বৃক্ষের ‘ভূত’ও অমিল হয়নি আমাদের ভৌতিক সাহিত্যে!

মুকুজ্জের দপ্তর – ১০

আগের পর্বে

‘তেনাদের’ কথা বলতে গেলে আশাপূর্ণা দেবীর প্রসঙ্গ তো আসবেই আসবে। আশাপূর্ণা দেবীর ভয়ের গল্প, উপন্যাস পড়া শুরু করলে হাসি পাবে, হাসি পেতে বাধ্য। কিন্তু তারপরই ধীরে ধীরে সেই মজা পাল্টে যাবে ভয়াবহতায়। শুকিয়ে আসবে গলা। এমনই তাঁর লেখনীর বুনন। ‘চারা পুঁতে গেলেন নান্টুপিসে’ উপন্যাস তেমনই এক সৃষ্টি। যেখানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকেও প্ল্যানচেটে হাজির করেছিলেন নান্টুপিসে। তবে শেষ অবধি দেখা গিয়েছিল তিনি নিজেই অশরীরী। ভূতেদের বাসস্থান-সংকটও ধরা দিয়েছে আশাপূর্ণা দেবীর লেখায়। অর্ধশতক পেরিয়ে সেই আধুনিক ভৌতিক আখ্যান তাই আজও অমর, লা-জাবাব...

সেই গাছটা ছিল বিরাট। তখন ব্রিটিশ আমল; সাজা পেলেই ফাঁসিতে লটকে দেওয়া ছিল হরবখত প্র্যাকটিস। উক্ত গাছের ডালগুলি যে খুবই কাজে লেগেছিল – বলা বাহুল্য। রাতের বেলা, গল্পের কথক স্মরণ করছেন, কেউ কেউ দেখেছে – ফাঁসি-দেওয়া শব (একটি নয়, অনেকগুলি) ঝুলছে সেই গাছ থেকে;   অতীত হত্যা-দৃশ্যের পুনরাভিনয়। গাছটার নাম লোকে দিয়েছিল মোক্ষম – ‘ফাঁসি গাছ’।

প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-১৯৮৫) আমাদের ভাষায় তাজ্জব কাণ্ড ঘটান এই শিরোনামেই গল্পটি লিখে (‘ফাঁসি গাছ’)। আমরা এতদিন মানুষ, পশু, এমনকি জড়বস্তুকেও ভৌতিকতার কেন্দ্র-বস্তু হয়ে উঠতে দেখেছি এবং তাতেই অভ্যস্ত থেকেছি। গাছের প্রাণ আছে তা জানা থাকলেও গাছের ‘ভূত’ বলে কিছু এমনিতে ধারণায় আসে না। প্র-না-বি (কিংবা গল্পের কথক) সাক্ষাৎ ‘গাছ’টিকেই মৃত বলে জানতে পারেন – যখন স্থাবর ‘অপচ্ছায়া’ যথাস্থলেই দণ্ডায়মান থেকেছে।

প্রমথনাথ বিশী

 

বহুদিন পর গাঁয়ে ফিরেছেন কথক, তখনই স্মৃতি থেকে জানাচ্ছেন অভিশপ্ত গাছের কথা, অন্ধকারে এইমাত্র যাকে ঝুপসি হয়ে থাকতে দেখলেন চলমান গোরুর গাড়ি থেকে। ‘আগে এই পথ দিয়ে যাওয়া-আসা ভারি মুশকিল ছিল বাবু, অনেকে ভূতের ভয় পেত’, কিছুটা পথ পেরিয়ে নিজে থেকেই গারোয়ান বলে, ‘ফাঁসিগাছটা ছিল কিনা!’ ... ‘আগে কেন বলছ?’ কথক শুধোলে জবাব আসে ‘এখন তো গাছটাই নেই। গত কালবোশেখিতে ভেঙে পড়েছে। যেমন দেখলেন!’ - যেমন দেখলাম? – কথক আঁতকে উঠে ভাবেন, ‘আমি তো বাপু পুরো গাছটাই দেখলাম!’ ...ফাঁসি-দৃশ্য যদি ফিরে অভিনীত হয় তবে মৃত গাছের পুনরাবির্ভাবই বা সম্ভব নয় কেন?

উল্লেখ করা উচিৎ যে, গাছকে ভৌতিক বস্তু ক’রে গল্প লেখার কাজ করেছেন বাংলাদেশের লেখক ইমদাদুল হক মিলন-ও। ‘ভূতগাছ’ নামে গল্পটিতে ফ্যান্টাসি ও হরর জঁরের চমৎকার মিশেল রয়েছে।  

