শিলং পাহাড়। চারিদিকে উন্মুক্ত প্রকৃতি, পর্বত, গাছপালা। পাশ দিয়ে চলে গেছে পাথুরে রাস্তা। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন। শুটিং চলছে। আর সেই শুটিং নিয়েই দুজনের মধ্যে ঝগড়া। একজন ছবিটির পরিচালক, অন্যজন প্রযোজক। ছবির প্রধান মহিলা চরিত্র যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন। কী হবে তাঁর পরিণতি? চিত্রনাট্য তৈরির সময়ও ধন্দে ছিলেন পরিচালক। ‘নীতা’ কি বেঁচে থাকবে? নাকি এখানেই শেষ হবে তাঁর জীবনের যাত্রা? তাই নিয়েই ঝগড়া চলছে প্রযোজকের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ঠিক করলেন, দুই রকম শটই নেওয়া হবে। পরে শিলং পাহাড়ের পিকে নেওয়া শটটাই জায়গা পেল সিনেমায়। ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই!’ তৈরি হল ‘মেঘে ঢাকা তারা’ নামক এক ইতিহাসের…
ঋত্বিক ঘটক আসলে কে? প্রতিবাদ? লড়াইয়ের নাম? দেশভাগের জ্বালা ভুলতে না পারা ছিন্নমূল বাঙালির প্রতিনিধি? নাকি বলা ভালো, একটা আয়না? যে আয়না আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে। আমাদের শিক্ষিত, ‘সাজিয়ে রাখা’ সমাজের গলায় আটকে থাকে। ঋত্বিকের মদের ঝাঁঝে আজও জ্বলে উঠছে বাংলা। চিনতে পেরেছি কি? আগুনকে কি এত সহজে চেনা যায়? তার জন্য তো একবার সেখানে ঝাঁপ দিতে হয় যে! তথাকথিত ‘সভ্য’ চামড়া না পুড়লে কি সমাজের আসল চেহারা দেখা যায়?
ইন্দুবালা দেবীর শেষ বয়সে জন্ম নিয়েছিলেন দুই ভাইবোন— ভবা ও ভবী। এরপরেই দাদা মনীশ ঘটকের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন খুকু, অর্থাৎ মহাশ্বেতা দেবী। ভবা-ভবী-খুকু তিনজনে মিলে একসঙ্গে বড়ো হতে লাগলেন। ওপার বাংলার পরিবেশ, খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে যেত ভবার মন। সেই ছুটে চলা থামেনি শেষ পর্যন্ত। দুই বাংলা মিলে যে বিশাল ভূখণ্ড, সেটাই যেন আকর্ষণ করত ঋত্বিক, মানে ভবা-কে। এমন ছেলের স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে কি মন থাকে? ময়মনসিংহ থেকে পরিবার চলে এল রাজশাহীতে; আর ভাই ঋত্বিককে নিয়ে কলকাতা চলে এলেন মনীশ ঘটক। জায়গা বদল হল বটে, কিন্তু দুরন্তপনা একই থাকল। স্কুলপালানো ‘দুষ্টু পোলা’ ভবা। তাঁকে বাগে রাখাই দায়! শেষ পর্যন্ত বাড়ি থেকেই ঠিক করা হল একটি নিয়ম। স্কুলে যাওয়ার সময় ঋত্বিক যখন বাড়ি থেকে বেরোতেন, তখন একটা খাতায় সই করে দিতেন তাঁর দিদি। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে পৌঁছনোর পর প্রধান শিক্ষক আরও একটা সই করে দিতেন। এতে যদি একটু মন বসে স্কুলে। না, কিছুতেই কিছু হয়নি। কয়েকদিন পরেই, দুজনেরই সই জাল করে স্কুল থেকে পালানোর নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন ঋত্বিক!
ঋত্বিক ঘটকের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘অযান্ত্রিক’-এর দিনে চলে গিয়েছিলেন প্রযোজক প্রমোদ লাহিড়ী। ‘অযান্ত্রিক’, সঙ্গে সত্যজিতের ‘পরশপাথর’— দুটি ছবিরই প্রযোজক ছিলেন তিনি। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালের ডিরেক্টরের নজরে পড়ল ঋত্বিকের সিনেমাটি।। একদম অন্যরকম ভাষা, অন্যরকম আবহ। বিমল আর জগদ্দলকে এত জীবন্ত কবে দেখেছে বাঙালি! বিদেশেও সুখ্যাতি পেল। দুর্ভাগ্য, অল্প সময়ের মধ্যে সাবটাইটেল যোগ করা সম্ভব হয়নি ছবিটিতে। ঋত্বিকের গাড়িও এগোতে থাকে এইভাবেই। অবাক ব্যাপার, একটা সময় মদ-কে ঘৃণাও করতেন তিনি। বিড়ি অবধি ঠিক আছে; কিন্তু মদ একেবারে ধ্বংস করে দেয়— এটাই ছিল ঋত্বিকের ভাবনা। ভাগ্যের এ কেমন পরিহাস! ঋত্বিকের জীবন পরে সেই মদের নেশার গর্তেই পড়ে গিয়েছিল। কীসের জ্বালা?
