মুকুজ্জের দপ্তর - ৬
আগের পর্বে
শুধুমাত্র ‘ভূশণ্ডির মাঠ’ লিখেই অমর হয়ে যেতে পারতেন রাজশেখর বসু। ইহলোক এবং পরলোকের সঙ্গে স্যাটায়ারের মিশ্রণ করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। মজার কথা উঠলেই বলতে হয় শিবরামের কথাও। হাসির গল্পকে ভাবনাতীত ভয়ঙ্কর তোলার পাশাপাশিই ছড়ার ব্যবহারে শিবরাম যেন কোথাও মনে করিয়ে দেন সুকুমার রায়কেই। অবন ঠাকুরের লেখায় ভূত না এই অলৌকিকের স্পর্শ এলেও তা অতিজাগতিক মায়ায় ভরিয়ে তোলা। অনেকটা রূপকথা কিংবা লীলা মজুমদারের রচনার মতই ঘোর-লাগানোর। তবে রেলগাড়ির ভূত বিষয়ে চিরকালই অবসেশন রয়েছে বাঙালির। যা ধরা দিয়েছে প্রমথ চৌধুরী থেকে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে।
‘হন্টেড হাউজ’ নিয়ে গল্প কেমন ক’রে লিখতে হয় রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন; ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ পড়লে মনে হবে এর পরে আর গল্প হয় না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) আমাদের এই মনে-হওয়াকে দুরমুশ ক’রে দিয়েছেন। ‘মায়া’ নামক গল্পটি, এক কথায় – ইংরেজিতে বলি? – আউটস্ট্যান্ডিং (যার প্লটে ‘ক্ষুধিত...’-র রেফারেন্সও আঁচড়ে দেওয়া আছে) এবং তা বিভূতিবাবুর শ্রেষ্ঠ সব গল্পের (ধরা যাক ‘পুঁইমাচা’, ‘তালনবমী’, ‘ভন্ডুলমামার বাড়ি’ কিংবা ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’) ভূগোলে নিজের ইজারা বুঝে নিয়েছে।
একটি কুখ্যাত ‘বাড়ি’কে নিয়ে নবাগত ব্যাক্তির অবসেশন – (রবীন্দ্রনাথেও যা ছিল) তাই নিয়ে জমানো হয়েছে টেনশন। বিবরণ চলেছে হাল্কা সুরে এবং (সুরটি) কখনোই আতঙ্কিত হয় নি – কথকের রিল্যাক্সড ভঙ্গিটি অক্ষুণ্ণ থেকেছে। বাড়িটার কথা পাড়ার সবাই জানে, ও বাড়ি ভূতের বাড়ি, আগে যারা ছিল তারা কেউই আর ওখান থেকে বেরোতে চাইত না, দিনে দিনে বাড়ত তাদের পাগলামি... ওখানেই তারা মরে থাকত, তাদের চুষে না নিয়ে ছাড়ত না বাড়িটি। ...পাড়ার মুদি যখন জিজ্ঞেস করছে নবাগতকে, ‘তুমি (ওখানে) কোনও বউকে দ্যাখোনি? কোনও গন্ধ পাওনি? ফুলের সুগন্ধ?’- নবাগত অম্লান বদনে জানাচ্ছে - ‘না তো’!
