'কালাপানি' আন্দামান— ১৯
আগের পর্বে
১৯১৩ সালে গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিল মেম্বার ক্র্যাডক এসে পৌঁছলেন সেলুলারে। তাঁর কাছে অভিযোগ দায়ের করলেন রাজবন্দিরা। তবে তাতে উল্টো ফলাফল হল। রাজদ্রোহের পরিকল্পনার অভিযোগে বাড়িয়ে দেওয়া হল কাজের পরিমাণ। যার প্রতিবাদে আবার সেলুলারে শুরু হল ভুখা হরতাল। শেষ পর্যন্ত দাবি মেনে রাজবন্দিদের জাহাজে করে দেশে ফেরানোর বন্দোবস্ত করা হল। তবে মুক্তি পেলেন না বোমা মামলায় দণ্ডিতরা। তবে বারীনদের সহজ কাজ দেওয়া হল জেলে। শান্ত রাখতে বেতনও বাড়িয়ে দেওয়া হল ১ টাকা। তারপর...
মে–সেপ্টেম্বর, ১৯১৪। শুধুমাত্র যাবজ্জীবন দণ্ডিত রাজবন্দি ছাড়া বাকি মেয়াদি বন্দিদের ভারতবর্ষের নানা জেলে ফিরিয়ে আনা হল। ২৮ জুলাই ১৯১৪ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। ৪ আগস্ট ১৯১৪ জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা যুদ্ধ ঘোষণা করল। ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্য প্রান্তে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের আরেকটি অধ্যায় রচিত হচ্ছে। এই ইতিহাস রচনা অবশ্য অনেক আগেই শুরু হয়েছে ১৯১১ সাল নাগাদ। পটভূমি কানাডা। আন্দামানের পরবর্তী পর্বে ঢোকার আগে বরং সেই দিনগুলির কথা ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
১৯০৩ থেকে পাঞ্জাবিরা কাজের খোঁজে কানাডা ও আমেরিকায় যেতে শুরু করে। ১৯০৭ সালে ভারতে ‘Land Colonisation Act’ লাগু হলে, সেই আইন মোতাবেক কৃষকরা জমির ওপর অধিকার হারায়। তথন পাঞ্জাবি কৃষকরা জীবিকার সন্ধানে আরো বেশি করে আমেরিকা, কানাডা ছাড়াও মালয়, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিন্স, বার্মা, চিন, জাপান এবং হংকং-এর মতো ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কানাডাতে তখন জঙ্গল পরিষ্কার, করাতকল এবং রেললাইন পাতার জন্য বহু শ্রমিকের প্রয়োজন। আর এই সমস্ত পাঞ্জাবি অভিবাসীদের কম মজুরিতে কাজ করানো যায় ফলে সেখানে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯০৮-এ পাঞ্জাবিদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৬২৩-এ। একইভাবে আমেরিকায় প্যাসিফিক কোস্টে কাজ করার জন্যেও প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। সেখানেও বহু সংখ্যক পাঞ্জাবি কাজে নিযুক্ত হয়। কম মজুরিতে এই বিদেশিদের সেখানে কাজ করতে দেখে কানাডা ও আমেরিকার শ্রমিকরা তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে প্রায়ই ডাকাতি-গুণ্ডামি করে তাদের কাছ থেকে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়। ১৯১১-তে কানাডার সেন্ট জন দ্বীপে একটা করাত কলে কাজ চলার সময় লেবার কন্ট্রাকটর, পণ্ডিত কাঁসিরাম মারহোলি’র ওপর হামলা হয়। এ নিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সেলরকে নালিশ জানানো হলেও কোনো প্রতিকার হয় না। এই ঘটনার পর ওখানকার পাঞ্জাবি শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ এক হয়ে ভাবতে শুরু করে যে শুধুমাত্র কাঁসিরামের ঘটনাই নয়, ওই প্রদেশে তাদের কীভাবে বারেবারে অপমানিত হতে হয়। বিভিন্ন রেস্তোঁরাতে ‘Entry of Indians are prohibited’ লেখা বোর্ডই যে শুধু টাঙানো থাকে তাই নয়, তাদের বাচ্চাদের ‘হিন্দু চাকর’ বলে অপমান করা হয়।
