১৭৮৯ সময়টা বাণিজ্যের প্রয়োজনে সমুদ্র চষে ফেলার সময়। ফরাসি, দিনেমার, পর্তুগিজ জাহাজ সমুদ্রের জল কাঁপিয়ে পৃথিবীর এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের অধিকাংশ দখল করেছে। দেশের দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত অনেকগুলি দ্বীপের সমাহারে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। সেই দ্বীপগুলি নারকেল গাছে ভরা। সমুদ্রে যাতায়াতের পথে এই দ্বীপগুলির দিকে আগেই নজর পড়েছিল ইংরেজদের। বেশ কিছু বাণিজ্যপোত নোঙরও করেছিল এই দ্বীপে। এখানে তখন বসবাস সেখানকার আদিবাসী জনজাতিদের। উত্তর আন্দামানে বাস আন্দামানি উপজাতির বারোটি গোষ্ঠীর; দক্ষিণ আন্দামানের গভীর জঙ্গলে, পাহাড়ের ওপরে থাকে জারোয়া এবং সেন্টেনেলিজরা; লিটিল আন্দামানে থাকে ওঙ্গিরা; নিকোবর দ্বীপসমূহে থাকে নিকোবরিরা এবং অন্যান্য দ্বীপগুলিতে বাস শোম্পেনদের। এঁরা কোথা থেকে এসেছিল সে সম্পর্কে এখনো অবধি ধোঁয়াশা কাটেনি। এদের মধ্যে শোম্পেন আর নিকোবরিদের চেহারার সঙ্গে মঙ্গোলয়েডদের মিল থাকলেও বাকিরা নেগ্রিটো সম্প্রদায়ভুক্ত।
আর সেখানে বাস জলদস্যুদের। দক্ষিণ চীন সমুদ্রের মালাক্কা খাঁড়ি থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর, মালায়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া – এই অঞ্চলের সমুদ্র মানেই জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য। আন্দামানিদের একটি আদি জনজাতিও নানকৌড়ি দ্বীপকে অবলম্বন করে তখন বাণিজ্যপোতগুলোর ওপর ডাকাতি করত। এই সময়ে ব্রিটিশ পতাকাবাহী অনেক জাহাজ এসে ভিড়ত এই দ্বীপে। জলদস্যুরা অপেক্ষায় থাকত। দ্বীপের কিছুটা দূরে জাহাজ ভিড়িয়ে নাবিকেরা নৌকো নিয়ে আসত তীরে। বিনিময় প্রথার মাধ্যমে প্রথমে ওই দ্বীপের আন্দামানিরা নারকেল, শাক সবজি, পানীয় জলের পরিবর্তে তাদের কাছ থেকে মদ, তামাক, কাপড় আর ছুরি নিত। এরপরেই আন্দামানিদের রূপ বদলে যেত। একদল নৌকো করে জাহাজে গিয়ে সেখানে লুঠপাট চালাত। এই দ্বীপপুঞ্জ বাণিজ্যতরীর নাবিকদের কাছে এক বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল।
১৭৮৯-এ ভারতের বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিশ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন যে এই আন্দামানে সমুদ্রে ভাসমান ব্রিটিশ বাণিজ্যপোতগুলির সুরক্ষার জন্যে আন্দামানে জাহাজের ডক নির্মাণ এবং বাণিজ্যপোতগুলিকে যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা দিতে হবে। ১৭৮৯-এ লর্ড কর্ণওয়ালিশের নির্দেশে জলভাগ মানচিত্রাঙ্কন বিশেষজ্ঞ (হাইড্রোগ্রাফার) ক্যাপ্টেন আর্চিব্যাল্ড ব্লেয়ার এবং ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল এলেন আন্দামানে। তাঁদের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৭৮৯-এ ব্রিটিশ সরকার সর্বপ্রথম আন্দামানে চ্যাথাম আইল্যান্ডে বন্দর এবং উপনিবেশ গড়ে তুলতে আগ্রহী হলেন। প্রথমে জায়গাটির নাম রাখা হল পোর্ট কর্ণওয়ালিশ। পরে ওই জায়গাটার নাম পরিবর্তিত হয়ে পোর্ট ব্লেয়ার নামে পরিচিত হয়।
১৭৮৯-এ পোর্ট কর্ণওয়ালিশে উপনিবেশ স্থাপন করা হবে সিদ্ধান্ত হলে দেখা যায় যে ওই সব জায়গা ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। জায়গাটিকে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে জঙ্গল সাফ, বাড়ি নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি – এসব তো করতে হবে। সে কাজ করবে কারা? ওখানকার আদিবাসীরা সেভাবে তখনো ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ করেনি, এটা যেমন সত্যি, আবার তাদের সঙ্গে সভ্য জগতের কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই এটাও সত্যি। তবে তাদের দিয়ে উপনিবেশ গড়ে তোলা যাবে না এটা বুঝেই সিদ্ধান্ত হল ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে নিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের। তাদের দিয়েই পরিষ্কার করানো হবে জঙ্গল, তৈরি করানো হবে বাড়ি, রাস্তাঘাট।
