‘কালাপানি’ আন্দামান – ১৭
আগের পর্বে
মানিকতলা বোমা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ইন্দুভূষণ রায়কে কাতর করতে পারেনি কঠিন পরিশ্রমও। তবে নিত্যদিন জেলের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন তিনি। অন্যদিকে হাড় ভাঙা খাটুনির পর অসুস্থ হয়ে পড়েন উল্লাশকর। বাইরের কাজ থেকে ছুটির অনুমতি না নিয়েই জেলে ফেরার জন্য শাস্তি বরাদ্দ হয় তাঁর। বাড়তে থাকে অসুস্থতা। ১০৬ ঘুম জ্বর, সেইসঙ্গে হ্যালুসিনেশান। শেষ অবধি জেলের এক চিকিৎসক তাঁকে স্থানান্তরিত করেন মানসিক হাসপাতালে। কিছুদিন পর ভারত থেকে পরিদর্শনে এসে তাঁর অবস্থা দেখে দেশে ফেরানোর বন্দোবস্ত করেন জেলের ডিরেক্টর জেনারেল। ১৯১৩ সালে সেলুলার জেল থেকে মুক্তি মেলে তাঁর। তারপর…
ইন্দুভূষণের আত্মহত্যা, উল্লাসকরের উন্মাদ হয়ে যাওয়া – জেলখানার প্রকৃত মূর্তি বন্দিদের সামনে ক্রমশ ফুটে উঠতে লাগল। তাঁরা এই তিন বছরের অভিজ্ঞতায় বেশ বুঝতে পারলেন, যে জেলে সাজা খাটা শেষ যদিও বা হয় প্রাণ নিয়ে দেশে ফেরা আর হবে না, হয় কেউ ফাঁসিতে মরবে, নয়তো কেউ পাগল হয়ে মরবে। এই সময় সকলেই স্থির করলেন যে আর নয়, প্রতিবাদ আবারও করতে হবে ধর্মঘটকে হাতিয়ার করে। প্রায় সকলেই স্থির করলেন যে যতদিন তাঁদের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা না হয়, ততদিন তাঁরা কোনো ধরনের কাজ করবেন না। ইতিমধ্যে চুঁচুড়া থেকে ননীগোপাল মুখার্জী (ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলা) এবং ঢাকা অনুশীলন সমিতির পুলিন বিহা্রী দাশ (ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা) সেলুলার জেলে এসে গেছেন। ননীগোপাল নাবালক (তখন তাঁর বয়স সতেরো), আইনবিরুদ্ধ হওয়া সত্তেও তাঁকে তেলের কলুতে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনিও ধর্মঘটে যোগ দিলেন।
শুরু হল দ্বিতীয় ধর্মঘট। এই ধর্মঘটের মূল দাবি ছিল – ভালো খাওয়া পরা, পরিশ্রম থেকে অব্যাহতি এবং পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশার সুবিধা।
এই ধর্মঘট ভাঙার জন্য এবার জেল কর্তৃপক্ষও তাদের তুণ থেকে চোখা চোখা বাণ বের করে ধর্মঘটিদের ওপর প্রয়োগ করা শুরু করল। অন্য সকল কয়েদিদের থেকে পৃথক করে প্রথমেই ধর্মঘটিদের আলাদা ব্লকে বন্ধ করা হল, তাঁদের পাহারায় বাছা বাছা পাঠান প্রহরী নিযুক্ত হল। খাদ্যের পরিমাণ আরও কমিয়ে দেওয়া হল এবং তাঁরা যাতে পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে না পারেন তার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হল। এমনকি পায়খানায় গিয়েও যাতে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা না বলতে পারে তার জন্য সেখানেও প্রহরীর ব্যবস্থা করা হল। তাঁদের হাতকড়ি পরানো হল ও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হল। তাছাড়া দাঁড়া হতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি বা ক্রশ-ফেটারে আবদ্ধ করে শাস্তির ব্যবস্থা হল। মাঝে চার-পাঁচ কুঠুরি ব্যবধানে ধর্মঘটিদের আটক করা হল। এবার তাঁরা সুযোগ পেলে নিজেদের মধ্যে দেয়ালে টোকা মেরে এবং যে শিকল দিয়ে তাঁদের বাঁধা হত, তা বাজিয়ে একটা সরল টরেটক্কার মাধ্যমে কথোপকথনের চেষ্টা করতেন। কারাগারের প্রশাসন বাঙালির পাশে রাখত মাদ্রাজিকে, তার পাশে পাঠান ও বর্মিকে। সঙ্গোপনে কথাবার্তা তাই ছিল অত্যন্ত কঠিন। এতে তাঁদের দমানো তো গেলই না বরং তাঁরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। এর আগে যদিই বা কথাবার্তা আস্তে আস্তে হত, এবার চিৎকার করে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলা শুরু হল। হাতকড়িতে ঝুলিয়ে রাখলেও মুখ তো আর বন্ধ করা যায় না।
