হেমেন রায়ের ড্রাকুলা, পিশাচ-কাহিনি এবং আরও

মুকুজ্জের দপ্তর – ৮

আগের পর্বে

ডাইনি বিদ্যা বা উইচক্রাফট বাংলা ভৌতিক সাহিত্যের এক অন্যতম অংশ। কিন্তু তারও প্রকারভেদ রয়েছে। বিভিন্ন আঙ্গিকেই এসেছে ‘ডাইনি’-র প্রেক্ষাপট। পথের পাঁচালীতে বিভূতিভূষণ তাকে দেখিয়েছে এক করুণ চরিত্র হিসাবে। আবার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে ‘ডাইনি’-র সঙ্গে জুড়ে গেছে কালা জাদু, অশুভের প্রেক্ষিত। স্বর্ণের বিবরণ যতটা হরর ততটাই তার ‘দ্বি-সত্তা’ প্যাথোলজিকাল। আবার প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে কমিকের সুরে ঘনাদা মজার পাশাপাশি ধরেছে ভয়ের বাতাবরণকে...

গথিক হরর সাহিত্যের যিনি এক রকম শেষ কথা – এবং শুরুর কথাও বটে- সেই ব্রাম স্টোকার ‘ড্রাকুলা’ লিখেছিলেন ১৮৯৭ সালে। তারপর লেখাটি বারম্বার অনুসৃত হয়েছে, (১৯২২ সালের এক্সপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্র ‘নসফেরাতু’-সহ বহু অ্যাডাপ্টেশন)। মোটের ওপর এক ‘ড্রাকুলা ফ্রানচাইজি’ গড়ে উঠেছে পৃথিবী গ্রহের তামাম পপ-কালচারে। বাংলা সাহিত্যে ড্রাকুলা ও ভ্যাম্পায়ারের উপস্থিতি ফিরে ফিরে আসবে – সত্যজিৎ রায়ের ‘বাদুড় বিভীষিকা’ এরকম একটি নমুনা এবং একটি সেরা নমুনা। মানবেন্দ্র পালের ভৌতিক নভেলেও ছায়া এসেছে প্রেত প্রাসাদ ও তার অধীশ্বর মনস্টারের।

সরাসরি ‘ড্রাকুলা’ অনুবাদ করেননি বটে হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮ – ১৯৬৩), কিছুটা ঘুরপথেই পাঠককে তার স্বাদ পৌঁছে দিয়েছেন বলা যায়। লেখাটির নাম ছিল ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’ – ব্রাম স্টোকারের ভাবানুবাদ না ব’লে একে নিজস্ব অ্যাডাপ্টেশন বলাই ঠিক হবে। হেমেন রায় এই কাজটি একাধিক বার করেছেন, এইচ জি ওয়েলস-এর অমর উপন্যাস ‘দা আয়ল্যান্ড অব ডক্টর মোড়ো’-র সিকোয়েল হিসেবে লিখেছেন ‘প্রশান্তের আগ্নেয়দ্বীপ’ কিংবা ‘ইনভিজিবল ম্যান’ অবলম্বনে ‘অদৃশ্য মানুষ’। ভারতের প্রত্যন্ত নেটিভ-স্টেট বিশালগড়ে এক রক্তপায়ী শাসককে আতঙ্ক-সাবজেক্ট ক’রে দেখানো এরই অনুক্রম। এখানেও (স্টোকার-কাহিনির মতোই) গল্পটি বিশদ করেছেন এক নবাগত অতিথি, ধারাবাহিক বিভীষিকা এর পর যাঁর স্নায়ু ও হাড়গুলিকে ভালোমতো অবশ ক’রে দেবে - এবং সেই সঙ্গে বাঙালি পাঠকেরও। 

হরর-সাহিত্যের আরেক মাস্টার হলেন এইচ পি লাভক্রফট, বাংলায় বারম্বার অনুবাদের সূত্রে তাঁর কথাও অনেকেরই জানা। ‘দি কেস অব চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড’ (রচনাকাল ১৯২৭) উপন্যাস - যার একটি পয়লা শ্রেণির অনুবাদ করেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন (ফ্যান্টাসটিক প্রকাশনীর ‘অদ্রীশ বর্ধন রচনাবলী’ দ্রষ্টব্য) – তাতে আমরা দেখেছি গোর থেকে আহ্বান করা হয়েছিল মৃত মানুষেড়, মন্ত্র বিদ্যার জোরে দেহাবশেষের সূক্ষ্ম টুকরো-টাকরা জমিয়ে সম্ভব হয়েছিল অতীতের চরিত্রকে জাগিয়ে তোলা – বীভৎস রসের ভিয়েনে চমকপ্রদ ভাবে উতরে যায় লাভক্রফট-আখ্যান। 

