সারা পৃথিবীতে করোনা মহামারীর সময় সমস্ত ধরনের সামাজিক জমায়েত বন্ধ। এমনকি বন্ধ লাইব্রেরি পরিষেবাও। এই সময় এক ধরনের বিকল্প উদ্যোগ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তার নাম ওপেন ফ্রি লাইব্রেরি। এই ধরনের লাইব্রেরিতে সদস্য হওয়ার বালাই নেই, নেই পড়ার সময় অখণ্ড নীরবতা পালনের কড়া নিয়মও। রাস্তার ধারেই বুক সেলফের মধ্যে সাজানো থাকে বই। পথচলতি মানুষ সেখান থেকেই বই নিয়ে রাস্তার ধারেই পাতা উলটে পড়াশোনা করেন। অথবা ইচ্ছা হলে বই বাড়ি নিয়ে যান। আবার সময় মতো ফিরিয়ে দেন সঠিক জায়গায়। কেউ কেউ আবার নিজের ইচ্ছা অনুসারে বই দানও করেন। কোথাও কোনো নাম প্রকাশের প্রয়োজন নেই। কোন বই কে রেখে গেলেন, বা কে নিয়ে গেলেন কেউ দেখতে যাবে না।
ভাবছেন নিশ্চই কোনো বিদেশের শহরের কথা বলছি। হ্যাঁ করোনা পরিস্থিতিতেও বিদেশের নানা শহরে এমন নানা স্ট্রিট লাইব্রেরি ওরফে পথ-লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে। কিন্তু ভারতের বুকেও যে এমন অসংখ্য পথ-লাইব্রেরি ছড়িয়ে আছে, তার খবর আমরা রাখিনি। না, শুধু করোনা পরিস্থিতিতেই নয়, তার অনেক আগে থেকেই ভারতে শুরু হয়েছে এমন উদ্যোগ।
২০১৬ সালে তিরুবন্তপুরমের মানাভিয়াম বিধি এলাকায় গড়ে উঠেছে এমনই একটি পথ-লাইব্রেরি। স্থানীয় এক সাংস্কৃতিক কর্মী রতীশ রোহিণী এই কাজের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, প্রথম প্রথম হয়তো অনেকেই বই নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দিয়ে যাননি, কিন্তু সামগ্রিকভাবে ছবিটা একদমই সেরকম নয়। মানুষ এই লাইব্রেরিকে সহজেই আপন করে নিয়েছেন। অনেককেই দেখা যায় রাস্তায় ফুটপাতে বসেই বই পড়ছেন। কেউ বই নিয়ে চলে যান পাশের কোনো রেস্টুরেন্টে। তবে সব থেকে বেশি সাড়া মিলেছে স্থানীয় অটো-রিক্সা চালকদের কাছ থেকে। তাঁরা প্রতিদিনের সংবাদপত্র পড়ার কাজটা এখানে দাঁড়িয়েই সেরে নেন।
এমনই আরেকটি উদ্যোগ দেখা গিয়েছে মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে। সেটা গতবছর, ২০১৯ সাল। স্থানীয় এক সাংবাদিক চাংতে তাঁর বাড়ির কাছেই তৈরি করেছিলেন ছোট্ট একটি লাইব্রেরি। অবশ্য কতদূর সফল হবে এই উদ্যোগ, তা নিয়ে সন্দেহ ছিলই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সাড়া মিলতে শুরু করে। বিশেষ করে এখানে স্কুল পড়ুয়াদের আগ্রহ দেখার মতো। তাদের কারোরই যেন ঠিক প্রথাগত লাইব্রেরির নিয়ম মেনে বই পড়তে ভালো লাগে না। এখানে ব্যাপারটা খোলামেলা, তাই শিশুদের মনকে আকর্ষণ করে গিয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতেই আরও এক উদ্যোগ গড়ে উঠেছে অরুণাচল প্রদেশের নির্জুলি গ্রামে। আজ যখন সমস্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ, পড়াশোনার একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ইন্টারনেট; তখন নতুন করে ভাবনার অবকাশ করে দিচ্ছে এই উদ্যোগ। নির্জুলি গ্রামে এখনও ইন্টারনেট মানে বিলাসিতা। পড়াশোনার সুযোগও সচরাচর পায়না উপজাতি সম্প্রদায়ের শিশুরা। তাদের কাছেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে এই লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন নরাং মিনা। তাঁর বাবার দীর্ঘদিনের সামাজিক কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে মিনা বুঝেছেন একমাত্র শিক্ষাই পারে সমাজের চেহারা বদলে দিতে। আর সেই দিনবদলের স্বপ্নকে কি চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যায়? যায় না তো। আর তাই এই উদ্যোগকে তো সমস্ত সীমানা ভেঙে ফেলতেই হতো।
এমনই নানা পথ-লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে আমাদের ভারতবর্ষেই। আইজল শহরেই এর কিছুদিন পর পাছুঙ্গা ইউনিভার্সিটি কলেজে তৈরি হয়েছে একইরকম একটি উদ্যোগ। সব জায়গার খবর প্রচারের আলোও পায় না। আমাদের দেশে দুর্নীতি আর কাদা ছোড়াছুড়ির বাইরেও যে এমন সুন্দর সুন্দর সব দৃশ্য ছড়িয়ে আছে, ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে।
আরও পড়ুন
লকডাউনে পড়ুয়াদের কাছে বই পৌঁছে দেবে ড্রোন, উদ্যোগ ভার্জিনিয়ার লাইব্রেরিয়ানের
Powered by Froala Editor