কর্তৃপক্ষের যেন সাপের ছুঁচো গেলা অবস্থা হল। সুনাম বা মর্যাদার খাতিরে ধর্মঘটিদের আবদার শোনাও চলে না, আর এদিকে ধর্মঘটও ভাঙে না। এমন সময়ে নতুন সুপারিন্টেন্ডেন্ট বদলি হয়ে পুরনো সুপারিন্টেন্ডেন্ট ফিরে এলেন। তাঁর পরামর্শে চিফ কমিশনার কয়েকজনকে সহজ কাজ দিয়ে জেলের বাইরে পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ধর্মঘটি রাজবন্দিরা এবার দাবি করলেন যে, সব রাজবন্দিকে যদি জেলের বাইরে পাঠানো হয় তাহলে তাঁরা বাইরে কাজ করতে যেতে রাজি হবেন, নয়তো তাঁরা আবার জেলে ফিরে আসবেন।
আরও পড়ুন
ইন্দুভূষণের আত্মহত্যা এবং উল্লাসকরের উন্মাদগ্রস্ততা
প্রায় দশ বারো জনকে নারকেল গাছের পাহারাওয়ালা করে বাইরে পাঠানো হল। নারকেল গাছ সরকারি সম্পত্তি, তা থেকে যাতে নারকেল চুরি না যায় তা দেখাই পাহারাওয়ালার কাজ। কাজ খুব সহজ হলেও সবাইকে আলাদা আলাদা জায়গায় কাজ দেওয়া হল যাতে পরস্পরের সঙ্গে দেখাশোনা না হয়।
জেল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল না। সবাইকে সহজ কাজ দিয়ে জেলের বাইরে পাঠানো তো হলই না, উপরন্তু বেছে বেছে কয়েকজনের উপর নতুন করে শাস্তি নেমে এল। অনেককে বাইরে কাজে পাঠানো হলেও হোতিলাল ভার্মা, নন্দগোপাল, ননীগোপাল এবং বামন যোশীকে ছাড়া হল না। ফলে জেলখানায় ধর্মঘট চলতে থাকল। জেলের ভেতরে আগে থেকেই সবথেকে বেশি অত্যাচার হয়েছিল ননীগোপালের ওপর। তাঁকে দাঁড়া হাতকড়িতে সারাদিন ঝুলিয়ে রাখা হত। তাঁর ওপর অত্যাচার যত বাড়তে থাকল ননীগোপালের প্রতিবাদী সত্ত্বা তত বিকশিত হতে থাকল। জেদি ননীগোপালকে দিয়ে কোনো কাজ তো করানো গেলই না, উপরন্তু তিনি তাঁর নিজের কাপড়জামা কাচা-ধোয়ার কাজটিও বন্ধ করে দিলেন। তাঁকে তখন জোর করে চটের বস্তার কাপড় পরানো হল। তাও তিনি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এরপর তিনি সমস্ত ধরনের জামাকাপড় পরা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে থাকতে শুরু করলেন। তখন জোর করে তাঁকে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে তাঁর শরীরে চটের বস্তা সেলাই করে দেওয়া হল। কিন্তু রাত্রেই তিনি তা ছিঁড়ে ফেললেন। তাঁর তখন একটাই কথা – “Naked we came out of our mother’s womb and naked shall we return” – ‘মায়ের পেট থেকে নগ্ন এসেছি, নগ্নই ফিরে যাব’। একথা বলতে বলতে চটের কাপড় গা থেকে ফেলে দিয়ে সারাদিন উলঙ্গ হয়ে বসে থাকেন। গলার টিকিট ভেঙে ফেলে দেন, চিফ কমিশনার কাছে এসে দাঁড়ালে উঠেও দাঁড়ান না, সেলামও করেন না। কী চাও জিজ্ঞাসা করলে বলেন – “কিছুই চাই না।”
আরও পড়ুন
সেলুলারে প্রথম হরতাল