...কী আশ্চর্য! তারই মুখে আমরা শুনেছি ঝিঙে-তুলতে-আসা রহস্যময়ী স্ত্রীলোক, বাতাস ম-ম করা অজানা ফুলের সুরভি কিংবা তারই খাট নিয়ে ভৌতিক নৃত্য – এগুলির ডিটেল। ‘তেল দাও চলে যাই; ওসব বাজে কথা’, নির্লিপ্ত মুখে মুদিকে বলছে সে। তার এই ভয়-না-পাওয়াই বরং আমাদের জমিয়ে দিচ্ছে – কেননা সে বুঝছেই না কী ভয়ংকর ফাঁদে সে পড়ে গেছে। তারই মুখে আরো শুনছি – ‘সেই থেকে দু বছর পড়ে আছি এই বাড়িতে। বাড়ি দেখাশুনো করি, বেগুন কলা বেচি, দিনরাত ওদের নৃত্য দেখি – এক-পা যাইনে বাড়ি ছেড়ে।’
এখানেই লেখক তাঁর কলম উইথড্র করছেন - যখন ‘বাড়ি’টি সক্রিয় এবং তার শিকার হিসেবে কথক নিজের বিপদ বুঝতে অক্ষম – অশুভের রাজত্ব কায়েম হয়েছে! যাকে বলে ‘ডেড এন্ড’ - কথকের আর উদ্ধার নেই; পাঠক হিসেবে আমরা সবই বুঝছি কিন্তু আমাদের হাত-পাগুলি বাঁধা। লোকটিকে চেঁচিয়ে ‘সাবধান!’ বলাও যাচ্ছে না কেননা এটি ‘সত্যি’ নয় – ‘গল্প’, কথক সেই বানানো গল্পেরই অলীক নায়ক।
‘মায়া’... উৎকর্ষের দিক থেকে অগ্রজ ‘ক্ষুধিত পাষাণ’কে ছাপিয়ে গিয়েছে মনে হয়।
আরও পড়ুন
বাংলার ভূতের গল্পে ননসেন্স ছড়াও জাঁকিয়ে বসেছিল দিব্যি
পরলোকে বিশ্বাস করতেন বিভূতিভূষণ, মৃত্যুর আগে একটি ‘ভৌতিক’ ঘটনাও তিনি প্রত্যক্ষ করেন ব’লে জানা যায় (নিজেই নিজের শব দর্শন)।... বিদেহীদের নিয়ে উপন্যাস ‘দেবযান’ কাল্ট হয়ে আছে। অত্যন্ত সার্থক কিছু হরর গল্পের তিনি লেখক – ‘রঙ্কিণী দেবীর খড়গ’, ‘ভৌতিক পালঙ্ক’ কিংবা ‘পেয়ালা’ অনেকেই পড়ে থাকবেন। একটা বিষয় লক্ষ্য করুন – এই তিনটি গল্পই (এবং ‘মায়া’ গল্পটিকেও যদি ধরি) একেকটি অশুভ ‘বস্তু’ (Object)-কে কেন্দ্রে রেখেছে; প্রথম গল্পে বেওয়ারিশ খড়গ, দ্বিতীয় গল্পে একটি চিনা পালঙ্ক, তৃতীয়টিতে একটি তুচ্ছ পেয়ালা এবং ‘মায়া’ গল্পে অবশ্যই আস্ত একটি বাড়ি। অশুভ কিংবা মন্ত্রঃপূত বস্তু নিয়ে প্লট তৈরির নমুনা বাংলাভাষায় আরো আছে – হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গল্প ‘বাজালে বাঁশি কাছে আসি’ (জাদুকরের ‘বাঁশি’ যেখানে অবজেক্ট) কিংবা সত্যজিৎ রায়ের ‘ফ্রিৎস’ (একটি ছোট্টো পুতুল যেখানে আতঙ্কের উৎস) কিংবা ‘ভুতো’ (ভেন্ট্রিলোকুইজমের পুতুল, যাতে ভুডু-জাদু আরোপ করা হয়েছে) এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়।
আরও পড়ুন
‘স্কল’, ‘স্কেলিটন’ কিংবা মজলিশি ভূতেরা – ত্রৈলোক্যনাথ থেকে উপেন্দ্রকিশোর
‘রঙ্কিনী...’-র খড়গ দৈবশক্তির আধার, এখানে ভূত নেই কিন্তু অতিপ্রাকৃত ভয় আছে। আসন্ন মহামারীর ইঙ্গিত জানাতে খাঁড়াটি রক্তে ভিজে যায় – অনার্য দেবী রঙ্কিণী এভাবেই আশ্রিতকে সতর্ক ক’রে দেন মন্ত্রঃপূত বস্তুর মাধ্যমে। ...‘ভৌতিক পালঙ্ক’-এ দেখি, চীনদেশের জনৈক মুমূর্ষু ব্যাক্তির অভিশাপে (ছোঁয়াচে রোগে যে মেঝেতে শুয়েই মারা গেছিল) পালঙ্কটি প্রতি রাতে ‘জীবিত’ হয়ে ওঠে এবং অতীত নাট্যের পুনরাভিনয় চলে ...তার অতৃপ্ত আত্মা কাউকে ওর ওপর শুতে দেবে না।