পাঞ্জাবি শিখরা এবার জোট বাঁধতে শুরু করে। সেন্ট জন’এ কাঁসিরামের ‘ডেরা’ হয়ে ওঠে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্মের কেন্দ্র। সেখানে নানা ধরনের কার্যক্রম স্থির হয়। ভারতবর্ষ এবং ভারতবাসীদের জন্য কিছু করার পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়। সেখানে বিভিন্ন আলোচনায় যোগ দেন সোহন সিং ভাকনা, হরনাম সিং, উধম সিং, রামরক্ষা এবং ঈশ্বর সিং। ১৯১২-তে গুরুদত্ত কুমার এবং বাবু হরনাম সিং পোর্টল্যান্ডে এসে এক আলোচনায় বসেন। সেখানে ঠিক হয় যে সামাজিক কাজ করার বিষয় শেষ করে এখন সবাইকে নিজ দেশ ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করতে হবে। পোর্টল্যান্ডকে হেডকোয়ার্টার করে গঠিত হল ‘হিন্দুস্তান অ্যাসোসিয়েশন অফ প্যাসিফিক কোস্ট’। সোহন সিং, গুরুদত্ত এবং কাঁসিরাম সর্বসম্মতিতে যথাক্রমে এই সবগঠিত সংগঠনের সভাপতি, সম্পাদক এবং কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হলেন।
১৯০৯-এর মধ্যে কানাডাতে পাঞ্জাবিদের সংখ্যা অনেকটাই বৃদ্ধি পেল। ইতিমধ্যে ভ্যাঙ্কুভারে ১৯০৮ সালে একটি গুরুদ্বার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। পাঞ্জাবিদের সেবায় গঠিত হয়েছে ‘খালসা দেওয়ান সোসাইটি’। পাঞ্জাবিরা কানাডাতে জমি কিনতে শুরু করে দিয়েছেন। এসবের মধ্যে কানাডা কর্তৃপক্ষ ৯ মে ১৯১০-এ অভিবাসী সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করে ভারতীয়দের কানাডাতে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিলে পাঞ্জাবিদের সামনে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকল না। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯১১ গঠিত হল ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া লিগ’। এবার ভারতের স্বাধীনতার জন্য সরাসরি প্রচারের কাজ শুরু হল। তারা ইতিমধ্যেই পাশে স্বাধীন আমেরিকাকে দেখছে। সেখানকার বাসিন্দাদের দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, সমানাধিকার এই সমস্ত বিষয়গুলি পাঞ্জাব থেকে কানাডা-আমেরিকায় কাজ করতে আসা অশিক্ষিত চাষীদেরও চোখ খুলে দিচ্ছে। তখন তাদের মনে উঁকি মারতে শুরু করেছে দেশেকে স্বাধীন করার স্বপ্ন। ১৯১১-তে লালা হরদয়াল আমেরিকায় এলেন। তিনি এবার এঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ২১ এপ্রিল সান ফ্রানসিস্কোতে ‘হিন্দুস্তান অ্যাসোসিয়েশন অফ প্যাসিফিক কোস্ট-এর হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হল। এই সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে ঘোষিত হল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ দাসত্ব থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে সেখানে সমানাধিকার এবং বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে এও সিদ্ধান্ত হল যে পাঞ্জাবি এবং উর্দু ভাষায় একটি মুখপত্র বের করা হবে। সেই পত্রিকার নাম দেওয়া হল গদর। সোহন সিং ভাকনা, কেশর সিং, লালা হরদয়াল, লালা ঠাকার দাস ধুরি এবং পণ্ডিত কাঁসিরাম যথাক্রমে সভাপতি, উপ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হলেন। ১০,০০০ ডলার চাঁদা উঠল, সানফ্রানসিস্কোতে ৪৩৬, হিল স্ট্রিটে সমিতির অফিস খোলা হল, নাম দেওয়া হল ‘যুগান্তর আশ্রম’।
আরও পড়ুন
আবারও ধর্মঘট, দাবিপূরণ ও মূল ভূখণ্ডে রাজবন্দিদের প্রত্যাবর্তন
১ নভেম্বর ১৯১৩ গদর পত্রিকার প্রথম উর্দু সংস্করণ প্রকাশিত হল। লালা হরদয়াল সিং সম্পাদক। পত্রিকার সামনের পাতার ডান ও বাঁদিকে ‘বন্দে মাতরম’ কথাটা খোদাই করা হল। পরবর্তী সময়ে পত্রিকার হিন্দি ও গুজরাটি সংস্করণও প্রকাশিত হতে থাকল।
আরও পড়ুন
সেলুলারে প্রতিবাদ, ধর্মঘট ও ভুখা হরতাল
