মুকুজ্জের দপ্তর – ১২
আগের পর্বে
বাঙালির দুই দাদা— টেনিদা এবং পিনডিদা দু’জনের মুখে মুখেই এসেছে তাঁদের নাম। ‘ভূতের’। টেনিদা উবাচে ‘দশাননচরিত’-এ এক পকেটমার, দশানন সোঁদরবনে নির্বাসিত হয়ে উঠেছিল এক ভূতুড়ে কেল্লায়। ফিরেছিল ভূতের পকেট মেরেই। ‘পিনডিদার মানবিক ভূত’ গল্পে এক কুখ্যাত হন্টেড ক্যাশেলে ঠান্ডা জলে স্নান করিয়েই ভূতকে শায়েস্তা করেছিলেন পিনডিদা। এমন মানহানির পর আত্মহত্যা করেছিল সেই সাহেব ভূত। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গল্প এভাবেই ভূতকেও মানবিক করে তুলেছিল অনায়াসেই।
বাংলায় লেখা গল্পের সংকলন সবচেয়ে বেশি যদি কিছু থাকে ও বাজার-জাত হয়, তো দেখবেন সেটা হচ্ছে ভূতের। এর কারণ কী, মন কিংবা সমাজের তাত্ত্বিকরা নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে বহুতর ভালো জানবেন এবং বলতে পারবেন। পপুলিস্ট রুচির জন্য ছাপা এই সংকলন-সমুচ্চয়ে ঘনঘনই সেই গল্পটা পাওয়া যাবে – যার নাম ‘হলুদপোড়া’, লেখক – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)। অত্যন্ত বিশিষ্ট ও চমৎকার গল্প; কিন্তু ভৌতিক গল্প কিনা এই নিয়ে এখনই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া যুক্তিবাদী ছিলেন এবং ভূতটূত নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাতেন ব’লে খবর নেই। দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যা খাপ খেত না তা নিয়ে তিনি সচরাচর লিখতেন না।... ‘হলুদপোড়া’ তিনি লিখেছেন – মনে তো হয় – একটি সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক ‘ময়না-তদন্ত’ হিসেবে। মনের বিকার ও কুসংস্কার কীভাবে কোণঠাসা ব্যাক্তিকে আক্রমণ ও গ্রাস করতে পারে – এই নিয়ে প্রবন্ধও লেখা যেত, লেখক বেছেছেন গল্পের ফর্ম যা তাঁর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।
গল্পে আমরা দেখছি অনেকগুলি উপসর্গ আছে যেগুলি ‘ভৌতিকতা’র সালিশি করে... যথা – জোড়া খুন, স্ত্রীলোকের উপর প্রেতিনীর ‘ভর’, রোজা-র ঝাড়ফুঁক (খুঁটিতে চুল বেঁধে মাটিতে শুইয়ে রাখা এবং হলুদ পুড়িয়ে নাকের সামনে ধরা যার একটি নিয়মিত প্র্যাকটিস), বাড়ির সামনে লম্বা বাঁশ শুইয়ে ‘গণ্ডি’ কেটে রাখা (যাতে প্রেতাত্মা সেটি ডিঙিয়ে না আসতে পারে)... এই সমস্ত কিছুই পাঠকের নির্জ্ঞানে ডাম্প-হওয়া আতঙ্ক-ইমেজে টোকা মারে!
আরও পড়ুন
সমাজে প্রেস্টিজ বজায় রাখতে আত্মহত্যা করেছিল সেই ভূত!
আক্রান্ত মনগুলিতে যদি নির্মোহ, বৈজ্ঞানিক, চড়া আলো ফেলি; নিহত যুবতী শুভ্রা ও নিহত প্রৌঢ় বলাই চক্রবর্তীর প্রেত যে জন্য ‘দায়ী’ সেই ‘ভূতের ভর’-কে ঠাহর করা যাবে যৌন-অবসেশনের অভিব্যক্তি হিসেবে। বোনের হত্যা নিয়ে দাদা ধীরেনের ইনসেসচুয়াস অপরাধবোধই কি তাকে বানিয়ে তুলেছে ‘বলাই চক্রবর্তী’ – যে নিজের বাড়ির সামনে রাখা গণ্ডিটিও ডিঙিয়ে আসতে ব্যর্থ হচ্ছে?
আরও পড়ুন
বৃক্ষের ‘ভূত’ও অমিল হয়নি আমাদের ভৌতিক সাহিত্যে!