সত্যজিতের সঙ্গে আলাপটা ছিল আকস্মিক। ফটোগ্রাফার নিমাই ঘোষের পরিচালিত ‘ছিন্নমূল’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। সেখানেই প্রথম অভিনেতা ঋত্বিককে চাক্ষুষ করেন সত্যজিৎ। এরপর ছবিও এগোয়, সঙ্গে জীবন এবং সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের পর একবার বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়কে। বিশেষ বিমানের ভেতর পাশাপাশি বসে আছেন দুই কিংবদন্তি পরিচালক। আকাশ দিয়ে যাচ্ছে বিমান; আর নিচে টলমলে পদ্মা, দুই ধারে বাংলার সেই আদিগন্ত মাঠ, গ্রাম। এই তো আমার বাংলা! আমার জন্মস্থান! আর আজ তার থেকেই এত দূরে আমরা! জানলা দিয়ে নিচে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন ঋত্বিক। এ যে তাঁর বাংলাদেশ। তাঁর বাংলা। এতদিন পর, এইভাবে সেই পদ্মাকে দেখে কি আর সামলানো যায়?
তখনও বাংলাদেশে সন্তানদের নিয়ে আছেন ঋত্বিকের ভবী- প্রতীতি দেবী। দুই ভাইবোন এক হলেন আবার; আর প্রেক্ষাপট? সেই বাংলাদেশ। দুজনে মিলে চলে গেলেন কুমিল্লা। যুদ্ধের চিহ্ন তখনও ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। হঠাৎই জলার ধারে কী একটা পড়ে থাকতে দেখেন প্রতীতি দেবী। কাছে গিয়ে দেখেন, একটি বই। নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। কার যে ছিল বইটি, জানা যায়নি কোনদিন। বরাবরের মতো হারিয়ে গেল সে? এমন প্রেক্ষাপট আর ওই বইটি ঋত্বিক ঘটককে এনে ফেলল অন্য জায়গায়। মাথার কলকবজা নড়ে উঠল। এটাই হবে তাঁর পরবর্তী সিনেমা। কিন্তু কাগজ তো নেই হাতের সামনে! বোন ভবীর ইস্ত্রি করা শাড়ির ওপরই পেন দিয়ে লিখতে শুরু করলেন চিত্রনাট্য। তৈরি হল ‘তিতাস একটি নদীর নাম’…
আরও পড়ুন
সুপ্রিয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে; ঋত্বিক ঘটককে শর্ত দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
আরও কত কিছু চেয়েছিলেন জীবনে! এত ছবি করলেন, এত ডকুমেন্টারি— কেউ দেখল না! চেয়েছিলেন জসীমউদ্দিনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ নিয়ে একটা চলচ্চিত্র তৈরি হোক। তাতে নৃত্য পরিচালনা করবেন স্বয়ং উদয়শঙ্কর। কিন্তু সেসব কিছুই হল না। শরীর ততক্ষণে ভেঙে পড়েছে অনেক। কিন্তু চোখদুটো সেই আগের মতোই উজ্জ্বল! আগুন কি কখনও নেভে? যতই নিভিয়ে ফেলা হোক, অন্য দিক দিয়ে সে ঠিকই সামনে চলে আসবে। ঋত্বিক ঘটক সেই আগুনেরই আরেক নাম! শেষ পর্যন্ত সমর সেন থেকে সত্যজিৎ- প্রত্যেকেই ফিরে গেছেন ‘নাগরিক’-এর সময়। ঋত্বিকের এটিই ছিল প্রথম সিনেমা; মুক্তি পেয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর। যদি আগে বেরোত, তাহলে হয়তো তিনিই হতেন বাংলা চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ। অবশ্য তিনি যে ‘পথিকৃৎ’ নন, সেটাই বা বলি kI করে…
তথ্যসূত্র-
১) ‘ঋত্বিক’/ সুরমা ঘটক
২) ‘সেই ঋত্বিক’/ সম্পাদনা- সুব্রত রুদ্র
৩) ‘ঋত্বিক! একটি নদীর নাম’, আবির মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তথ্যচিত্র, পরিচালনায় ঋত্বিক ঘটক; দেখুন সেই দুষ্প্রাপ্য দলিল