আরও পড়ুন
দুই বালকের গল্প
আন্দামানের আবহাওয়া বরাবরই অত্যন্ত কর্কশ – প্রচণ্ড গরম, হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি, তারপর আবার গরম। জঙ্গলে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। তার ওপর বিষাক্ত পোকামাকড়, জোঁকের উপদ্রব। আর সে কি দুর্ভেদ্য অরণ্য! এই জঙ্গল কেটে সাফ করা ভীষণ পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। কিছুদিনের মধ্যেই এখানে ব্রিটিশ আধিকারিকদের অসুস্থ হয়ে পড়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। তবু ব্লেয়ারের কঠোর তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে পোর্ট কর্ণওয়ালিশ গড়ে উঠছিল। অবশেষে ১৭৯৬ সালে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ থেকে সবাইকে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে ২২০ জন বন্দি এবং ৫৫০ জন বাঙালি বসতি স্থাপনকারীকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। আন্দামান মুক্তাঞ্চল হয়ে গেল।
ব্রিটিশরা আন্দামান ছেড়ে চলে গেল। পোর্ট কর্ণওয়ালিস এখন বিলুপ্ত। আট বছরের একটি উপনিবেশ ছেড়ে চলে গেছে বিদেশিরা। আন্দামান স্বাধীন। এখানে এখন থাকে শুধু আদিম জনজাতি। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান এমনই যে ভারতের পথে বাণিজ্যপোতগুলির এই দ্বীপটিকে এড়িয়েও চলা যায় না। ওদিকে মালয়রা গোপনে এসে আন্দামানিদের ধরে নিয়ে যেতে লাগল। দাস হিসাবে ওদের বিভিন্ন দেশে পাচার করে দিতে পারলে ভালো রোজগার হয়।
আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের রাজা করতে চাইলেন বিদুর, ক্ষুব্ধ দুর্যোধন
১৮৪৪-এ দুটি ব্রিটিশ জাহাজ, ‘রানিমেড’ এবং ‘ব্রিটন’ আন্দামান সমুদ্রে ডুবো পাথরে ধাক্কা লেগে সমুদ্রে ডুবে গেল। নাবিকেরা কোনোমতে দ্বীপে গিয়ে উঠল। প্রায় ৫৪ দিন তারা ওই দ্বীপে খাবার এবং কোনোরকম সহায়তা ছাড়া থাকল। অনেকেই মারা গেল। খুব সামান্য নাবিককে উদ্ধার করেছিল অন্য জাহাজ।
১৮৪৯-এ ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসনের জাহাজ ‘এমিলি’ ডুবে গেল আন্দামানের কাছে। নাবিকেরা কোনোমতে দ্বীপে পৌঁছালে ওখানকার জনজাতিরা অনেককেই মেরে ফেলল। ১৭-ই অক্টোবর, ১৮৪৯ ব্যারেন আইল্যান্ডের পশ্চিমপ্রান্তে কমান্ডার ক্যাপ্টেন শ’য়ের জাহাজ ‘ফ্লাইং ফিশ’ ডুবে গেলে নাবিকরা কোনোপ্রকারে নারকোন্ডম দ্বীপে গিয়ে ওঠে। ১৩ জানুয়ারি, ১৮৫৫ মৌলমিন’এর ‘ফাইজ বুক্ষ’ আন্দামানের কাছাকাছি ডুবে গেলে সাতজন নাবিক কোনোমতে নিকটবর্তী দ্বীপে গিয়ে ওঠে। এদের মধ্যে তিনজনকে হত্যা করে আদিবাসীরা এবং বাকি চারজন গুরুতরভাবে আহত হয়। এই ধরনের আরো অনেক ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের নজরে ক্রমাগত আসতে থাকে যে আন্দামানের আদিবাসীরা সু্যোগ পেলেই নিরস্ত্র নাবিকদের ওপর হামলা করছে। ওইপথে জাহাজের নাবিকেরা অসহায় বোধ করছে। এরকম ঘটনা যদি বারেবারে ঘটতে থাকে তাহলে বাণিজ্যের ক্ষতি অবধারিত। এবার ব্রিটিশ সরকার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হল।
আরও পড়ুন
সৌমিত্র, সৌমিত্রই— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
