষ্যতে আর কোনো রাজনৈতিক বন্দিকে সেলুলার জেলে পাঠানো হবে না। এই ঘোষণা মতে সাভারকররা দুই ভাইসহ বাকি রাজবন্দিরা আন্দামান থেকে, যে জাহাজে করে তাঁরা  বর্বরতার শিকার হতে, স্যাডিস্টদের পরীক্ষা-নিরিক্ষার গিনিপিগ হতে সেলুলার জেলের অন্ধকার জগতে প্রবেশ করেছিলেন, সেই ‘এস এস মহারাজ’ তাঁদের কালাপানি থেকে ভারতভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে এল।

যে সমস্ত রাজবন্দিরা ভারতে ফিরে এলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে মুক্তি পেলেন, অনেকে আবার ভারতবর্ষের বিভিন্ন জেলে ঠাঁই পেলেন। রাজবন্দিদের জন্য ওই মুহূর্তে আন্দামান সেলুলার জেল বন্ধ হয়ে গেল।

Powered by Froala Editor

Latest News See More