'কালাপানি' আন্দামান - ১৩
আগের পর্বে
১৯০৭ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হত স্বরাজ্য পত্রিকা। তিন বছরে নয় সম্পাদকের দায়িত্বে প্রকাশিত হয়েছিল ৭৫টি সংখ্যা। এই পত্রিকা ব্রিটিশ শাসনের ভিত এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে সমস্ত সম্পাদকরাই বিবেচিত হয়েছিল রাজদ্রোহী হিসাবে। ১৯০৯ সালে বারীন ঘোষ, উপেনদের সঙ্গে সেলুলার জেলে ঠাঁই হয় এই পত্রিকার দুই সম্পাদকের। পরে আরও দুই সম্পাদক দ্বীপান্তরিত হন আন্দামানে। অন্যদিকে ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’-র প্রতিষ্ঠাতা পুলিনবিহারী দাশ ৪৬জন বিপ্লবী গ্রেপ্তার হন ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায়। তার মধ্যে শুধুমাত্র পুলিনবিহারীকেই পাঠানো হয়েছিল আন্দামানে। তারপর…
১৮৯৯-তে বাংলার ‘হিন্দু মেলা’র ধাঁচে বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং তাঁর দাদা গণেশ সাভারকর (বাবারাও) ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে মহারাষ্ট্রে ‘মিত্র মেলা’ গঠন করেন। ১৯০৬ সালের মাঝামাঝি বিনায়ক সাভারকর লন্ডনে গ্রে’স ইন-এ ব্যারিস্টারি পড়তে এলেন, বয়স তখন তাঁর ২৩। এর আগে পুনের ফার্গুসন কলেজে আইন পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন করে শাস্তি পেয়েছিলেন। কার্জনের বাংলা ভাগের সময় তিনি বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন। পরে পুনেতে গড়ে তুললেন ভারতের প্রথম গুপ্ত সমিতি ‘অভিনব ভারত’।
বিশিষ্ট ভারতীয় বিপ্লবী, শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা লন্ডনে ‘ইন্ডিয়া হাউস’ নামে ভারতীয় ছাত্রদের সামান্য খরচায় থাকা-খাওয়ার জন্য একটা হস্টেল খুলেছিলেন। সেখানে তিলকের সুপারিশে ঠাঁই হল সাভারকরের। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হল সরোজিনী নাইডুর ভাই, বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের এবং বিপিন পালের ছেলে নিরঞ্জনের। অচিরেই তিনি সেখানকার ভারতীয় ছাত্ররা যাঁরা দেশের স্বাধীনতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন তাঁদের নেতা হয়ে উঠলেন। এই ইন্ডিয়া হাউস থেকেই হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো) বোমা তৈরির রাশিয়ান ম্যানুয়েলের ইংরেজি অনুবাদের কয়েক কপি নিয়ে দেশে ফিরে গেছেন।
১০-ই মে ১৯০৮-এ ইন্ডিয়া হাউসে সিপাই বিদ্রোহের ৫০ বছর স্মরণে এক অনুষ্ঠানে মেয়েরা ‘বন্দে মাতরম’ গাইলেন। সাভারকর স্বরচিত কবিতা ‘ওহ মারটয়ার্স’ পাঠ করলেন। সেই বছরেই সাভারকর মারাঠিতে গারিবলডির আত্মজীবনী এবং সিপাই বিদ্রোহের ইতিহাস লিখে ফেললেন। পরে বইটি The History of the War of Indian Independence নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। সাভারকরের লেখা দুটি বই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভারতে পৌঁছে গেল।