হরদয়াল ২৫ মার্চ ১৯১৪-তে গ্রেপ্তার হলেন। পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে ১৪ এপ্রিল ১৯১৪-তে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে গেলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। হরদয়াল বুঝে গেলেন যে কোনো সময় ইংল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এই সুযোগ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপযুক্ত সময় এটাই। তার জন্য তৈরি হতে হবে। কিন্তু প্রশিক্ষণ ছাড়া তো আর যুদ্ধ করা যায় না। যতীন্দ্রনাথ লাহিড়ীর নেতৃত্বে বারোজন যুবককে বোমা তৈরির কৌশল শিখতে জার্মানি পাঠানো হল। মাস্টার উধম সিং হঙকঙ’এ ব্রিটিশ কামান বাহিনী (আর্টিলেরি)-তে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি বাবা জ্বালা সিং’এর হোল্ট ভেল্ট ফার্মে গোপনে তরুণ বিপ্লবিদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। কর্তার সিং সারাভাকে নিউ ইয়র্কে একটি জার্মান বিমান সারাই কারখানায় পাঠানো হল প্লেন ওড়ানো এবং সারাইয়ের কলাকৌশল শিখতে। পৃথ্বী সিং আজাদও বোমা বানানো এবং প্লেন সারানোর কায়দাকানুন রপ্ত করলেন। বলবন্ত সিংকে পাঞ্জাবে পাঠান হল সেখানকার বিপ্লব পরিস্থিতি কতটা তৈরি হয়েছে তা দেখতে। আরো দুজনকে দেশে পাঠানো হল যাতে সেখান থেকে গদর পত্রিকা বের করা যায় তার ব্যবস্থা করতে। রীতিমতো শুরু হল লালা হরদয়ালের নেতৃত্বে দেশকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধের জন্য সামরিক প্রস্তুতি।
আরও পড়ুন
ইন্দুভূষণের আত্মহত্যা এবং উল্লাসকরের উন্মাদগ্রস্ততা
গদর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘কামাগাতামারু’ জাহাজের নাম। কামাগাতামারু ৪ এপ্রিল ১৯১৪ হংকং ছেড়ে, চিনের সাংহাই বন্দর হয়ে জাপানের মোজি ও ইয়োকোহামা বন্দর হয়ে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে পৌঁছায় ২৩ মে ১৯১৪। কানাডার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জাহাজের যাত্রীদের (পাঞ্জাবিরা ছিল সংখ্যায় বেশি) ওই দেশে নামার অনুমতি দিল না। তাদের ফিরতি পথের খাবার জাহাজে তুলে দিয়ে সেই দেশ থেকে একপ্রকার তাড়িয়ে দিল। ২৩ জুলাই জাহাজ কানাডা ছাড়ল। সেই দেশে ঢুকতে না দেওয়া পাঞ্জাবিরা তখন ব্রিটিশদের ওপর রেগে আগুন। গদর পার্টির নেতারা সিদ্ধান্ত নিল যে কামাগাতামারু জাহাজে যাত্রীদের নেতা বাবা গুরদিত সিংয়ের হাতে দেশের জন্য কিছু গদর পত্রিকা ও পিস্তল তুলে দিয়ে আসতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্টির সভাপতি সোহন সিং ভাকনা দ্রুতগামী জাহাজে চড়ে রওনা হলেন এবং ইয়োকোহামা বন্দরে পৌঁছলেন ২১ আগস্ট ১৯১৪। সেখানে বাবা গুরদিত সিংয়ের হাতে তুলে দেওয়া হল গদর পত্রিকা ও বাক্সভরা পিস্তল। তাঁকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করা হল।
আরও পড়ুন
সেলুলারে প্রথম হরতাল
২৫ জুলাই ১৯১৪ জার্মানি সার্বিয়া আক্রমণ করল। ৪ আগস্ট ব্রিটিশ জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। পরদিন গদর পার্টি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (আইলান-ই-জং) ঘোষণা করল। গদর বিপ্লবীরা তখন এতটাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং উত্তেজিত যে তাঁরা যে যেভাবে পারলেন দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আমেরিকা, কানাডা ও জাপান থেকে সমস্ত জাহাজ যখন হংকং বন্দরে এসে পৌঁছাল তখন সেখানে শিখেদের মেলা বসে গেছে। তাঁরা প্রত্যেকে তখন ভারতমাতার সৈনিক। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকার গদর বিপ্লবীদের সম্পর্কে আগেই খোঁজখবর পেয়ে এঁদের ধরার জন্য কলকাতা বন্দরকে টার্গেট করল। বাংলা পুলিশের সঙ্গে যোগ দিল পাঞ্জাব পুলিশ। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৪ প্রথম জাহাজ কামাগাতামারু এসে পৌঁছাল কলকাতা বন্দরে (বজবজ ঘাটে)। জাহাজ ঘিরে ফেলা হল। যাত্রীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চলল। এর ফলে ১৯ জনের মৃত্যু হল, আহত হলেন ২১ জন, ৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হল এবং অনেকের খোঁজ পাওয়া গেল না।