এই কাহিনির ছায়াই কি পাচ্ছি হেমেনবাবুরই ‘বিভীষণের জাগরণ’ উপন্যাসে? হত্যা-রহস্যের কিনারা করতে গিয়ে কলকাতা পুলিশ যখন থই পায় না, শখের গোয়েন্দা হেমন্ত প্রেততত্ত্বের শরণ নেয় (সহকারীর নাম ছিল রবীন) এবং আলোকপাত করে ‘স্নায়ুজম্নোক্রিয়া’ নামে একটি অপবিদ্যা (না কি পরাবিদ্যা?) সম্পর্কে। ...বিরল মানসিক শক্তিতেই কল্পিত অবয়বকে ফুটিয়ে তোলা যায় এবং কাঙ্ক্ষিত গড়নটি ভরে দেওয়া যায় রক্ত-মাংসে – রাতের পর রাত যে উত্থিত দানবটি শহরবাসীর নিশ্চিন্ত ঘুম তছনছ করে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন
বাংলা গল্পে আতঙ্কের উৎস যখন ‘উইচক্রাফট’ ও ‘কালো বিড়াল’

‘বাজালে বাঁশি কাছে আসি’ গল্পটি (আগের কিস্তিতে যেমন বলা হয়েছে) অশুভ জড়বস্তু নিয়ে। কথক চরিত্র পুরীর সমুদ্রতট থেকে সুদৃশ্য ‘বাঁশি’টি কুড়িয়ে পায় এবং হোটেলের ঘরে সেটি রেখে দেয়। বাঁশিটি বাজালেই এক ভৌতিক অবয়বকে সে বারম্বার দেখতে পাবে নিজের খাটে আসীন অবস্থায় – যেই দমবন্ধ দশা থেকে তাকে ‘উদ্ধার’ করবেন আগন্তুক সাধু; জিজ্ঞেস করবেন ‘এ বাঁশি কোথায় পেলে?... কথক উত্তর দেবে এবং প্রস্থানের আগে সাধু জানিয়ে যাবেন, ‘আমি এটা বিসর্জন দিতে চললাম। এ বাঁশি জাদুকরের বাঁশি, এ অমঙ্গলকে ডেকে আনে।’

বাংলা ভাষায় পিশাচ-কাহিনির একটি পুরোনো উদাহরণ আছে দীনেন রায়ের ‘পিশাচ-পুরোহিত’ উপন্যাসে, বিলিতি প্রভাব বেশ কিছু সেখানে আছে।  ...শবদেহে প্রেত ‘ভর’ ক’রে সেটিকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে এবং বেওয়ারিশ শরীরটি ব্যবহার করতে পারে নিজের কাজে – এই গল্পের আমাদের দেশেও প্রচলন ছিল। ‘ভারতের সাধক সাধিকা’ গ্রন্থে দেখি, তিব্বতী বাবা নিজের জীর্ণ দেহটি ছেড়ে এক তরুণ শবে প্রবেশ করেন এবং এইভাবে কয়েকশো বছর বেঁচে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তাঁর পুণ্য-কাহিনি আমাদের প্রসঙ্গ থেকে একেবারেই পৃথক – উল্লেখটুকু রাখা হল ‘ফেনোমেনা’টির ‘প্রাচ্যতা’ বোঝাতেই। ...হেমেন রায়ের ‘মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী’ – অতিখ্যাত এক পিশাচ গল্প, প্রত্যাশিত আতঙ্ক তৈরিতে যা সার্থক এবং লেখকের মুনশিয়ানা এতে আবারও দৃষ্টান্ত হিসেবে লক্ষ্য করবার।

আরও পড়ুন
অশুভ ‘বস্তু’, অভিশাপ ও তন্ত্র বারেবারেই এসেছিল বিভূতিভূষণের গল্পে

আমাদের অতি আপন, অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনি হিসেবে যা পায়োনিয়র, সেই ‘যকের ধন’... নরকরোটি-র সংকেত থেকে গুপ্তধনের সন্ধানই যার মুখ্য প্লট – বিমল ও কুমার নামে দুই ছোকরার সাহস যেখানে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ‘যকের ধন’-এর এক অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে, একটি রাতের বোরডম কাটাতে কাহিনির মাঝেই বিমল বন্ধু কুমারকে শ্মশান যাত্রী হিসেবে নিজের এক মর্বিড অভিজ্ঞতার গল্প বলেছে – ‘স্টোরি উইদিন স্টোরি’ এই ফর্ম্যাটে। গল্পটি আদ্যন্ত ভৌতিক, নিশুতি রাতের ছমছমানি যা অনেক খানি গাঢ় ক’রে তুলেছিল। হেমেন্দ্রকুমার রায় শ্মশান সংক্রান্ত গল্পে সিদ্ধ, একাধিক লেখায় এই প্লট-ছক তিনি রক্ষা করেছেন। বিমলের মুখে-শোনা গল্পটি তারই নমুনা এবং ভৌতিক সাহিত্যে তাক-লাগানো সংযোজন।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বাংলার ভূতের গল্পে ননসেন্স ছড়াও জাঁকিয়ে বসেছিল দিব্যি