‘অকৃতজ্ঞ’ নামে এক মরবিড ভূতের গল্প লিখেছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), রিভেঞ্জ-কাহিনি হিসেবে তাকে লোম-খাড়া-করা বললে ভুল বলা হয় না। বহুদিন খোঁজ-খবর নেই এমন ভাগনে ফিরে এলে গল্পের প্রটাগনিস্ট কেশব অসন্তুষ্ট হয়েছিল। রোগা টিংটিঙে, মলিন যুবকটি অবশ্য বেশি কিছু চায়নি – একটি রাতের আশ্রয় বাদে। বাপ-মা-মরা সন্তান হিসেবে কেশবের কাছেই সে পালিত হয়, বড় হলে আর থাকেনি যোগাযোগ। ...গৃহস্বামীর কাছে তবু তার আবদারটি উটকো ঝামেলা ঠেকে। ইদানীং এ-পাড়ায় ডাকাতের উৎপাত খুব বেশি, প্রায় রাতেই ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে ডাকাত পড়ছে এবং চলছে লুটপাট। ...সে-রাতটা থাকতে দিলেও একটা অস্বস্তি কেশবের রয়ে যায়। 

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

 

রাত যখন নিশুতি, প্রচণ্ড শোরগোল ওঠে। ডাকাত পড়ল নাকি? ... ভীষণ ভয় পেয়ে কারা যেন পালিয়ে যাচ্ছে! কেশব ও তার স্ত্রী কাঠ হয়ে সেই শব্দ শোনে। অতিথির ঘরে এলে দেখা যায় - সে নিখোঁজ। দম্পতীর সন্দেহ থাকে না যে ভাইপোই ডাকাতের দলের চর। কিন্তু কী দেখে তারা পালাল? বারেবারেই কেশব এরপর আক্রোশ জানাবে, এতবড় বেইমানি সে কল্পনাও করেনি!  

অন্য একটি রাতের ঘটনা। আরো-একটি শোরগোল দূরে চলে গেলে মলিন যুবকটি ফের অতিথি হিসেবে দেখা দেয় এবং বিষাক্ত হেসে জানায়, ‘আমি দু-দুবার ডাকাতের হাত থেকে আপনাকে বাঁচালাম আর আপনি আমায় অকৃতজ্ঞ বলছেন? আমাকে দেখেই ডাকাতেরা পালিয়েছিল।’ কেশবের বিশ্বাস হয় না, এই হাড্ডিসার চেহারাকে কেনই বা ভয় পাবে ডাকাতরা!  

নিজের আসল ‘রূপ’ সে এবার দেখায়, খণ্ড খণ্ড মাংস খুলে পড়ছে শরীর থেকে এবং জেগে উঠছে খলখল হাসি... অধিক বর্ণনায় যাব না। পরে খোঁজ নিলে জানা যাবে, বছর খানেক আগেই রেলে কাটা পড়ে যুবক মরেছিল। দম্পতী বিলাপ করতে বসে এবং দ্যাখে - সরু আর কালো হাতটা চোখের জল মুছিয়ে দিতে আসছে; ...‘কাঁদতে বসাও বিড়ম্বনা।’   

বিগত শতকের মড়ক ও মন্বন্তর বাঙালির ইতিহাসে শোধনের-অতীত ক্ষত এবং সাহিত্যে বহু চর্চিত একটি বিষয়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭০)-এর ‘মধ্যরাতের আতঙ্ক’ গল্পটি ভৌতিক এবং তার একটি পিলার যদি হয় ভয়ালতা তবে অন্যটি হল কাল-চেতনা। এমন গল্প খুব বেশি নেই যেখানে ‘ভৌতিক’-এর ভয় বেরিয়ে এসেছে ইতিহাসের সুড়ঙ্গ দিয়ে, প্যারানর্মাল ঘটনাকে দেখানো হয়েছে আসন্ন অশুভের রূপক হিসেবে।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 মৃত্যুঞ্জয় – গল্পের নায়ক – দয়াপরবশ হ’য়ে রাতের বেলা এক পাগড়িপরা আগন্তুককে আশ্রয় দেয় এবং আরো বেশি রাত হলে এক বিচিত্র দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। লোকটি বাইরে এসে আগুন জ্বালিয়ে কী করছে এটা? কালো মেঘের মতো পোকাদের প্রকাণ্ড ঝাঁক এল কোথা থেকে? রাতের আগন্তুক কিংবা প্রেতায়িত অবয়বটি তাকে বিকট হাসির সঙ্গে কী জানিয়ে যাচ্ছে? - অগ্রদূত সে, এই পোকার দলই তার পিছু পিছু নিয়ে আসবে অমঙ্গল ও সর্বনাশ, লাগবে মড়ক, শেয়াল কুকুরে মনুষ্যদেহ ছিঁড়ে খাবে, দাহ করবার লোক অবধি থাকবে না – ছারখার হয়ে যাবে সোনার বাংলাদেশ!   

শেষে নয়, গল্পের শুরুতে লেখক রেখেছেন মাস্টারস্ট্রোক। - বিগত মড়ক ও মন্বন্তরের কথা কেউ আঁচও করেনি, কেবল একজন ছাড়া। ...সে সবকিছুই জানত। ...তার কথাই এখানে বলা হবে। 

সেই লোকটি হল মৃত্যুঞ্জয়।      

Powered by Froala Editor