মুকুজ্জের দপ্তর – ৭
আগের পর্বে
ভৌতিক গল্পের রবীন্দ্রনাথ শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু তারপরে বিভূতিভূষণ সেই ভয়ঙ্করতার ভূগোল পাল্টে দিয়েছেন একেবারেই। তৈরি করেছেন একটা দমচাপা রহস্য। যেখানে বাড়িতে নবাগত কথক ভৌতিক ঘটনার বিশ্বসী নয়। অথচ তাঁর জন্য অপেক্ষারত সমূহ বিপদ। পাঠক পড়তে পড়তে দৃশ্য দেখতে পেলেও সাবধান করার সুযোগ নেই কথককে। কখনও বিভূতিভূষণের গল্পের প্লট ঘিনঘিনে, আবার পরক্ষণেই গায়ে কাঁটা দেওয়া। কালাজাদু এবং প্রাচ্যতন্ত্র নিয়েও আগ্রহ ছিল তাঁর। তারানাথের গল্প যার উদাহরণ। নুটি মন্তরেও সেই পরিচয় মেলে। তবে এই গল্পের বাইরে স্বয়ং বিভূতিবাবুর মৃত্যুর সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এমনই এক ভৌতিক আখ্যান...
‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসে জনৈক ‘ডাইনি’কে আমরা পাই, লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে করুণ চরিত্র ক’রে দেখিয়েছেন। তখন আঁধার সন্ধ্যে, অপু আর নীলু কম শিউরে ওঠেনি তাকে দেখে - যদিও সে-ভয় ছিল ছেলেমানুষি। হতদরিদ্র ও নিঃসঙ্গ এমন স্ত্রী-চরিত্র হামেশাই দেখা যেত গ্রামদেশে, সাধারণে এদের মনে করত অশুভ... কেউ-বা দয়া দেখাত, কেউ তা নিয়ে ছেলে-ভোলাতে বুনত ছমছমে গল্প।
যেমনটা শুনেছিল অপুও, আতুরী ডাইনি আচার-আমচুর দেওয়ার ছলে পাতায় পুরে ফ্যালে ছোটোদের ‘প্রাণ’ এবং অতঃপর চুষে খায় তাদের শরীর। ...‘মুই মাত্তেও যাইনি ধত্তেও যাইনি... ছোঁড়াডা কাদের?’ অপুদের ছুটে পালাতে দেখে এরপর বৃদ্ধা ভাববে, সামান্য আমচুর দিতে চাওয়াই কি ‘দোষ’ হল তার!
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) এর সম্পূর্ণ উলটো ব্যাপার করেছেন তাঁর ‘ডাইনি’ গল্পে – বাংলা সাহিত্যে যার জুড়িদার আছে কি জানা যায় না। এখানে ‘ডাইনি’ আর মনগড়া নয় – বাস্তব; কুখ্যাত ‘স্বর্ণ’ লোকগল্প থেকেই যেন জলজ্যান্ত উঠে এসেছে গ্রাম-পরিসরে। এবং গল্পের বিশেষত্ব এইখানে – ‘অশুভ’ স্বর্ণ ডাইনির প্রেক্ষিত থেকেই এগিয়েছে ন্যারেটিভ। তার ভিতরকার সংশয়, গ্লানি আর ক্রূরতা একত্রিত সংঘর্ষে জ্বলে উঠেছে। উইচক্রাফট-এর একটি দিশি ভার্শন হচ্ছে বাণ মারা – অপরের অনিষ্ট করার জন্য একরকম কালো জাদু, গ্রামবাংলায় ডাইনি বিদ্যায় যা ছিল প্রধান আইটেম। লোকে যা বলে, তা কি সত্যিই সে জানে?
তবে কি ডাইনিই লুকিয়ে আছে আমার ভেতর?... স্বর্ণ ভরে থাকে এই সন্দেহে, কখনো উল্লাসে কখনো আতঙ্কে কেঁপে ওঠে বারম্বার। নাহলে একটা শিশুকে দেখলে ওরকম লাগে কেন – স্নেহ, দয়া, করুণা... তার সঙ্গে লোভও! কখন সে চড়াৎ ক’রে উঠবে স্বর্ণ জানে না... ‘খেয়ে ফেললাম রে, ছেলেটাকে খেয়ে ফেললাম’ – তার আর্তচিৎকার সন্তানের মাকে কাঁপিয়ে দেয়। ‘এটা তবে রামনগর (গ্রাম)?... তুমিই সেই...!’ আতঙ্কে ছেলেকে নিয়ে মা ছুট দেয়, সর্বনাশ যা ঘটার ঘটে গেছে ততক্ষণে – ধনুকের মতোই এরপর বেঁকে যাবে আক্রান্ত, শরীর নিংড়ে জল বেরিয়ে আসবে... আর এরকম ঘটতেই থাকবে... আবার, বারম্বার; ডাইনির রোষে পড়বে জোয়ান মরদও... ‘কীসে তাহার কী করিবে?’
