বীভৎস সেই বর্বরতা

‘কালাপানি’ আন্দামান - ২১
আগের পর্বে

১৯১৫ সালে গদর বিপ্লবের সমস্ত নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের গ্রেপ্তার করা হয়। শুরু হয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। ২৪ জনের ফাঁসির আদেশ হয়। ২৭ জনের দ্বীপান্তর। ভারতের পাশাপাশি মান্দালয় থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় শিখ বিপ্লবীদের। তাঁদেরও জায়গা হয় আন্দামানে। অন্যদিকে বাংলায় বরিশাল সমিতির তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি। নেতৃত্বে ছিলেন বাঘা যতীন। বুড়িবালামের যুদ্ধে নিহত হলেন যতীন মুখার্জী-সহ একাধিক বিপ্লবী। তবু দমল না প্রতিরোধ। অস্ত্র কেনার জন্য অর্থ লুঠ করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ গেল যুগান্তর গোষ্ঠীর। শুরু হল ‘শিবপুর ডাকাতি মামলা’। তারপর…

১৯১৫-১৯২১। নতুন করে রাজবন্দিদের ঢল নামল সেলুলার জেলে। তখনও পুরনো বিপ্লবীদের মধ্যে সেলুলার জেলে আছেন বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র দাস, সুরেশচন্দ্র সেন, পুলিনবিহারী দাস, সাভারকর ভ্রাতৃদ্বয় এবং যোশী। এই সময়কার কথাও উঠে এসেছে বারীন, উপেন এবং সাভারকরের স্মৃতিকথায়। আবার নতুন যাঁরা এলেন পরবর্তীকালে তাঁদের স্মৃতিচারণেও এই দিনগুলির বীভৎস ছবি উঠে এসেছে। এঁদের মধ্যে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, যিনি ‘মহারাজ’ নামে বেশি পরিচিত, তিনি লিখছেন জেলে ত্রিশ বছর, ইংরেজিতে বাবা পৃথ্বী সিং আজাদ লিখছেন An Autobiography এবং ভাই পরমানন্দ লিখলেন The Story of My Life, বাবা সোহন সিং ভাকনা পাঞ্জাবি ভাষায় লিখলেন জীবন সংগ্রাম, তাছাড়াও পাঞ্জাবি ভাষায় বই লিখলেন বিক্রম সিং ঘুমান – গদরি বাবা ওয়াসাখা সিং এবং ভগৎ সিং বিলগা – গদর লহর দে আনফোল ভারকে। এঁদের প্রত্যেকের লেখায় ধরা পড়েছে সেই ব্যারী সাহেবের অত্যাচার, সেই বর্বরতা, নৃশংসতার কাহিনি।

কালাপানিতে পৌঁছাবার পর কয়েদিদের মধ্যে যাঁরা ব্রাহ্মণ তাঁদের পৈতে কেড়ে নেওয়া হত। দেশের জেলে এরকম কোনো নিয়ম না থাকলেও কালাপানিতে ওই নিয়মই বলবৎ। এবার গদর বিপ্লবীরা আসতে শুরু করলেন সেলুলারে। ১৯১৭-তে দ্বিতীয় মান্দালয় কেসে বার্মা থেকে এলেন রামরাক্ষা নামে একজন পাঞ্জাবী ব্রাহ্মণ। তিনি এই পৈতে কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদ করলেন। তিনি কারাধ্যক্ষকে বললেন যে পৈতে না থাকলে পান ভোজন করা তাঁর ধর্মে নিষিদ্ধ। সুতরাং পৈতে কেড়ে নিলে তিনি জেলখানার অন্ন গ্রহণ করবেন না। অথচ তিনি যে গোঁড়া হিন্দু ছিলেন বা তাঁর যে জাতপাতের বাছবিচার ছিল এমনটা হবার নয়। তিনি দীর্ঘদিন চীন-জাপান-মালয়েশিয়ায় কাটিয়েছেন। তবু শুধুমাত্র সেলুলার জেল-কর্তৃপক্ষের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর প্রতিবাদ জানালেন। এরপর তিনি পানাহার ত্যাগ করলেন। চারদিন এভাবে চলার পর জোর করে তাঁর নাকে রবারের নল পুরে পেটে দুধ ঢেলে দেওয়া শুরু করল জেল কর্তৃপক্ষ। মাসাধিককাল এইভাবে চলল। তখন একটা ধর্মঘটের প্রস্তুতি তলায় তলায় শুরু হয়ে গিয়েছিল। রামরাক্ষাও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা চালাতে থাকলেন। ব্রহ্মদেশের জেল থেকে তাঁকে কালাপানিতে আনা হয়েছিল। তখনই তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য ছিলেন। এবার তিনি আক্রান্ত হলেন যক্ষ্মারোগে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে পাঠানো হল জেল-হাসপাতালে। অল্পদিন পরে সেখানেই তিনি মারা গেলেন। তাঁর পৈতা তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়নি।