এরপর একে একে ৫৭ জন গদর বিপ্লবীদের নিয়ে ১২ অক্টোবর কলকাতা বন্দরে পৌঁছাল ‘চাই সাং’, পরদিন বাবা সোহন সিং ভাকনা, ভাই জয়ান্দ সিং এবং ভাই বীর সিং বাহোয়ালের মতো নেতৃবৃন্দ সহ ৮৩ জন গদর বিপ্লবীদের নিয়ে ‘নাম সাং’ জাহাজ কলকাতা বন্দরে নোঙর করল। আরো কিছু জাহাজ আসার কিছু পরে ২৯ অক্টোবর ১৯১৪ তে ১৭৩ জন গদর নেতা ও বিপ্লবীদের নিয়ে কলকাতা বন্দরে এসে ভেড়ে ‘তোসা মারু’। সিডিশন কমিটির রিপোর্টে পরে বলা হয় যে, যে’কটা জাহাজ গদর বিপ্লবীদের এদেশে নিয়ে এসেছিল তার মধ্যে সবথেকে মারাত্মক ছিল এই জাহাজে আসা বিপ্লবীরা। এরপর ‘লামা’ জাহাজে বেশকিছু টাকাপয়সা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসেন কাঁসিরাম। এঁদের অনেকেই ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
গদর বিপ্লবীদের নেতারা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়াতে পরিকল্পনা কিছুটা ধাক্কা খেলেও যাঁরা পুলিশের হাত থেকে কোনমতে পালাতে পেরেছিলেন তাঁরা এবার হাল ধরলেন। পাঞ্জাবের নানা জায়গায় প্রস্তুতি চলতে লাগল গোপনে। নভেম্বরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কাঁসিরাম এবং বিষ্ণু গণেশ পিংলে এসে পৌঁছালেন। লাহোরে মাচ্ছহাটায় ভাই পরমানন্দের দোকান হল বিপ্লবীদের যোগাযোগের ঠিকানা। তলায় তলায় বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট দখল এবং সেই সমস্ত জায়গায় সিপাই বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলতে থাকল। সেই মতো বেছে নেওয়া হল দুটি ক্যান্টনমেন্ট – লাহোরের মিঁয়া মীর ক্যান্টনমেন্ট এবং ফিরোজপুর ক্যান্টনমেন্ট। ঠিক করা হল যে ২৬ নভেম্বর ১৯১৪ এই ক্যান্টনমেন্টগুলির ওপর আঘাত হানা হবে এবং সেখানে সেনারা এঁদের সঙ্গে যোগ দেবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা সফল হল না। বরং ২৭ নভেম্বর ফেরু সেহরে পুলিশের সঙ্গে গদর বিপ্লবীদের গুলির লড়াইয়ে অনেক বিপ্লবী মারা গেলেন এবং কাঁসিরামসহ অনেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন।
এই পরাজয়ের ফলে সাময়িক ভাবে কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়লেও গদর বিপ্লবীরা পিছিয়ে গেলেন না। বিষ্ণু গণেশ পিংলে, কর্তার সিং সারাভা এবং প্রেমানন্দ ঝাঁসি বাংলা এবং বেনারসের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুললেন। তাঁরা রাসবিহারী বসুকে রাজি করালেন তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে। নতুন করে লাহোর ও ফিরোজপুর ক্যান্টনমেন্টে আঘাত হানার তারিখ ঠিক হল ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫। কিন্তু এবারে কিছু বিশ্বাসঘাতকদের জন্য পরিকল্পনা আবারও ব্যর্থ হল। সমস্ত গদর বিপ্লবী ও কর্তার সিং সারাভা এবং বিষ্ণু গণেশ পিংলে সহ নেতারা একে একে মার্চমাসের মধ্যে ধরা পড়লেন।
একগাদা ফৌজদারি মামলা দেওয়া হল গদর বিপ্লবীদের। ২৭৯ জনের বিচার হল, তাদের মধ্যে ৪৬ জনের ফাঁসি হল, ৬৪ জনের দ্বীপান্তরের আদেশ হল এবং বাকিদের তুলনায় অল্প সাজা দেওয়া হল। সেই সময়ের মতো গদর বিপ্লবের ইতি ঘটল। পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল ও’ ডায়ার এই গদর বিপ্লব সম্পর্কে বলেছেন,
The Ghadr Movement was by far the most serious attempt to subvert the British rule of India.
গদর বিপ্লব সফল হল না বটে, আর একটি সিপাই বিদ্রোহের সম্ভাবনারও বিকাশ ঘটল না, কিন্তু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইরত ভারতবর্ষের বিপ্লবীদের আদর্শ চেতনায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করে গেল।
Powered by Froala Editor