আরও পড়ুন
অশুভ ‘বস্তু’, অভিশাপ ও তন্ত্র বারেবারেই এসেছিল বিভূতিভূষণের গল্পে
যাকে ডাক্তারি মতে বলে ‘Split Personality’/‘দ্বি-সত্তা’ - সেই অসুখেই হয়তো স্বর্ণ আক্রান্ত; যুবতী বয়স থেকেই সে ‘নিজে’কে আয়ত্তে রাখতে অক্ষম... নিজে-ই নিজের ঘিনঘিনে আতঙ্কের কারণ। ...‘ডাইনি’ যতটা হরর গল্প, ততটাই (কিংবা তার চেয়েও বেশি) প্যাথোলজিকাল বিবরণ... অসুস্থতার ক্রনিকল, অপলক নৈকট্যে ন্যারেটিভ খুঁড়ে খুঁড়ে দ্যাখে চরিত্রকে, আদুড় হয়ে যায় গূঢ় ও কুটিল সত্য ...আত্মার ব্যান্ডেজ এখানে শুরুতেই খুলে নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলার ভূতের গল্পে ননসেন্স ছড়াও জাঁকিয়ে বসেছিল দিব্যি
বাংলা ভূখণ্ডের এক প্রাচীন মিথ আছে ‘ভুলো ভূত’কে নিয়ে – নতুন পথিককে যে পথ দেখাবার ছল করে ঘুরিয়ে মারে এবং কারণ হয় তার শোচনীয় মৃত্যুর। তারাশঙ্কর এই মিথ নিয়ে একটি গল্প লেখেন ‘ভুলোর ছলনা’ নামে। ভুলো’র খপ্পরে পড়লেও গল্পের নায়ক কী করে প্রাণে বেঁচে যাবে তারই আখ্যান। ...ভৌতিক সাহিত্যে অসাধারণ দানের জন্য তিনি আমাদের সকলের কৃতজ্ঞতা পাবেন।
বাদলা দিনে ভিনগাঁয়ে ফুটবল ম্যাচ খেলতে গেছিল কলকাতার একটি টিম এবং রাতটি কোনোভাবে কাটাতে চেয়ে উঠেছিল এক হন্টেড হাউজে – এই মোচড় দিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮) ‘গল্পের শেষে’ আরম্ভ করেছেন। গল্পটি আমাদের সাহিত্যে বিশিষ্ট কেননা এর আতঙ্ক-বস্তুটি যতটা সুলভ পশ্চিমি গল্পে, এদেশে তত নয়। ‘কালো বেড়াল’ – যা প্রতীচ্যে বরাবরই অমঙ্গলের চিহ্ন, প্রবাদপ্রতিম হরর-লেখক এডগার অ্যালান পো ‘দি ব্ল্যাক ক্যাট’ (১৮৪৩) গল্পে এই ফেনোমেনা স্মরণীয় ক’রে রেখেছেন।
আরও পড়ুন
‘স্কল’, ‘স্কেলিটন’ কিংবা মজলিশি ভূতেরা – ত্রৈলোক্যনাথ থেকে উপেন্দ্রকিশোর
প্রেমেন্দ্রের গল্প শুরু হয়েছে লঘু কমিক সুরে, অল্পে অল্পে তা জমাট হতে থেকেছে, মাঝরাত্তিরে ভূতের বাড়িতে তাস খেলা ও তাস উধাও হওয়ার অলৌকিকতায় ফেটে পড়েছে প্রত্যাশিত ভয়। ...বাংলা ভাষায় হরর গল্পের তালিকা তৈরি করলে ‘গল্পের শেষে’কে প্রথম তিনের মধ্যে রাখার জন্যে মুকুজ্জের দপ্তর সোচ্চার আপিল জানাচ্ছে।
আরও পড়ুন
দীনেন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রভাত মুকুজ্জের হাড়কাঁপানো অশরীরী
লেখকের সৃষ্ট ঘনশ্যাম দাস (ঘনাদা), পরাশর বর্মা, মামাবাবু-র মতোই আরেক চরিত্র হলেন মেজোকর্তা - যাঁর কথা অনেকেই হয়তো মনে রেখেছেন। মেজোকর্তা-র নেশা ছিল একটু বিচিত্র, ‘ভূত শিকার’ (পোড়ো বাড়িতে গিয়ে ভূতের সুলুকসন্ধান করা) এবং একইসঙ্গে নিজের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি লিখে যাওয়া জাবদা খাতায়। তাঁর বয়ানে যে গল্পগুলি আমরা পেয়েছি তারা মজার তো বটেই, পাল্লা দিয়ে সামিল আছে ভয়ের পরিবেশও। উপভোগ্য ও উৎকৃষ্ট একটি সিরিজ।
শিশু-কিশোরদেরই টার্গেট অডিয়েন্স ভেবেই লেখা হয় ‘নিশুতিপুর’ গল্প, এটি অবিশ্বাস্য রকম বিশ্বাসযোগ্য এক দুঃস্বপ্নকে বিশদ করেছে। ...আঁধারপিয়াসী নিশুতিপুরের জনতা পুজো করে এক মহামহিম-কে এবং আলোর বিনাশ চেয়ে কামনা জানায় চির-রাত্রির। প্রেমেন্দ্র মিত্র এখানে ভৌতিক গল্প লিখতে চান নি কিন্তু এমন জাদুকরী আতঙ্ক তৈরি করেছেন যে একবার পড়লে তার ঘোর থেকে বেরিয়ে-আসা প্রায় দুঃসাধ্য। রূপকথা বলবার একরকম আধুনিক ফর্মই এখানে লেখক অনুসরণ করেন... সম্ভাবনার দিগন্তগুলি ঠেলে তা আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি হয়ে আছে।
আরও পড়ুন
পাঁচকড়ি দে-র ‘সাইকো’ – অলৌকিক নাকি অবাস্তবে-থাকা মনের পাগলামির গল্প?
Powered by Froala Editor