রাজনৈতিক বন্দিরা সেলুলার জেলে প্রবেশের সাথে সাথে ব্যারী সাহেব কর্তৃক ‘বোমাওয়ালা’ সম্বোধনে আমন্ত্রিত হলেন এবং তার নির্দেশমতো যাঁরা ‘স্বরাজ’এর দাবি জানাচ্ছে, তাঁদের ঘানিতে জুড়ে দেবার নির্দেশ দেওয়া হল। ব্যারী সাহেব আগের মতোই রাজনৈতিক বন্দিদের প্রতি বিষাক্ত আচরণ করতে লাগলেন। এঁদের জন্যও পাঠান ও মুসলিম জমাদার ও পেটি অফিসার নিযুক্ত হল।

নতুন বন্দিদের প্রতি সেই একই ব্যবস্থা, একই নিয়মকানুন। এখানে কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলবে না। স্নানের জন্য বরাদ্দমাফিক সমুদ্রের নোনা জল। এবারে চুল নিয়ে সবথেকে বিপদে পড়লেন শিখেরা। চুল রাখতে গেলে যে যত্ন নিতে হয়, সাবানের প্রয়োজন হয়, তার থেকে তাঁরা বঞ্চিত। বাবা পৃথ্বী সিংয়ের লেখা থেকে জানা যায় যে তাঁর কমরেডরা মাথার চুল পরিস্কার করার জন্য সাবানের বদলে একধরনের রাসায়নিক তরল দ্রব্য পেতেন যা কোনো কাজের নয়। অনেকসময় কেউ কেউ লুকিয়েচুরিয়ে বাইরে থেকে সাবান আনাতেন। তবে ধরা পড়লে সর্বনাশ। তখন শাস্তি হিসাবে বরাদ্দ হত ৬-মাসের ক্রশ ফেটারস এবং ৭-দিনের হাত উঁচু করে দুই পা ফাঁক করে সারাদিনের জন্য দাঁড়াবেড়ি।

আরও পড়ুন
আবারও ‘কালাপানি’

খাবারের অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু এবারে একটা অসুবিধে দেখা দিল, বিশালদেহী শিখ বন্দিদের তো এতে পেট ভরে না। খাবারের পরিমাণ যাই হোক না কেন, কাজের পরিমাণ কিন্তু কমে না। চার-পাঁচজন ছাড়া ঘানিতে কাউকে জোতা না হলেও ছোবড়া পেটানোও কম পরিশ্রমের কাজ নয়। সকাল ৮-টা থেকে বিকেল ৪-টা পর্যন্ত কাজ করে দিনের কোটা পূরণ করতে না পারলে আরো বেশি সময় কাজ করতে হত, তার সঙ্গে জুটত মারধোর এবং কুৎসিত গালাগালি।  এমনকি কেউ অসুস্থ বোধ করলেও তার মুক্তি নেই এই শ্রমসাধ্য কাজ থেকে। এর ওপর ধার্য করা হত নানা ধরনের শাস্তি – উলঙ্গ করে বেত দিয়ে চাবকানো, ছ’মাসের জন্য ডাণ্ডাবেড়ি, সাতদিনের জন্য প্রতিদিন আটঘণ্টা করে দাঁড়াবেড়ি।

আরও পড়ুন
গদর বিপ্লবের সূচনা

ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী হাঁপানির রুগি ছিলেন। তিনি তাঁর জন্য হাল্কা কাজের বরাদ্দ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন।  একদিন কাজ করার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে তাঁর সঙ্গীসাথীরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে ব্যারী সাহেব প্রচণ্ড রেগে যান এবং কোনো ধরনের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেন। প্রাগপুর ডাকাতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আশুতোষ লাহিড়ী তখনকার দিনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। তিনি প্রায় কোনদিনই তাঁর ছোবড়া পেটানোর কাজের কোটা শেষ করতে পারতেন না। তাই প্রায়ই তাঁকে শাস্তির কবলে পড়তে হত। জেলের নিয়মানুযায়ী কোনো কয়েদিকে দিয়ে তিনমাসের বেশি পরিশ্রমসাধ্য কাজ করানো যায় না। কিন্তু আশুতোষকে ছাড়া হল না। তিনি হাল্কা কাজ চাইলেও কর্তৃপক্ষ রাজি হল না। আশুতোষ কাজ করা বন্ধ করে দিলেন। এরপর রাগে তিনি ব্যারী সাহেবকে তুলে আছাড় দিলেন। তাঁকে ত্রিশ ঘা বেত মারার নির্দেশ হল।