১৫ জানুয়ারি, ১৮৫৮-তে সিদ্ধান্ত হল যে আন্দামানে আবার উপনিবেশ গড়ে তোলা হবে। ইতিমধ্যে ১৮৫৭-তে সিপাই বিদ্রোহ হয়ে গেছে। প্রচুর দেশীয় সিপাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককেই কামানের মুখে বেঁধে তোপ দেগে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেককে প্রকাশ্য রাজপথে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু এভাবে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছিল। সবথেকে ভালো হয় যদি এদেরকে সবার চোখের বাইরে সরিয়ে দেওয়া যায়। এর জন্যে সবথেকে ভালো জায়গা হচ্ছে আন্দামান। এদেরকেই নিয়ে যাওয়া হবে ওই উপনিবেশে। ওদের দিয়েই গড়ে তোলা হবে উপনিবেশ। মৌলমিন’এর একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার এবং ওখানকার জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন হেনরি মানকে ওই নতুন পেনাল সেটেলমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হল। ক্যাপ্টেন মান তাঁর দলবলসহ পোর্ট কর্ণওয়ালিশে এসে পৌঁছালেন। ২২ জানুয়ারি, ১৮৫৮ পোর্ট কর্ণওয়ালিশের নাম পরিবর্তন করে এই উপনিবেশের প্রথম নির্মাতা, ক্যাপ্টেন ব্লেয়ারকে সম্মান জানিয়ে নাম রাখা হল ‘পোর্ট ব্লেয়ার’। ওইদিন সমস্ত ধরনের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে দ্বীপে ইউনিয়ন জ্যাক উত্তোলিত হল। সমস্ত প্রথা মেনে আন্দামান ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্গত হল।
কিছুদিনের মধ্যেই ক্যাপ্টেন মানকে সরিয়ে দিলেন ব্রিটিশ আন্দামান কমিটির সভাপতি, ডাঃ মুয়াট। ডাঃ জেমস প্যাটিসন ওয়াকার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। ৪ মার্চ, ১৮৫৮-তে কলকাতা বন্দর ছাড়ল ফ্রিগেট ‘সেমিরামিস’। এই জাহাজে ডাঃ ওয়াকারের সঙ্গে গেলেন ২২০-জন সিপাই বিদ্রোহের কয়েদি, একজন ভারতীয় তত্ত্বাবধায়ক বা ওভারসিয়ার, দুজন ভারতীয় ডাক্তার, এবং একজন ন্যাভাল অফিসারের নেতৃত্বে ৫০-জনের নৌবাহিনীর একটি দল। জাহাজটি পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছাল ১০ মার্চ, ১৮৫৮।
পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছানোর পরপরই কয়েদিদের চ্যাথাম আইল্যান্ড পরিস্কার করতে পাঠানো হল। সেখানে এর আগে ক্যাপ্টেন ব্লেয়ার বন্দি উপনিবেশ গড়ার কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তা আবার দীর্ঘদিন যাবৎ অব্যবহারে অপরিষ্কৃত তো বটেই, জঙ্গলে ছেয়ে গেছে চারধার। আন্দামানের জলবায়ু এবং জঙ্গলের চেহারা এমনই যে গাছ-লতা দ্রুত বাড়ে এবং তা সমস্ত জায়গাকে দ্রুত ঢেকে ফেলে।
পোর্ট ব্লেয়ারের উল্টোদিকে রস আইল্যান্ড। দূর থেকেই ডাঃ ওয়াকারের বেশ লাগল দ্বীপটিকে। নারকেল গাছ ছাড়াও অত্যন্ত জঙ্গলাকীর্ণ ওই ছোটো দ্বীপটি। তিনি ভাবলেন, ওই দ্বীপটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে ওখানে প্রধান কার্যালয় বানালে কেমন হয়! যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। ৭ মে, ১৮৫৮, পেনাল সেটেলমেন্টের হেডকোয়ার্টার হিসাবে রস আইল্যান্ডকে বেছে নেওয়া হল। ২৫-জন করে তিনটি কয়েদিদের দল পাঠানো হল ওই দ্বীপে। ৬ নভেম্বর, ১৮৫৮-এর মধ্যে রস আইল্যান্ডে ১০০০ জন কয়েদিকে রাখার মতো ব্যারাক তৈরি হয়ে গেল। ঠিক হল রস, চ্যাথাম, ভাইপার এবং পোর্ট ব্লেয়ারে বন্দি উপনিবেশ গড়ে তোলা হবে। ৮ অক্টোবর, ১৮৫৮ ভাইপার দ্বীপ দখল করে সেখানে বন্দিদের দিয়েই প্রথমে মুক্ত জেল তৈরি করা হল ১৮৬৭-তে। এখানে প্রথমে নামে মুক্ত কয়েদখানা হলেও কয়েদিদের পায়ে সর্বক্ষণ বেড়ি দিয়ে রাখা হত তাই এই জেলের নামই হয়ে গেল ‘ভাইপার চেন-গ্যাং জেল’। পরে ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৪ তে পোর্ট মুয়াট’এও ৫০০ বন্দিকে নিয়ে গড়ে তোলা হল আরেকটি বন্দিশিবির।
Powered by Froala Editor