‘স্কল’, ‘স্কেলিটন’ কিংবা মজলিশি ভূতেরা – ত্রৈলোক্যনাথ থেকে উপেন্দ্রকিশোর

মুকুজ্জের দপ্তর - ৪


আগের পর্বে


‘রহস্য লহরী’ সিরিজের স্রষ্টা দীনেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন ভূতের গল্প লেখায় দক্ষ। তাঁর লেখা ছিল বিলেতি ধাঁচের, এপিসোডিক, এবং টানটান বর্ণনায় মোড়া। ভূতের গল্প লিখেছেন ছোটগল্পের পায়োনিয়র রবীন্দ্রনাথও। তবে তাঁর ‘ভৌতিক’ গল্পেও প্রায় কবিতার ছাপ। ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ গল্পে দম-আটকানো পরিবেশ তৈরি করেও শেষে গল্পের মোড়ক পরিবর্তন করে ফেলেছেন তিনি। তবে ভৌতিক গল্পের বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশনার কথা বললে গেলে উল্লেখ করতেই হবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের নাম। ভয়ের গল্পের এক অনন্য নজির তৈরি করেছিলেন তিনি। সে ব্যাপারে নানান কথাও বলেছেন হরর ফিকশনের আরেক মাস্টার হুমায়ূন আহমেদ। তারপর...


 

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭ – ১৯১৯) উদ্ভট রসের গল্প উপন্যাস লিখবার কারণে অমর হয়ে আছেন। চেনা বাস্তবের মধ্যে অতিপ্রাকৃত হাওয়া বইয়ে দিতে তাঁর অর্জন - তুলনাতীত। ‘ভৌতিকতা’ - লেখকের অতি কমন টপিক। ...প্রথম উপন্যাস ‘কঙ্কাবতী’-তেও হরেক তামাশা জুগিয়েছে প্রেতেরা। ভূতিনী ‘নাকেশ্বরী’কেই ধরুন না। নায়ক খেতু-র সঙ্গে নাগাড় মরবিড আচরণ ক’রে গেলেও তাকে ভয় লাগে না বরং হেসে খুন হতে হয়। ‘স্কল ও স্কেলিটন কোম্পানি’-র দুই অংশীদার নরমুণ্ড ও নরকঙ্কাল (আগে একটি ‘পুরা’ লোক ছিল)-  এরাও প্রাণপণ ভয় দেখাতে চেয়েছে খেতুকে।  মুণ্ডুটি মেঝেয় ‘ড্রপ’ খেতে খেতে এগোচ্ছে, কিংবা... খটখটিয়ে হাঁটছে ধড় হিসেবে কঙ্কাল – ইমেজগুলি হরর-সাহিত্যের অপরূপ ক্যারিকেচার। 

‘লুল্লু’ গল্পটিও বাস্তব ও ফ্যান্টাসির দ্বন্দ্ব-সমাস। ‘ঘ্যাঁঘো ভূত’ সহ অন্য বিদেহীরা আধুনিক বাংলা ভাষার সমান আয়ু নিয়ে এসেছে, মুকুজ্জের দপ্তর তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ-‘জীবন’ কামনা করছে।   

আরও পড়ুন
দীনেন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রভাত মুকুজ্জের হাড়কাঁপানো অশরীরী

‘ভূতের বাড়ি’ নামে যে গল্পটি ত্রৈলোক্যবাবু ফেঁদেছেন সেটিকে সার্থক হরর-ফিকশন বলা যায়। কুখ্যাত হন্টেড হাউজ-এ রাত কাটাতে এসে গা-শিউরানো সব দৃশ্য দেখেন টমসাহেব। এখানে লক্ষ্য করবার যে প্রতিটি ‘খেলা’ই হচ্ছে গ্রোটেস্ক, তামাশাযোগ্য নয় বরং আপাদমাথা ভয়ের। ‘খেলা’র অন্তে সাহেব প্রাণে বেঁচে যান বটে, অশরীরী না মেনে উপায় থাকে না। তাঁরই পরামর্শ শুনে উপদ্রুত ঘরের মেঝে খুঁড়লে কিছু ‘অদ্ভুত’ দ্রব্য মেলে – যার কোনও বিশদ বর্ণনা ‘কথক’ হিসেবে টম সাহেব দেন নি। আমরা আন্দাজ করতে পারি যে সেগুলির ব্যাক-স্টোরি আছে, কোনও পুরাতন বিভীষিকার তারা সাক্ষী। গদ্যের সংযম এখানে প্রথম শ্রেণির টেনশন তৈরি করেছে। - বিলিতি গল্পের ছায়া আছে? থাকতে পারে। 

‘পিঠে পার্বণে চিনে ভূত’ (*) গল্পটি বিরল জাতের। অট্টহাসি ও ছমছমে ভয় দুইই এখানে সম ভাবে লভ্য।  হাতকাটা চিনে ম্যানের ভূত ও বৃদ্ধ বাঙালি সার্জেনকে নিয়ে যে রগড় ও দুঃস্বপ্ন জমানো হয়েছে, পৃথিবী গ্রহে তার জুড়ি নেই এবং কোনোদিন পাওয়া যাবে এমন আশাও নেই। ত্রৈলোক্যনাথের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে ‘কঙ্কাবতী’ ও ‘ডমরু’ গ্রাহ্য; ‘...চিনে ভূত’কেও এই মর্মে কালির ছাপ্পা দেওয়া হল।  

আরও পড়ুন
পাঁচকড়ি দে-র ‘সাইকো’ – অলৌকিক নাকি অবাস্তবে-থাকা মনের পাগলামির গল্প?

(* খগেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প ‘ম্যমির জীবন্ত হাত’-এর সঙ্গে ‘পিঠে পার্বণে...’-এর আঁতাত আছে কি? আশা করছি পরে বিস্তারে বলা যাবে। )        

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩ – ১৯১৫), যাঁর প্রশংসায় কোনও বাক্যই যথেষ্ট নয়, তিনি আগাগোড়া কয়েকটি ভূতের গল্প লিখেছেন, তবু সেগুলি ভয়ের না থেকে হয়েছে মায়াময়।  ‘জোলা ও সাত ভূত’ গল্পেই দেখুন।  ভূতের অভাব নেই, ভূতুড়ে কাণ্ডেরও কি নয়? ...অথচ গল্প পড়ে আমরা যা পাই তা হচ্ছে নির্মল আনন্দ, যেমনটা কিনা রূপকথার গল্প পড়লে হয়ে থাকে। হাসি দিয়ে সিক্ত ও সারল্য দিয়ে স্নিগ্ধ - আর কী বলা যায় একে? ‘কুঁজো আর ভূত’ গল্পটিও যদি ধরি।

আরও পড়ুন
বাংলা-র সবচেয়ে পুরোনো ভূতের গল্পটি কি আছে রূপকথার বইতেই?

‘সেই পুরনো বাড়িটার ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে অনেকগুলো গলা মিলে। আহা, কি সুন্দর সুরেই গাইছে। শুনে কানাইয়ের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সে অবাক হয়ে খালি শুনতেই লাগল। গানের সুরটি অতি আশ্চর্য, কিন্তু কথা খালি এইটুকু,

‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইমলি হ্যায়, হিং হ্যায়!’

কুঁজওলা কানাইও ঝট ক’রে তখন পরের লাইন বানিয়ে ফেলেছে এবং চেপে রাখতে না পেরে গেয়েও দিয়েছে,

‘লসুন হ্যায়, মরিচ হ্যায়, চ্যাং ব্যাং শুঁটকি হ্যায়।’

ভূতেরা অসম্ভব খুশি হয়ে কানাইকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এসে সোৎসাহে গান জুড়েছে, নাচ শুরু করেছে এবং লাভের মধ্যে সেরে গিয়েছে কানাইয়ের কুঁজ! 

 

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

ভূতেদের এই কনসার্ট প্রীতি তথা মজলিশি মেজাজ দেখা যাচ্ছে আরো অন্যত্র, 

‘এমন সময় তাদের দু’জনারই মনে হল, যেন চারিদিকে একটা কি কাণ্ড হচ্ছে। ঝাপসা ঝাপসা কালো কালো, এই বড় বড় কি যেন সব গাছের উপর থেকে উঁকি মারতে লেগেছে। তাদের চোখগুলো জ্বলছে যেন আগুনের ভাঁটা, দাঁতগুলো বেরুচ্ছে যেন মুলোর সার। ...তাদের গায়ে এমনি কাঁপুনি আর দাঁতে এমনি ঠকঠকি ধ’রে গেল যে, আর তাদের ছুটে পালাবারও জো রইল না।’

এই ‘দুজনে’ আসলে কে, পাঠকেরা সকলেই বুঝেছেন। গুপি-বাঘার গান বাজনা শুনে  ভারি খুশি হয়েছে অরণ্যের ভূতেরা এবং ফরমাশ করেছে আরো গাইবার, 

‘থামলি কেন বাপ? বাজা, বাজা, বাজা!’

এবং এহেন উৎসাহ পেয়ে অতঃপর...

...‘গুপির আর বাঘার একটু সাহস হল। তারা ভাবল, ‘এ ত মন্দ মজা নয়, তবে একটু গেয়েই দেখি না।’ এই ব’লে যেই তারা আবার গান ধরেছে, অমনি ভূতেরা একজন দুজন ক’রে গাছ থেকে নেমে এসে তাদের ঘিরে নাচতে লাগল।

তার পরের কথা আর বলে কাজ নেই কেননা তা হ’লে মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প হয়ে যাবে। পাঠকের প্রতি বিশ্বাস আমাদের অসীম। মোটামুটি যা বলতে চাইছি – খাঁটি ভূতের গল্পে কিংবা ভৌতিক এপিসোডে এমন সহজ হাওয়া-বাতাস যে চালানো যায়, তার মহৎ নমুনা হিসেবে উপেন্দ্র-সাহিত্য দিব্য জলজ্যান্ত আছে।

(চলবে) 

Powered by Froala Editor