আরও পড়ুন
দীনেন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রভাত মুকুজ্জের হাড়কাঁপানো অশরীরী
আপাত-নিরীহ একটি পেয়ালায় কি কালো জাদু বুনে দেওয়া আছে (‘পেয়ালা’ গল্প দ্রষ্টব্য)? পাত্রটি থেকে যে-ই কিছু পান করে তার মৃত্যু তখনই সুনিশ্চিত হয়ে যায় (অনেকটা স্লো-পয়জনিং-এর ধরনে)। দূরে ফেলে দিলেও কীভাবে তা পথ চিনে ‘ফিরে’ আসে, হাত থেকে হাতে বদল হয় এবং কারণ হয় আরেকটি মৃত্যুর। লেখক যখন বর্ণনা করেন ‘পেয়ালাটা যেন জীবন্ত, মনে হল একটা ক্রূর বিষধর সাপের বাচ্চার গায়ে হাত দিয়েচি, যার স্পর্শে মৃত্যু... যার নিঃশ্বাসে মৃত্যু’, পাঠক হিসেবে আমাদেরও গা ঘিনঘিন ক’রে ওঠে, কাঁটা দেয়।
আরও পড়ুন
পাঁচকড়ি দে-র ‘সাইকো’ – অলৌকিক নাকি অবাস্তবে-থাকা মনের পাগলামির গল্প?
কালো জাদু এবং প্রাচ্য ‘তন্ত্র’ নিয়ে বিভূতিভূষণের আগ্রহ যথেষ্টই ছিল – যার শ্রেষ্ঠ নমুনা পাই ‘তারানাথ তান্ত্রিক’কে নিয়ে লেখা দুটি গল্পে। শিক্ষানবিশ তারানাথ, শ্মশানস্থ ‘পাগলী’, হাঁকিনী-ডাকিনী, রূপসীর শব, প্রেতায়িত রাত্রি, তন্ত্রসাধনার বীভৎস সব ডিটেল – সমস্তই আছে প্রথম গল্পে। দ্বিতীয়টিতেও অতিপ্রাকৃত লভ্য- তবে এতে মনস্তত্বের স্থানই উঁচু, ভয়ের চেয়েও যৌন মাদকতা (বলা ভালো ‘শৃঙ্গার’) এর মুখ্য রস হয়ে উঠেছে। প্রৌঢ়, দরিদ্র, চন্দ্রদর্শন-জানা তারানাথের জবানিতে কাব্যগুণ ও সিনেমাটিক গুণ বিশেষ ক’রে পরখ করবার। গুহ্য সাধনা নিয়ে এই রকম জীবন্ত ডকুমেন্টেশন ‘ভারতের সাধক সাধিকা’, ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ কিংবা ‘তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ’ বইগুলিতে আমরা পেয়ে থাকব।
আরও পড়ুন
বাংলা-র সবচেয়ে পুরোনো ভূতের গল্পটি কি আছে রূপকথার বইতেই?
‘নুটি মন্তর’ গল্পটিও গুহ্যসাধনা কিংবা গোপন মন্ত্রকে নিজের কেন্দ্রে রেখেছে। নুটি মন্তর আসলে অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র। ‘তারানাথ তান্ত্রিক...’-এও যেমন দেখি – পাগলী’র জাদুতে অতি অল্প সময়কে দীর্ঘ সময় বলে মনে হয়েছে তারানাথের ( হ্যালুসিনেশন), এখানেও তা লভ্য - শিক্ষানবিশ হাবু মাত্র সাত মিনিটকে সাত দিন ভেবে আতঙ্কিত হয়। ঘোর কেটে গেলে, নুটি-মন্ত্রে সিদ্ধ গুনিন আড়ষ্ট হাবুর সামনে অট্টহাসি করতেই ...‘এক ঝাঁক চামচিকে হাঁ-করা মুখের মধ্যে থেকে পটপট শব্দে বের হয়ে ইতস্তত উড়ে গেল’ – ইমেজ হিসেবে যা আন্তর্জাতিক আবেদনের।
পাঠকেরা জানেন, স্বয়ং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু নিয়ে যে ভৌতিক গল্পটি প্রচলিত, যার উল্লেখ আগেও করেছি - সেটি তাঁর লেখা গল্পগুলির চাইতে কিছু কম ভয়ের না।...
Powered by Froala Editor