আন্দামান সফরে

‘কালাপানি’ আন্দামান - ১০
আগের পর্বে

বড়লাট লর্ড মেয়োর হত্যার পরই নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশ প্রশাসন। আন্দামানে কয়েদীদের জন্য করা হয় বিশেষ বন্দিশালার পরিকল্পনা। আন্দামানেরই বিভিন্ন দ্বীপের বন্দিদের নিয়ে শুরু হয় সেলুলার জেল নির্মাণের কর্মসূচি। যা শেষ হয় ১৯০৬ সালে। সাইকেলের চাকার আদলে তৈরি সেই জেলে মধ্যবর্তী গম্বুজকে কেন্দ্র করে ছিল সাতটি বিস্তৃত ব্লক। সব মিলিয়ে সাড়ে তেরো ফুট বা সাত ফুটের বন্দিশালা ছিল ৬৯০টি। এককথায় সেই জেলখানায় ঢোকার পথ থাকলেও নেই বেরনোর রাস্তা। তবে ১৯৩৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় সেলুলার জেল। ১৯৩৮ সালের ১৮ জানুয়ারির মধ্যেই বন্দিদের সকলকে স্থানান্তরিত করা হয় মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে। তারপর...

দিনটা ১৯০৯ সালের ১২ই ডিসেম্বর। কলকাতায় তখন প্রচণ্ড শীত। শেষ রাত – তিনটে কি চারটে হবে, হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় সারি বেঁধে আলিপুর জেলের (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি জেল) গেটে এসে দাঁড়াল একদল বন্দি। এঁরা সব জেলের ৪৪ ডিগ্রির অন্তরীণ – বোমা মামলার সাংঘাতিক সব আসামি। কয়েদিদের পরণে হাঁটুঁর ওপর অবধি ধুতি, গায়ে হাতকাটা পিরাণ আর মাথায় পাগড়ি, পায়ে চালান বেড়ি। ঝমঝম পায়ের মল বাজিয়ে তারা ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়াল জেলের ফটকে। সবার গলায় গোরুর ঘন্টার মতো হাঁসুলিতে বাঁধা তক্তি – তাতে সাজার ধারা, মেয়াদ প্রভৃতি লেখা আছে।

বারীন্দ্র কুমার ঘোষের দ্বীপান্তরের কথা থেকে আমরা জানতে পারি, বাইরে এনে তাঁদের তোলা হল প্রিজন ভ্যানে – ‘মহাকালী পাঠশালার গাড়ি’। লম্বা গাড়িটিতে দুইদিকে জালে ঘেরা ছোটো ছোটো ঘুলঘুলি। সেই গাড়িতে বন্দিদের উঠিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দেওয়া হল। চারদিকে ঘোড়সওয়ার পুলিশ, গাড়ির পাদানিতে, ওপরে, পাশে গোরা সৈন্য। গাড়ি চলল খিদিরপুর ডকের উদ্দেশ্যে।

জাহাজঘাটে এসে গাড়ি থামলে দেখা গেল বন্দিদের অভ্যর্থনা জানাতে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইমার্সান সাহেব। আর চারদিক পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। তখনো রাতের রেশ কাটেনি। এবার বন্দিদের নিয়ে গিয়ে তোলা হল আন্দামানের উদ্দেশ্যে বন্দিপরিবাহী জাহাজ, ‘মহারাজা’য়। এই দফায় বন্দি সংখ্যা সাত – বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস, হৃষিকেষ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায়, বিভূতিভূষণ সরকার এবং অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। (উপেন ব্যানার্জী এবং সুধীর সরকার অসুস্থ থাকায় তাঁদের পরের জাহাজে আন্দামান পাঠানো হয়।) এঁদের নিয়ে এসে তোলা হল জাহাজের নিচের হোল্ডে।

জাহাজের নিচের তলায় ঘরের মেঝের তক্তায় একটা শিকল লম্বাভাবে আটকানো, তার দেড়-দুই হাত অন্তর আটকানো এক একটা হাতকড়ি। সেই ঘরটিতে সাতজন রাজবন্দিকে এক-একটি হাতকড়িতে একটা করে হাত আটকে দিয়ে ঘরের দরজায় সান্ত্রী পাহারায় রেখে তালা মেরে দেওয়া হল।