এরকম সময়ে পুনেতে সাভারকর পরিবারের কর্তা, বিনায়কের বড়দাদা গণেশ দামোদর সাভারকর ওরফে বাবারাও-এর রানা প্রতাপ, শিবাজী, তাঁতিয়া টোপী এবং রানি লক্ষ্ণীবাই’কে নিয়ে বিপ্লবী কবিতা লেখার দায়ে যাবজ্জীবন কারাবাস হল। এই অযৌক্তিক শাস্তির প্রতিবাদে ১ জুলাই, ১৯০৯-এ লন্ডনের ইম্পিরিয়াল ইন্সটিটিউটের হলে মদনলাল ধিংড়া ব্রিটিশ প্রশাসক মার্লির এডিকং স্যার উইলিয়াম কার্জন উইলিকে হত্যা করলেন। ১৭-ই আগস্ট লন্ডনে ধিংড়ার ফাঁসি হল। ‘সাচ্চা হিন্দু সন্তান’ মৃত্যুর আগে বিনায়ক সাভারকরকে বলে গিয়েছিলেন যে তিনি যেন লক্ষ রাখেন যে মদনলালের মৃতদেহ যেন কোনো অহিন্দু না ছোঁয়।
আরও পড়ুন
দিকে দিকে অবাধ্যতার ঢেউ
উইলি হত্যাকাণ্ডের পর ইন্ডিয়া হাউস বন্ধ করে দেওয়া হল। সাভারকর গেলেন বিপিন পালের আশ্রয়ে। গান্ধীজী তখন লন্ডনে উপস্থিত। তিনি হত্যাকাণ্ডকে কাপুরুষতা বলে নিন্দা করলেন। পুলিশ সাভারকরের পেছনে লাগল, কিন্তু কোনো প্রমাণ না পাওয়াতে কিছু করতে পারল না। সাভারকর ধিংড়ার সমর্থনে বক্তৃতা দিলেন এবং লিখলেন। তাঁর গ্রে ইন কোর্টে আইনি প্র্যাক্টিস করার লাইসেন্স পাওয়া হল না।
বিনায়ক সাভারকর লন্ডনে থাকার সময়ে তাঁর নিজের হাতে গড়া মহারাষ্ট্রের গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন ‘অভিনব ভারত সমাজ’এর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি ‘ইন্ডিয়া হাউস’এর রাঁধুনি, চতুর্ভুজ আমিনের মাধ্যমে তাদের কাছে কুড়িটি ব্রাউনিং পিস্তল পাঠালেন। সেই পিস্তল এসে বোম্বেতে পৌঁছাল ৬-ই মার্চ, ১৯০৯-এ। ১৯০৯-এর নভেম্বরে আহমেদাবাদ শহরে বড়োলাট লর্ড মিন্টোর ওপর দুটি বোমা ছোঁড়া হল। অবশ্য একটা বোমাও ফাটেনি। এরপর ২১-শে ডিসেম্বর, ১৯০৯-এ নাসিকে অনন্ত কানহারে নাসিক জেলার কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে একট থিয়েটার হলে গুলি করে মারলেন। এই পিস্তলটি ছিল সাভারকার যে পিস্তলগুলি পাঠিয়েছিলেন তার একটি। আর জ্যাকসনই সেই ম্যাজিস্ট্রেট যিনি সাভারকরের দাদা বাবারাওকে রাষ্ট্রদ্রোহী কবিতা লেখার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ড দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন
সেলুলার জেলের তিন যমদূত
লন্ডন থেকে যে রাঁধুনী পিস্তল নিয়ে এসেছিল সেই আমিন রাজসাক্ষী হল। নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় উঠে এল বিনায়ক সাভারকরের নাম। সবাই সাভারকরকে পরামর্শ দিল, এখনই লন্ডন ছাড়ো। সাভারকর চলে এলেন প্যারিসে মাদাম কামা’র আশ্রয়ে। সেখানে তিনি কামা’র পত্রিকায় মদনলাল ধিংড়ার স্মরণে ‘মদনস তলওয়ার’ নামে একটা কলাম লিখতে থাকলেন। এরপর হঠাৎই একদিন প্যরিসের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে লন্ডনে ফিরে গেলেন এবং সবাইকে অবাক করে ১৩ মার্চ, ১৯৯০-তে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে নামামাত্র পুলিশের হাতে ধরা দিলেন।