আরও পড়ুন
আবারও ধর্মঘট, দাবিপূরণ ও মূল ভূখণ্ডে রাজবন্দিদের প্রত্যাবর্তন

পাঞ্জাব থেকে আসা মার্শাল ল’য়ের আসামিদের জুতে দেওয়া হল তেলের ঘানিতে। তাঁরা সত্যাগ্রহের নীতি মেনে প্রতিবাদ জানালেন। জেলারের নির্দেশে তাঁদের হাত-পা বেঁধে ঘানির হ্যান্ডেলের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল। ওই অবস্থায় সেই ঘানি ঘোরালো সাধারণ কয়েদিরা। এর ফলে ঘানির সঙ্গে বদ্ধ অসহায় মানুষগুলোর হাত ও পিঠ মাটির সঙ্গে ঘষটে ক্ষতবিক্ষত হল।

আরও পড়ুন
সেলুলারে প্রতিবাদ, ধর্মঘট ও ভুখা হরতাল

শাস্তি আবিষ্কারের কোনো শেষ ছিল না। এখানে যেন একদল স্যাডিস্টের রাজত্ব। নানাভাবে চেষ্টা চলছে জেলে বন্দি তাদের হাতের মুঠোয় থাকা হতভাগ্য বিপ্লবীদের মনোবল কীভাবে ভেঙে দেওয়া যায়। শাস্তির জন্য নানাবিধ উপকরণের অভাব নেই। এঁদের মারার জন্য একটা পুরু বেত জলে ভেজানো থাকে। যে বিপ্লবীকে বেত মারা হবে তাঁর হাত-পা একটি তেকোণা কাঠের স্ট্যান্ডে ভালোভাবে বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর খোলা নিতম্ব একটা পাতলা ভেজা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর যে বেত্রাঘাত করে সে সমস্ত জোর দিয়ে একটা করে বেতের বাড়ি মারে, তারপর কিছক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, শক্তি সঞ্চয় করে আবারও ওইভাবে মার এবং এটা চলতেই থাকে। প্রতিটি মারের পরেই ব্রিটিশ কারাধ্যক্ষের দিক থেকে ভেসে আসে সাবাসির নৃশংস ধ্বনি। মারের চোটে সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, রক্ত ঝরতে থাকে। এরপর হাত-পা বেঁধে তাঁকে পরিয়ে দেওয়া হয় চটের কাপড়। কখনো শীতকালে কোনো বন্দিকে কয়েকজন মিলে জোর করে ধরে  নিয়ে গিয়ে চৌবাচ্চায় ঠাণ্ডা জলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুবিয়ে রেখে আবার উলঙ্গ অবস্থায় তাঁকে কুঠুরিতে ফেলে দিয়ে যায়, সরিয়ে নেওয়া হয় কম্বল। খালি মেঝেতে ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে আসহায় মানুষটি আর সেই দেখে আনন্দ পায় শাস্তিদাতারা। অত্যাচার আরও মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যখন কোনো বন্দিকে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে একজন ওয়ার্ডার তাঁকে ডাণ্ডাবেড়ি থেকে টানতে থাকে আর দুজন তাঁর দুহাত চেপে ধরে রাখে এবং ওই অবস্থায় তাঁকে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। এই প্রক্রিয়ার ফল হয় মারাত্মক যন্ত্রণা এবং গভীর ক্ষত। এইভাবে ক্ষতবিক্ষত শাস্তিপ্রাপ্তদের কোনো ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয় না।

আরেক মারাত্মক শাস্তি ছিল নির্জন কারাবাস। সেই অবস্থায় শুধুমাত্র বাথরুমে যাবার জন্য দণ্ডিতকে দিনে একবার কারা কক্ষ থেকে বের করা হত। এই অবস্থায় যে কোনো মানুষকে ছয়মাস আটকে রাখলে সে উন্মাদগ্রস্ত হতে বাধ্য। আর সব থেকে নৃশংসতা ছিল যখন কাউকে ছোট একটা লোহার খাঁচায় বন্দি করে রাখা হত। এই খাঁচাগুলি এতটাই ছোট ছিল যে তাতে কারও পক্ষে সোজাভাবে দাঁড়ানো, শোয়া এমনকি বেশি নড়াচড়া করা সম্ভব ছিল না।  এই খাঁচাগুলিতে অনেককে চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় আটকে রাখা হত। মাস্টার ছত্তর সিং, অমর সিং, জ্বালা সিং এবং লাল সিং’কে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এধরনের খাঁচায় আটকা রাখা হয়েছিল।

দাঁড়া বেড়ি ও অন্যান্য শারীরিক অত্যাচারে অনেক বন্দির স্বাস্থ্য ভেঙে যাতে থাকে, অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একে একে অনেকেই দিনের পর দিন টানা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অবশেষে প্রাণ হারান। আবার সেলের ভেতরে পিটিয়ে মারা হয় ভান সিংকে। এরপর তাঁদের মৃতদেহ বস্তায় পুরে পাথর বেঁধে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়।

Powered by Froala Editor