আরও পড়ুন
সেলুলার জেল

এঁরা মানিকতলা বোমা মামলার আসামি – বাঙালি বিপ্লবীদের প্রথম দল চললেন আন্দামান সফরে। সফরই বটে। বিচার প্রক্রিয়া চলার সময়ে আলিপুর জেলে একই কুঠূরিতে বন্দি অবস্থায় থাকলেও মামলার রায় বেরনোর পরে প্রত্যককে ৪৪ ডিগ্রির আলাদা আলাদা সেলে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে একজনের সঙ্গে আরেকজনের সাক্ষাতের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। জাহাজে উঠে অনেকদিন পর বন্ধুদের মধ্যে যেন পুনর্মিলন ঘটল। ফলে ভবিষতে সেলুলার জেলে কী হবে, কোন অবস্থার সামনে গিয়ে পড়তে হবে সেসব দুশ্চিন্তা না করে তাঁরা যেন বেরিয়ে পড়েছেন প্রমোদ ভ্রমণে।

দরজার বাইরে তালা বন্ধ হতেই খুলে গেল যেন সোডার বোতলের ছিপি আর ভসভস করে সোডা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে লাগল। মেঝের ওপরে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় কেউ বা উপুড় হয়ে, কেউ বা কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। কেউ গান ধরল, কেউ গল্পের ভুরভুরি তুলল, হাসিঠাট্টা-রঙ্গ-রসিকতায় সমুদ্রের বুকে জাহাজের দুলুনিকেও যেন ছাপিয়ে গেল সেই কলরব। তবে এর ফল ভালই হল। জাহাজের ক্যাপ্টেন, পুলিশের অফিসার, সেপাই-সান্ত্রীরা ভেবেছিল, এইসব বোমা ছুঁড়নেওয়ালাদের দল না জানি কি সাংঘাতিক হবে, জাহাজ না এরা তছনছ করে দেয় ! অবাকও হল কেউ কেউ – এ কিরে বাবা, ক’দিন পরেই তো গিয়ে এরা হাজির হবে যমদুয়ারে, ভারী কাজ ও শাস্তি দিয়ে এদের হাড় মাস আলাদা করে ডুগডুগি বাজানো হবে আর এদের মনে এত ফুর্তি! জাহাজ ছাড়ার পরে যখন বোঝা গেল যে এঁদের দ্বারা কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই, বরং মশা মারতে কামান দাগা হয়ে গেছে, তখন হাতকড়ি খুলে দেওয়া হল। পরের জাহাজে যখন উপেন ও সুধীরকে আন্দামানে পাঠানো হল তখন জাহাজের কর্মচারীরা উপেনকে বলেছিল, “প্রথমে আমরা তাঁদের বেঁধে রাখি, তারপর দেখলুম সব আমুদে লোক (a merry party), তখন খুলে দিই।”

হাতকড়ি খোলামাত্র কম্বল বিছিয়ে গোল হয়ে বসে আড্ডা, গান, ফুর্তি, মজা মশকরায় কোথা দিয়ে না জানি সময়  কেটে যেতে লাগল।  কালাপানি যে কী বস্তু,  সেখানে কী খেতে দেবে, কোথায় কীভাবে থাকা হবে, সে সম্পর্কে কারোরই কিছু জানা নেই। জাহাজের সেই ঘরেই নর্দমার পাশে একটা বালতি রাখা, সেটাই শৌচাগার, সেখানে একজন গেলে অন্যদের মুখ ফিরিয়ে থাকতে হয়। জাহাজের গায়ে একটু ওপরে মোটা কাঁচ দেওয়া ঘুলঘুলি। মাঝেমাঝে লাফ দিয়ে সেখান থেকেই ক্ষণিকের জন্য সমুদ্র দেখা। খাবার বলতে প্রথম দিন তাঁদের জন্য এল ছোলা ভাজা, চিঁড়ে, নুন, লঙ্কা আর চিনি। তখন বেলা দুটো বেজে গেছে। গল্প-গুজবে কোথা দিয়ে যে সময় গড়িয়ে গেছে সেই হুঁশ কারোরই নেই।  চিঁড়ে-ছোলাভাজা দেখে তো রীতিমতো আক্কেলগুড়ুম, বন্দিরা কি ঘোড়া, নাকি ভোজপুরি দারোয়ান? ভদ্রলোকের ছেলে সব, হিন্দু সন্তান। “বাপু, দুটি ভাত এনে দাও না।” “ভাত তো রাঁধে মুসলমানে। জাত যাবে যে বাবু।” দলের একজন উদ্ধত ইয়ং বেঙ্গল চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন, “জাত আমাদের মারে কে? ধর্ম আমাদের লোহায় গড়া। নিয়ে এসো চাচার ভাত, শ্রীদুর্গা বলে তাই খাব।” শিখ এবং হিন্দু পুলিশেরা তো তাই শুনে বেজায় খাপ্পা। এঁরা কয়েদি হতে পারে কিন্তু তাই বলে তাদের চোখের সামনে জাত চলে যাবে ষে, তা তো হতে দেওয়া যায় না। তারা বলল, “তাহলে আমরা রেঁধে দিই।” কোনরকমে ভাত পেলেই তখন হল। ভাত এল। কুমড়োর ঘ্যাঁট দিয়ে সেই ভাত অমৃত মনে করেই খাওয়া হল।