ভারতে নাসিক ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষ্য, পিস্তল, চতুর্ভুজের বয়ান এবং সাভারকরের ট্রাংক থেকে বাজেয়াপ্ত করা সিপাই বিদ্রোহের উপর বই, 'হাউ টু অরাগানাইজ রেভোল্যুশন', কিছু নিষিদ্ধ লেখাপত্র এবং ইস্তেহার -- এসব দেখে ১৯১০-এর ১২-ই মে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট রায় দিলেন যে এই বন্দির ভারতে ফিউজিটিভ অফেন্ডার্স অ্যাক্ট ১৮৮১ অনুযায়ী বিচার হওয়া উচিত। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হল কিন্তু তা খারিজ হল। সাভারকরকে বিচারের সম্মুখীন হবার জন্য ফিরতেই হবে ভারতে।
আরও পড়ুন
আন্দামান সফরে
১ জুলাই ১৯১০। বোম্বেগামী এস এস মোরিয়া জাহাজে একটি চারবার্থের কেবিনে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় সাভারকরকে তোলা হল। সঙ্গী স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর এডওয়ার্ড পার্কার এবং বোম্বে পুলিসের ডিএসপি সি আই ডি ও দুজন কনস্টেবল। জাহাজ ৭ জুলাই সকাল ১০টায় ফ্রান্সের মার্সাই বন্দরে নোঙর ফেলল। ৮ জুলাই সকাল সাড়ে ছ'টায় সাভারকর পায়খানায় যাবার অনুমতি চাওয়ায় পার্কার নিজে গিয়ে ক্লোজেট চেক করে এসে হাতকড়ি খুলে ভেতরে যাবার অনুমতি দিলেন। তারপর পাশের ক্লোজেটে নিজে গিয়ে তিন ইঞ্চি ফাঁকের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখলেন যে সাভারকরেরটি বন্ধই আছে। উনি বাইরে দু'জন হেড কনস্টেবলকে সতর্ক পাহারায় থাকতে বলে নিজের বাংকে ফিরে গেলেন। ওরা দরজার নিচে উঁকি মেরে দেখল যে সাভারকরের চপ্পল দুটো ছেড়ে রাখা, মানে ও শৌচকর্ম সারছে। সাভারকরের ফিরতে দেরি দেখে এক কনস্টেবল দরজার ওপর দিয়ে দেখল ছোট্ট পোর্ট হোলের মাঝখান দিয়ে সাভারকরের অর্ধেক শরীর বাইরে গলে গেছে। ওর চিৎকারে বাকিরা এসে দরজা ভেঙে যখন ঢুকল তখন সাভারকর পুরো গলে গিয়ে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ওরা প্রহরীদের সতর্ক করল। একজন গার্ড জলে সাঁতরানো সাভারকরকে দেখে গুলি চালাল। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। প্রায় ১২ ফুট সাঁতরে সাভারকর জেটিতে উঠে দৌড়াতে লাগলেন। এরাও 'চোর, চোর, ধর, ধর!' চিৎকার করে তাড়া করল। কিছুদূর দৌড়ে সাভারকর ভারতীয় পুলিশ ও একজন ফ্রেঞ্চ ন্যাভাল সিকিউরিটি গার্ডের হাতে ধরা পড়লেন। সাভারকর ফ্রেঞ্চ পুলিশকে বললেন – তুমি আমাকে গ্রেফতার করে তোমাদের ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পেশ কর। ও ইংরেজি জানত না। কাজেই বন্দি সাভারকরকে আবার ওই 'মোরিয়া' জাহাজে তোলা হল। সাভারকরের মুক্ত হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় এবার একটা আন্তর্জাতিক আইনের প্রশ্ন সামনে এল।