এরপর ননীগোপালকে ভারী শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে রাখা হল। সেই রাত্রেই তিনি নিজেকে শিকল মুক্ত করে ফেললেন। এই কাজের জন্য শত অত্যাচারেও তিনি কোনো জবাবদিহি করলেন না। এরপর তাঁর নির্জন কারাবাসের আদেশ হল। সেখানে গিয়েও তাঁর আচরণের কোনো পরিবর্তন হল না। তিনি স্নানের জন্যও সেল থেকে বেরোতে অস্বীকার করলে, তাঁকে কয়েকজন মিলে জোর করে কাঁধে তুলে, চৌবাচ্চায় ফেলে নারকেল ছোবড়া দিয়ে এমনভাবে গা ঘষে দিল যার ফলে তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। পাঠান জমাদার তাঁকে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করল তবু ননীগোপালের লোহার মতো শিরদাঁড়াকে এতটুকু নমনীয় করা গেল না। ননীগোপাল সেলে ফিরে এসে সম্পূর্ণ উলঙ্গ আবস্থাতেই রইলেন। তাঁর দুটি কম্বলের একটা কেড়ে নেওয়া হল। তিনি আর একটি কম্বলও ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সম্পূর্ণ উলঙ্গাবস্থায় সেলের ভেতরে খালি ঠান্ডা মেঝেতে পড়ে রইলেন। ব্যারী সাহেব তাঁকে বেত মারার ভয় দেখালেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই ননীগোপালকে তাঁর সঙ্কল্প থেকে নাড়ানো গেল না। তাঁর একটাই দাবি তাঁকে রাজবন্দির সম্মান দিয়ে সব ধরনের কাজ ও অপমান থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। নন্দগোপাল ও ননীগোপালকে কিছুদিন পরে ভাইপার দ্বীপে একটা ছোট জেলে বদলি করা হল। সেখানে গিয়ে ননীগোপাল খাওয়া বন্ধ করে ভুখা হরতাল শুরু করলেন। চারদিন পরেই অনশনরত ননীগোপালকে সেলুলারে ফিরিয়ে আনা হল। চিফ কমিশনার, ব্রাউনিং সাহেবের নির্দেশে জোর করে তাঁর নাকে রবারের নল ঢুকিয়ে দুধ খাওয়ানো শুরু করা হল। সাজার পর সাজা খেয়ে বিফল মনোরথ হয়ে একে একে সবাই সেই ধর্মঘট থেকে সরে এলেও ননীগোপাল একা অনশন চালিয়ে গেলেন।
দিনের পর দিন কেটে গেল, ননিগোপাল কঙ্কালের মতো শীর্ণ হয়ে পড়লেন কিন্তু নিজের গোঁ ছাড়লেন না। যখন তিনি দেড় মাসের বেশি অনশনক্লিষ্ট, তখনও তাঁকে দাঁড় করিয়ে হাতকড়িতে ঝুলিয়ে রাখতে কর্তৃপক্ষের সঙ্কোচ বোধ হয়নি। ফলে দেখতে দেখতে আবার অনশন ধর্মঘট শুরু হল। এবার কর্তৃপক্ষের শত সাবধানতা সত্ত্বেও ইন্দুভূষণ, উল্লাসকর, ননীগোপালের কথা দেশের কানে এসে পৌঁছাল।
আরও পড়ুন
যমরাজার কারাগারে
বিনায়ক সাভারকরের বড়দা বাবুরাও প্রথম দিন থেকেই হরতালে যোগ দিয়ে অত্যাচার সহ্য করলেন। কিন্তু বিনায়ক সাভারকর ধর্মঘটে যোগ দিলেন না। সাভারকর তাঁর My Transportation for Life বইয়ে লিখেছেন, ভুখা হরতাল তাঁর পছন্দ নয়। এটা লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কোনো কাজের নয়। অনশন ধর্মঘটে ননীগোপালের অবস্থা খারাপ হলে তিনি নাকি তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হরতাল ভাঙান। অবশ্য এ কথা ঠিক যে ননীগোপালকে তাঁর বন্ধুবান্ধবরা অনেক কষ্টে অনশন প্রত্যাহারে রাজি করালেন। ধর্মঘট শেষ হল। ননীগোপাল মুখার্জী সর্বমোট ৭২ দিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন এবং ৬ ডিসেম্বর, ১৯১২-তে তা প্রত্যাহার করেন।
এই ধর্মঘটের ফলে রাজবন্দিরা কিছু সুবিধা অর্জন করলেন। তাঁরা জেল থেকে সুপারিন্টেন্ডেন্টের অনুমতিক্রমে সেলে বই আনার অনুমতি পেলেন। জেলের লাইব্রেরিতে তখন যে সমস্ত বই পাওয়া গেল, সেগুলি হল হার্বার্ট স্পেন্সার, শেক্সপিয়ার, জন স্টুয়ার্ট মিল, গিবন, এমারসন, ম্যাকলে, স্বামী বিবেকানন্দ, প্লেটো’র রিপাবলিক, স্যার টমাস মোর’এর ইউটোপিয়া এবং বাঙালি ও মারাঠি কবিদের বিভিন্ন বই। এই সময় রাজবন্দিদের কাজকর্মের পাশাপাশি একসঙ্গে বসে কথাবার্তা আলাপ আলোচনার সুযোগ দেওয়া হল এবং তাঁদের প্রতি একটাই শর্ত রাখা হল যাতে তাঁরা ভবিষ্যতে কোনো ধরনের ধর্মঘটে না যান।
আরও পড়ুন
ভি. ডি. সাভারকরের কথা
Powered by Froala Editor