এরপর তাঁদের ওপরে ডেকে ওঠার অনুমতি দেওয়া হল। পায়ে বেড়ি পরে কোনোমতে কাঠের সিঁড়ি ভেঙে তাঁরা উঠে এলেন জাহাজের ডেকে। সমুদ্র প্রকৃতির শোভা অবলোকন করার সুযোগ হল।

আরও পড়ুন
আলিপুর বোমা মামলা এবং এক বেইমানের শাস্তি

১৫ই ডিসেম্বর, ১৯০৯। সকালবেলা দুরে বনরাজীছায়া কুল দেখা গেল। জাহাজ নোঙর করলে পরে একটা স্টিম লঞ্চ একটা গাধা বোটকে ‘নাকে দড়ি দিয়ে’ টেনে নিয়ে এল। বড়ো ডাক্তার, জেলার ও নানা ধরনের রাজকর্মচারীরা এলেন রাজবন্দিদের সম্বর্ধনা করে সেলুলার জেলে নিয়ে যেতে। চারদিকে বেশ একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এই প্রথম আন্দামানে এল ‘গোলাওয়ালা’র দল।

পরের দফায় এলেন উপেন আর সুধীর। দুজন সার্জেন্ট তাঁদের গাড়িতে করে খিদিরপুর ডকে নিয়ে এল। জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে তাদেরই একজন বিদ্রূপ করে তাঁদের বলল, “Now say, ‘My native land farewell’.” উপেনরা হেসে উত্তর দিলেন, “Au revoir”. সেই জাহাজে রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন ওঁরা দুজনেই। তাঁদের জাহাজে অন্যান্য সাধারণ বন্দিদের থেকে আলাদা করে অন্যঘরে রাখা হয়েছিল। জাহাজের একজন কর্মচারী তাঁদের ফটো তুলতে এসে বলল যে সেটা সে বিদেশের কাগজে পাঠাবে। এই শুনে তো ভারি মজা পেলেন উপেন। ভালোভাবে পাগড়িটা বাঁধলেন। এরকম বিনে পয়সায় প্রচারের সুযোগ কেউ ছাড়ে!

এই যাত্রায়ও খাবার বলতে শুধু চিঁড়ে বরাদ্দ। সুধীর তো রেগে কাঁই। সেই দেখে এক সহানুভূতিসম্পন্ন পাঞ্জাবি  মুসলমান হাবিলদার পুলিশ কিন্তু কিন্তু করে বলল, “বাবু, যদি আমাদের ভাত খাও তো দিতে পারি।” তার উত্তরে উপেনরা বললেন, “খুব ভালো কথা। আমাদের জাত এত পাকা যে, যে-কোনো লোকের হাতের ভাত খেলে তা ভেঙে পড়ে না।”

সেই শুনে শিখ হাবিলদার ভাবল ইস, পেটের জ্বালায় এদের পরকাল যায় যে! তাই সেও ভাত এনে হাজির করল। উপেনরা দু’দলের আনা ভাতই পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেলেন। আবার সেই জাহাজে নোয়াখালি জেলার অনেক বাঙালি মুসলমান মাল্লাও ছিল। তারা এনে দিত রান্না করা ভাত আর কুমড়োর ছালুন। সেটাও অমৃতোপম মনে হত।

আরও পড়ুন
মানিকতলার আড্ডা

এইভাবে চলে চতুর্থদিন সকালে জাহাজ পোর্ট ব্লেয়ারে এসে হাজির হল। সারি সারি নারকেল গাছে ছাওয়া রমণীয় এক দ্বীপ। মাঝে মাঝে সাহেবদের বাংলোবাড়ি। সব মিলিয়ে ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতো সৌন্দর্য। এক সিপাই দুরে একটা প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ি দেখিয়ে বলল, “ওই হল কালাপানির জেল, ওইখানে তোমাদের থাকতে হবে।”

জাহাজ এসে বন্দরে ভিড়ল। ডাক্তার এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পর আন্দামানের মাটিতে পদার্পণ করে মাথায় বিছানার মোট তুলে পায়ের বেড়ি বাজিয়ে উপেন আর সুধীর চললেন জেলের ভেতরে অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গী হতে।

Powered by Froala Editor