ফ্রান্সের মাটিতে সাভারকরের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন উঠল। মার্সাই বন্দরে সাভারকরকে কে গ্রেপ্তার করল? ব্রিটিশ না ভারতীয় পুলিশ? ওদের ফ্রান্সের জমিতে কাউকে গ্রেফতারের অধিকার কে দিয়েছে? এ তো আন্তর্জাতিক আইনের অবমাননা! তবে কি ফ্রেঞ্চ ন্যাভাল পুলিশ ওকে ধরেছে? তাহলে সে কী করে বন্দিকে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে সমর্পণ করল? বিশেষ করে বন্দি যখন ফ্রেঞ্চ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে সারেন্ডার করতে চাইছে? বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় এই নিয়ে লেখালিখি শুরু হল। শেষে ফরাসি সরকার এ নিয়ে মধ্যস্থতা চেয়ে দি হেগ’এ আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে গেল। এই বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার আপত্তি করল না, কিন্তু চাল দিল যে বোম্বে কোর্টে সাভারকর মামলার শুনানি শুরু হয়েছে, সেটা স্থগিত হবে না।
আরও পড়ুন
সেলুলার জেল
বোম্বের আদালতে তিন জজের ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হল। প্রথম মামলা – রাষ্ট্রদ্রোহিতার (বিভিন্ন বক্তৃতা এবং লেখার ভিত্তিতে) -- রায় বেরোল ২৩ ডিসেম্বর ১৯১০। যাবজ্জীবন কারাবাস এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ। তখন যাবজ্জীবনের মানে ছিল ২৫ বছর কারাদণ্ড। জ্যাকসন হত্যা মামলার রায় বেরোল ৩০ জানুয়ারি, ১৯১১। একই রায় – আজীবন কারাবাস, মানে ২৫ বছর সশ্রম জেল কিন্তু দুটো শাস্তি একসঙ্গে চলবে না, হবে একের পরে এক। ফলে মোট কারাবাস ৫০ বছর, ওদিকে সাভারকর তখন ২৮ বছরের যুবক এবং ভারতীয়দের গড় আয়ু তখন ছিল ৪০-এর কম কিন্তু হেগ আন্তর্জাতিক আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত সাজা মুলতুবি থাকল।
ওপরের রায় বেরোনোর এক পক্ষকাল পরে দি হেগ’এ পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আর্বিট্রেশনে সাভারকর প্রত্যর্পণ মামলার শুনানি শুরু হল এবং মাত্র ১০ দিনের মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১১-তে রায় বেরোল। এই রায়ে সাভারকরের ওপর ব্রিটিশ সরকারের অধিকার স্বীকৃত হল।
রায় বেরোনোর সময় সাভারকর সেন্ট্রাল বোম্বের ডোঙ্গরি জেলে ছিলেন। দাদা, বাবারাও ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী কবিতা লিখে ‘সিডিসন’ কেসের আসামি হয়ে একবছর আগে আন্দামানে গেছেন। এবার বিনায়ককে যেতে হবে আন্দামানে। জুলাই, ১৯১১। বোম্বাই জাহাজ বন্দরে বড়ো শালা এবং স্ত্রী যমুনা দেখা করতে এলেন। পাঁচ বছর আগে যমুনা এসেছিলেন এই বন্দরে লন্ডনে যাবার সময় স্বামীকে বিদায় জানাতে। আশা ছিল, ফিরে আসবে এক সফল ব্যারিস্টার। তার জায়গায় দেখলেন হাতে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি স্বামীকে, তিনি যাচ্ছেন কালাপানি, ৫০ বছরের জন্যে, তাহলে এই বোধ হয় শেষ দেখা। ‘এস এস মহারাজা’ ছাড়ল মাদ্রাজ বন্দর থেকে। লোয়ার ডেকে গাদাগাদি করে কালাপানির সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা। গন্তব্য পোর্ট ব্লেয়ার বন্দর, তারপর সেলুলার জেল।
Powered by Froala Editor