সত্যিই কি ভূত নাকি যা-ব্যাখ্যা পাচ্ছি-তাই? - লেখক খুলে বলেন না কারণ তিনি যা চেয়েছেন সেই কাঙ্ক্ষিত আবেগ ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে যায়। ইংরেজিতে যাকে বলে Bizarre, বাংলায় আবছা তর্জমা করা যাক ‘অস্বস্তিকর’ - সেই রসের গল্প হিসেবে ‘হলুদপোড়া’-র স্পর্শক... ‘ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞান’ ও ‘প্যারানর্মাল’ এই দুই বৃত্তকেই ছুঁয়ে আছে।
আরও পড়ুন
প্ল্যানচেটে সত্যি সত্যি এলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল... লিখছেন আশাপূর্ণা দেবী
আরও পড়ুন
হেমেন রায়ের ড্রাকুলা, পিশাচ-কাহিনি এবং আরও
কিছুটা খেদের সঙ্গেই কেউ কেউ বলেন, বাংলায় ভৌতিক গল্পগুলি অনেক সময়েই তেমন ভয়ের হয় না – বরং হয়ে যায় লঘুপাঠ্য। ইউরোপ কি মার্কিনদেশের সঙ্গে তুলনা করলে অবশ্য খেদটা তত বেঠিক নয়। ও-দেশে স্টিফেন কিং, পিটার ব্লেটি, ইরা লেভিন-রা গপ্পো লিখে বহু পাঠকের রাতের ঘুম নষ্ট করার কারণে ‘কুখ্যাত’। বাংলা-তে খুঁজলেই ‘এক্সরসিস্ট’, ‘রোজমেরিজ বেবি’ কিংবা ‘ক্যারি’র মতো হরর-কাহিনি পাওয়া যাবে না; এমন হতে পারে যে আমাদের হাড়গুলি কাঁপবার জন্য (শীতদেশে যেমন...) তত মজবুত নয় বলেই আমাদের লেখকরা ‘যথেষ্ট’ ভয়াল রস গপ্পে ঢালেন না!
আরও পড়ুন
বাংলা গল্পে আতঙ্কের উৎস যখন ‘উইচক্রাফট’ ও ‘কালো বিড়াল’
এই সব অনুযোগ ও ইয়ার্কির উদ্দেশে একটি চার কি পাঁচ পাতার গল্প নম্রভাবে পেশ করা হচ্ছে। বিদেশি হররের চেয়ে এটি ন্যূন তো নয়ই – বরং, ইংরেজি কি স্প্যানিশে লেখা হলে গল্পটির ভাগ্যে ‘ব্রাম স্টোকার লিটেরারি অ্যাওয়ার্ড’ জাতীয় কিছু জুটে যেতে পারত। ...পাঠক! দেহে ভৌতিক সংক্রমণ নিয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (‘দেহান্তর’) কিংবা হেমেন রায়ের (‘মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী’) গল্প আপনারা পড়েছেন; কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯১৭-১৯৭৬)-এর ‘গিন্নি-মা’ পড়ার সময় সেইসব অভিজ্ঞতা ভুলে যান কেননা তাতে আপনারই ফায়দা।
আরও পড়ুন
অশুভ ‘বস্তু’, অভিশাপ ও তন্ত্র বারেবারেই এসেছিল বিভূতিভূষণের গল্পে
..অথর্ব ও স্থূলকায়া বয়স্কার বাড়ি কাজ করতে আসে যুবতী মেয়েগুলো, অথচ মাসখানেকও টেঁকে না। কথা বলতে, চলতে-ফিরতে শুরু করে মালকিনের নকল ক’রে। এবং তার চেয়েও বড় কথা – নিজেকে সাত-তাড়াতাড়ি তারা খুন ক’রেই বা বসে কেন? – এই জিজ্ঞাসা গল্পের নায়িকাকে ভিতরে রক্তাক্ত করলেও... ‘পেটের দায় বড় দায়’ মেনে সে কাজে বহাল হয়। ক্ষুদ্রাকার চোখের, মাংসময় মুখের, অশালীন মন্তব্যকারী গিন্নি-মা দ্রুতই তার গা ঘিনঘিনের কারণ হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন
বাংলার ভূতের গল্পে ননসেন্স ছড়াও জাঁকিয়ে বসেছিল দিব্যি
আজই তার প্রথম দিন ছিল। কাজ সাঙ্গ হতে বেশি ক্ষণ লাগে না। বরাদ্দ চা বানিয়ে নায়িকা দিতে আসছে গিন্নিমা-র জন্য, বিছানা থেকে যিনি এক-পাও নড়তে পারেন না... পক্ষাঘাত কেবল তাঁর হাতদু’টিকেই কর্মক্ষম রেখে গিয়েছে... স্কুটার নিয়ে এখুনি স্বামী এসে পড়বে বলে যখন যুবতী উশখুশ করছে; তার ও আমাদের চেতনা মুছে সহসা এক অন্ধকার ‘কোমা’ তৈরি করে দেন লেখক – সলতেতে আগেই আগুন দেওয়া প্লট নামক ‘ডিনামাইট’টি এখানে সশব্দে ফেটে যায়। আবিষ্কৃত হয়, কচি বয়সের প্রতি গিন্নিমা-র অকথ্য লোভ ও মর্বিড জিঘাংসা থেকে যুবতীর – ও আমাদের – কারোরই রেহাই নেই।
আরও পড়ুন
‘স্কল’, ‘স্কেলিটন’ কিংবা মজলিশি ভূতেরা – ত্রৈলোক্যনাথ থেকে উপেন্দ্রকিশোর
তা অনেকদিন হল ভৌতিক গপ্পো নিয়ে দপ্তর চালালেও মুকুজ্জে কখনো তার ‘টপ ফাইভ’ মনোনয়ন দেয় নি। এখন দিচ্ছে। ...প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘একটি ভৌতিক কাহিনি’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘গল্পের শেষে’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘নিমপাখি’, হুমায়ূন আহমেদের ‘কুটু মিয়া’ এবং আজ যা নিয়ে বিস্তারে বলা হল - কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘গিন্নি-মা’।
আরও পড়ুন
দীনেন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রভাত মুকুজ্জের হাড়কাঁপানো অশরীরী
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পাঁচকড়ি দে-র ‘সাইকো’ – অলৌকিক নাকি অবাস্তবে-থাকা মনের পাগলামির গল্প?